ঢাকা, শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১, ১৭ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

ইন্টারপোলের রেড নোটিশে ঝুলছে ৬২ অপরাধী

প্রকাশনার সময়: ০১ অক্টোবর ২০২৩, ১৩:১১ | আপডেট: ০১ অক্টোবর ২০২৩, ১৩:১৩

নামেই ইন্টারপোলের ‘রেড নোটিশ’। বছরের পর বছর ধরে সেখানে অপরাধীদের নাম ঝুলতে থাকলেও ফেরানোর সংখ্যা খুবই কম। পুলিশের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যমতে ২০০৯ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত মাত্র ১৫ জনকে ফেরানো সম্ভব হয়েছে। এছাড়া চলতি বছর মতিঝিলে আওয়ামী লীগ নেতা টিপু হত্যাকাণ্ডে জড়িত মুসাকে ফেরানো সম্ভব হয়েছে। তবে এ সময়ের মধ্যে মোস্ট ওয়ানটেড কাউকেই ফেরানো সম্ভব হয়নি। যদিও ইন্টারপোলের রেড নোটিশে এখনো পর্যন্ত ৬২ জনের নাম ঝুলছে। সেই তালিকায় যুদ্ধাপরাধী, বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনি, একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার সাজাপ্রাপ্ত আসামি ও পুলিশের করা শীর্ষ সন্ত্রাসীর ১৮ জনের নামও। তবে নানা চেষ্টা সত্ত্বেও তাদের কাউকে ফিরিয়ে আনতে পারেনি পুলিশ। এমন পরিস্থিতিতে এসব আসামিদের অবস্থান চিহ্নিত করে কূটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যেমে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।

জানা গেছে, ইন্টারপোলের সর্বশেষ রেড নোটিশের তালিকায় যুক্ত হয়েছে আরাফ খান নামে ভারতীয় পাসপোর্টে দুবাই আশ্রয় নেয়া বাংলাদেশি রবিউল ইসলামের নাম। পুলিশ সদর দপ্তরের ন্যাশনাল সেন্ট্রাল ব্যুরো (এনসিবি) সূত্রে জানা যায়, অনেক দিন ধরে সংশ্লিষ্ট দেশের সঙ্গে চিঠি চালাচালি করেও তাদের ফিরিয়ে আনতে পারেনি বাংলাদেশ পুলিশ। তবে পুলিশ সদর দপ্তরের দাবি, ইন্টারপোলের রেড নোটিশ জারির পর ২০০৯ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, মালয়েশিয়া, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইরান, নিউজিল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ আফ্রিকা, কাতার ও ওমান থেকে ১৫ জনকে বাংলাদেশে ফেরত আনা সম্ভব হয়েছে। বন্দিবিনিময় চুক্তি না থাকার পরও ২০১৮ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর আবু সাঈদ নামের এক অপরাধীকে দুবাই থেকে ফিরিয়ে আনা হয়। তিনি এক স্কুলছাত্রীকে ধর্ষণ ও হত্যা মামলার আসামি। এর আগে ২০১৫ সালের ১৫ অক্টোবর ইন্টারপোলের মাধ্যমে কামরুল নামের এক হত্যা মামলার আসামিকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়।

পুলিশের তথ্যমতে, গত ছয় বছরে মাত্র একজনকে ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে পুলিশ। তিনি হলেন ঢাকার শাহজাহানপুরে আওয়ামী লীগ নেতা জাহিদুল ইসলাম টিপু হত্যার ঘটনায় সন্দেহভাজন একজনের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে উঠে আসা সুমন সিকদার ওরফে মুসাকে। ২০২২ সালের ৮ মে মুসা ওমানে যাওয়ার পর বিষয়টি মাস্কাটের ইন্টারপোল ডেস্ককে অবহিত করে ঢাকা। ৯ জুন তাকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে পুলিশ সদর দপ্তরের এক কর্মকর্তারা বলেন, চাইলেই কাউকে ফেরানো সহজ নয়। কারণ, চুক্তি থাকতে হবে। ভারত ও থাইল্যান্ড ছাড়া বিশ্বের কোনো দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের বন্দি বিনিময় বা প্রত্যর্পণ চুক্তি নেই। কাউকে ফিরিয়ে দেওয়া নির্ভর করে সংশ্লিষ্ট দেশের সরকারের সদিচ্ছার ওপর। অপরাধীর অবস্থান নিশ্চিত হলেই শুধু হবে না, ছবি ও নামের সঙ্গেও মিল থাকতে হয়। অনেক সময় দেখা যায়, অবস্থান নিশ্চিত হলেও অপরাধীরা অবস্থান বদলে ফেলে। আবার অনেকে অন্য দেশের পাসপোর্টে সেই দেশ বা অন্য দেশে আশ্রয় নেয়। তাদের শনাক্ত ও দেশে ফিরিয়ে আনা কঠিন। এছাড়া সংশ্লিষ্ট দেশের আইনও একটি বাধা

সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, ইন্টারপোল বিশ্বের বৃহত্তম আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা। সংস্থাটি আন্তর্জাতিক অপরাধের তিনটি প্রধান ক্ষেত্র— সন্ত্রাসবাদ, সাইবার অপরাধ ও সংগঠিত অপরাধ নিয়ে কাজ করে। এটি বিশ্বব্যাপী আইন প্রয়োগকারীকে তদন্তমূলক সহায়তা, দক্ষতা ও প্রশিক্ষণ প্রদান ছাড়াও পলাতক অপরাধী, জননিরাপত্তা এবং সন্ত্রাস, মাদক ও মানবপাচারকারীসহ যে কোনো সদস্য দেশের পুলিশকে জরুরি সহায়তা বা অপারেশনাল কার্যক্রমে সহায়তা করে থাকে।

এখন পর্যন্ত পুলিশের তালিকায় ‘শীর্ষ সন্ত্রাসী’ হিসেবে যাদের নাম এসেছে তারা হলেন— ‘আব্বাস ওরফে কিলার আব্বাস, জাফর আহমেদ ওরফে মানিক, শামীম আহমেদ ওরফে আগা শামীম, লিয়াকত হোসেন, ইমামুল হোসেন ওরফে হেলাল ওরফে পিচ্চি হেলাল, আমিনুর রসুল ওরফে টোকাই সাগর, সুব্রত বাইন, মোল্লা মাসুদ, প্রকাশ কুমার বিশ্বাস, আরমান ওরফে সুমন, কামাল পাশা ওরফে পাশা, খন্দকার তারভীর ইসলাম জয়, আব্দুল জব্বার ওরফে মুন্না, ইমাম হোসেন, খোরশেদ আলম ওরফে ফ্রিডম রাসু, সোহেল রানা ওরফে ফ্রিডম সোহেল ও খন্দকার নাঈম আহমেদ টেটন। তবে, পুলিশের এ খাতায় নাম দেখা যায়নি শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান আহমেদ, কামরুল আলম মুন্না, নবী হোসেন, শাহাদত হোসেন ও কামরুজ্জামানের।

ঢাকায় ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানের মধ্যে জিসানের যোগসূত্র মেলায় দুবাইয়ে আশ্রয় নেয়া জিসানকে ফেরানোর চেষ্টা করে পুলিশ। জিসানকে ইন্টারপোলের সহযোগিতায় গ্রেপ্তারও করে দুবাই পুলিশ। সে সময় তার হাতে ছিল ভারত ও ডমিনিকান রিপাবলিকের পাসপোর্ট। এ পাসপোর্ট নিয়ে তিনি এতদিন দুবাইয়ে অবস্থান করছিলেন। এর কিছুদিন পর তিনি মুচলেকা দিয়ে জামিন নেন। এক সপ্তাহের মাথায় চলে যান লন্ডনে।

সে সময় জিসানকে ফেরানোর বিষয়ে এনসিবি কর্মকর্তারা জানান, ভারত ও থাইল্যান্ড ছাড়া আর কোনো দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের অপরাধী প্রত্যর্পণ চুক্তি নেই। তবে, দুবাইয়ের সঙ্গে বাংলাদেশ পুলিশের মিউচুয়াল লিগ্যাল অ্যাগ্রিমেন্ট অর্থাৎ এমএলএ’র মাধ্যমে জিসানকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব।

রাজধানীর মিরপুর এলাকায় সবার কাছে মূর্তিমান এক আতঙ্কের নাম ছিল শীর্ষ সন্ত্রাসী শাহাদাত। এক সময় তিনি মিরপুর থানা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। বছর পাঁচেক আগে শীর্ষ সন্ত্রাসী শাহাদাত কলকাতা পুলিশের হাতে আটক হলেও পরে তাকে ছেড়ে দেয়া হয়। শাহাদত ভারতীয় পাসপোর্ট ব্যবহার করে দুবাই হয়ে ইতালি চলে যান। ভারতে তার স্থায়ী বসবাসের খবর পাওয়া গেলেও তিনি দুবাই, সিঙ্গাপুরসহ বিভিন্ন দেশে নিয়মিত যাতায়াত করেন বলে জানা যায়। তার কাছে বিশ্বের একাধিক দেশের পাসপোর্টও রয়েছে।

একইভাবে দেশ ছেড়ে পালিয়ে ভারতে অবস্থান নেন শীর্ষ সন্ত্রাসী মোল্লা মাসুদ ও তানভীরুল ইসলাম জয়, নেপালে সুব্রত বাইন, দুবাইয়ে আতাউর ধরা পড়লেও দেশে ফেরানো সম্ভব হয়নি। ওই দেশের আইনের ফাঁক গলিয়ে তারা আশ্রয় নেন অন্যত্র। মাঝে মধ্যে দু-একজন ভারত, দুবাই, নেপালে আটক হওয়ার তথ্য পুলিশ সদর দপ্তরের এনসিবি শাখা পায়। তবে, তাদের সবাইকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয় না। গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশের অধিকাংশ শীর্ষ সন্ত্রাসী ভারতে অবস্থান করছে। ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে ভারতে গ্রেপ্তার হন ইন্টারপোলের রেড নোটিশভুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসী মোল্লা মাসুদ। সে সময় বাংলাদেশ পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, তাকে দেশে ফেরত এনে বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করাতে সর্বাত্মক চেষ্টা চলছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাকে আর ফেরত আনা সম্ভব হয়নি। তবে, ইন্টারপোলের ওয়েবসাইটে ‘রেড নোটিশ অব ওয়ান্টেড পারসন্স’ তালিকায় বিভিন্ন দেশের মোট ছয় হাজার ৯৪৮ জন অপরাধীর ছবি, নাম ও জাতীয়তা তথা দেশের নাম উল্লেখ আছে। এর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশি ৬২ অপরাধীর নাম।

তারা হলেন— রবিউল ইসলাম ওরফে রবিউল (আরাভ খান), জাফর ইকবাল, তানজিরুল স্বপন, মোল্লা নজরুল ইসলাম, মিন্টু মিয়া, ওয়াসিম, খোরশেদ আলম, গিয়াস উদ্দিন, অশোক কুমার দাস, মিজান মিয়া, চন্দন কুমার রায়, রাতুল আহমেদ বাবু, সিরাজ মোস্তফা ওরফে মো. লালু, হারিস চৌধুরী, জাহিদ হোসেন খোকন, মো. সাঈদ হোসাইন ওরফে হোসেন, সাঈদ মোহাম্মদ হাসান আলী, আজিজুর রহমান, অজয় বিশ্বাস, তরিকুল ইসলাম, হানিফ, আব্দুল জব্বার, মোহাম্মদ আলাউদ্দিন, মো. সবুজ ফকিদ, মো. মনির ভূঁইয়া, শফিক-উল, আমান উল্লাহ শফিক, আবুল কালাম আজাদ, জাহিদুল ইসলাম, সাজ্জাদ হোসেন খান, মোহাম্মদ ইকরাম খান ওরফে নাঈম খান, ফেরদৌস ওরফে কালা জাহাঙ্গীর, মো. ইউসুফ, আব্দুল আলীম শরীফ, মজনু আহমেদ, নুরুল দিপু, মোহাম্মদ ফজলুল আমিন জাবেদ, এসএইচএমবি নুর চৌধুরী, আব্দুর রশিদ খন্দকার, নাজমুল আনসার, শরফুল হোসেন আহমেদ, শরিফুল হক ডালিম, রউফ উদ্দিন, মোসলিম উদ্দিন খান, এ এম রাশেদ চৌধুরী, আতাউর রহমান মাহমুদ চৌধুরী, আলহাজ মাওলানা মোহাম্মদ তাজ উদ্দিন মিয়া, সালাহউদ্দিন মিন্টু, গোলাম ফারুক অভি, শেখ হারুন, সুজিত সুলতান, তৌফিক আলম, জাফর আহমেদ, রফিকুল ইসলাম, জিসান আহমেদ জিসান, আমিনুর রাসুল, খন্দকার তানভীর ইসলাম জয়, নবী হোসেন, সুব্রত বাইন ত্রিমৈত্রী, প্রকাশ কুমার বিশ্বাস ও আব্দুল জব্বার। পুলিশ সদর দপ্তরের জনসংযোগ কর্মকর্তা এ কে এম কামরুল আহসান বলেন, এনসিবির মাধ্যমে বাংলাদেশি ৬৫ জনের তথ্য দিয়ে তাদের ফেরানোর সহযোগিতা চাওয়া হয়েছে। তারা বিভিন্ন দেশে অবস্থান করছেন। এনসিবির সঙ্গে ইন্টারপোল ও সংশ্লিষ্ট দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যোগাযোগ অব্যাহত আছে। ইন্টারপোল প্রায়শই সহযোগিতা করে থাকে। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীসহ দাগি আসামি, অপরাধী ও দণ্ডপ্রাপ্তদের ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া চলমান।

নয়াশতাব্দী/জেডএম

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ