ঢাকা, শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১, ১৬ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

মানি এক্সচেঞ্জের আড়ালে জমজমাট ‘হুন্ডি’ ব্যবসা

প্রকাশনার সময়: ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০৭:১৭

ডলার সংকটের সুযোগ নিয়ে শতাধিক মানি এক্সচেঞ্জ সরাসরি হুন্ডি ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে। তারা মানি এক্সচেঞ্জের সাইনবোর্ড ব্যবহার করে বেআইনিভাবে বেশি দামে নগদ ডলার কিনে সেগুলো মজুত করেছে। এরপর বাজারে সংকটের মাত্রা বাড়িয়ে লাগাম ছাড়া দাম বাড়িয়ে ডলার বিক্রি করেছে। এক্ষেত্রে জড়িত প্রতিষ্ঠানগুলো ডলার বিক্রির ক্ষেত্রে পাসপোর্টে বৈদেশিক মুদ্রা এনডোর্স করেনি। এমনকি ডলার কেনাবেচার কোনো তথ্য রেজিস্টারেও লিপিবদ্ধ করেনি। অর্থাৎ হুন্ডির মাধ্যমে তারা ডলার কিনেছে। একই সঙ্গে হুন্ডির মাধ্যমে বিক্রিও করেছে। সম্প্রতি জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা, ডিবি ও সিআইডির যৌথ অভিযানে ধরা পড়েছে একাধিক মানি এক্সচেঞ্জের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা। তাদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আরও শতাধিক মানি এক্সচেঞ্জের নাম বেরিয়ে এসেছে। জড়িত ওইসব প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে পাওয়া তথ্যগুলো যাচাই-বাছাই শেষে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে তদন্ত তদারক সূত্রে জানা গেছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সিআইডির প্রধান মোহাম্মদ আলী মিয়া জানান, বাংলাদেশ ব্যাংকের দেয়া তথ্য নিয়ে মাঠে নামে সিআইডি ও একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা। এরপর প্রাথমিক তদন্তে হন্ডির সঙ্গে জড়িত একধিক মানি এক্সচেঞ্জের সন্ধান পাওয়া যায়। পরে অভিযান চালিয়ে অন্তত ২০টি প্রতিষ্ঠানের নামে মামলা দেয়ার পাশাপাশি উদ্ধার করা হয়েছে লাখ লাখ ডলার। একই সঙ্গে এ ধরনের বেআইনি কাণ্ডে জড়িত আরও একাধিক বৈধ মানি এক্সচেঞ্জের নাম পাওয়া গেছে। তাদের বিষয়ে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া হবে। এছাড়া অবৈধভাবে আরও অন্তত শত শত প্রতিষ্ঠান হুন্ডি কারবারে জড়িয়ে পড়েছে। তারাও রয়েছে নজরদারিতে।

জানা গেছে, সামপ্রতিক সময়ে খোলা বাজারে নগদ ডলারের দাম পাগলা ঘোড়ার গতিতে বেড়ে যাওয়ার কারণ অনুসন্ধানের নামে বাংলাদেশ আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট (বিএফআইইউ)। এর আগে সরকারের একটি গোয়েন্দা সংস্থা থেকে তাদের কাছে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের নাম পাঠানো হয়। যেগুলো হুন্ডি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত বলে সন্দেহের তালিকায় ছিল। সেই তালিকা ধরে বিএফআইইউ তদন্ত করে শতাধিক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে হুন্ডির ব্যবসার সঙ্গে জড়িত থাকার তথ্য পেয়েছে। বিএফআইইউ মানি লন্ডারিংবিষয়ক ঘটনাগুলো তদন্ত করে থাকে।

সূত্র জানায়, সমপ্রতি খোলা বাজারে ডলারের দাম বেড়ে সর্বোচ্চ ১২১ টাকা পর্যন্ত উঠেছে। এর আগে এক দফা ১০৪ টাকায় উঠে। এরপর বাংলাদেশ ব্যাংক, জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা (এনএসআই) ও ডিবি পুলিশ খোলা বাজারে তদন্ত শুরু করলে ডলারের দাম ১০০ টাকার নিচে চলে আসে। এরপর গত মাসে আবার তা বেড়ে ১০০ টাকা ছাড়িয়ে যায়। একদিনের ব্যববধানে খোলাবাজারে ডলারের দাম ১০৬ থেকে বেড়ে ১১২ টাকায় উঠে। তখন ওইসব সংস্থা আবার তদন্ত শুরু করলে এর দাম কমে ১০৬ টাকায় নেমে যায়। যদিও আমদানির জন্য ডলার বিক্রি হচ্ছে ৯৫ টাকা দরে। চলতি বছরের ২৭ জুলাই নগদ ডলারের দাম খোলা বাজারে ১০৮ টাকায় উঠলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক, এনএসআই ও ডিবি তদন্ত শুরু করে। একই সঙ্গে বিএফআইইউ থেকেও তদন্ত শুরু হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংক তদন্ত করে ইতোমধ্যে ৫টি মানি চেঞ্জার্স প্রতিষ্ঠানের ব্যবসায়িক কার্যক্রম স্থগিত করেছে। কারণ দর্শানোর নোটিশ দিয়েছে ৪২টি প্রতিষ্ঠানকে। ১৫টি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পুলিশ সদর দপ্তরে চিঠিও পাঠিয়েছে।

এ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক বলেন, বৈদেশিক মুদ্রা বেচাকেনা সহজ করতে মানি চেঞ্জার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর লাইসেন্স দেয়া হয়েছিল। কিন্তু তারা এখন আইনের বাইরে চলে গেছে। যে কারণে এদের নিয়ন্ত্রণ করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কঠোর অবস্থান নিয়েছে। নিয়মনীতি লঙ্ঘনের দায়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যবস্থা নিচ্ছে। যেগুলো লাইসেন্স ছাড়া বেআইনিভাবে ব্যবসা করছে তাদের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ব্যবস্থা নেবে। এর বাইরে যেগুলো মানি লন্ডারিংয়ের মতো গুরুতর অপরাধ করেছে তাদের বিরুদ্ধে বিএফআইইউ ব্যবস্থা নিচ্ছে।

সূত্র জানায়, সম্প্রতি এনএসআই ও ডিবি-সিআইডির অভিযানে অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর রেজিস্টার বুক অনুসন্ধান করে পাওয়া তথ্যের সঙ্গে নগদ ডলার জমা রাখার মিল পায়নি। নিয়মানুযায়ী মানি চেঞ্জার্স প্রতিষ্ঠানগুলো যেসব ডলার কেনাবেচা করবে তার একটি তালিকা রেজিস্টার বুকে লিপিবদ্ধ থাকবে। এর ভিত্তিতে ভল্টে নগদ ডলার জমা থাকবে। কিন্তু এদের ক্যাশ রেজিস্টারে জমা ডলারের কয়েকগুণ বেশি ডলার ভল্টে পাওয়া গেছে। তারা গ্রাহকদের কাছ থেকে বাজারদরের চেয়ে বেশি দামে ডলার কিনতো। ফলে গ্রাহকরা তাদের কাছেই যেত। এটি জানার পর অন্যান্য অন্য মানি চেঞ্জার্সগুলোও একই পথ অনুসরণ করে তাদের মতো বেশি দামে ডলার কেনাবেচা করেছে। পুরো চক্রটি এভাবে বাজারে ডলারের দাম বাড়িয়েছে। এছাড়া ডলার কিনলেও তারা সেগুলো বিক্রি করে বাজরের স্বাভাবিক ফ্লো ঠিক রাখেনি। বরং বেশি মুনাফার জন্য জমিয়ে রেখে কয়েকজন ব্যবসায়ীর কাছে ওইসব ডলার বিক্রি করেছে। ডলার কেনার জন্য ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে আগাম অর্থ নেয়ার প্রমাণও মিলেছে। ওইসব অর্থে নগদ ডলার কিনে মজুত করেছে। পরে সেগুলো দেশ থেকে পাচার হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কেননা ওইসব ডলার তারা কোথায় কীভাবে বিক্রি করেছে তার কোনো তথ্য লিখিত আকারে পাওয়া যাচ্ছে না।

জানা গেছে, দেশে ২৩৫টি বৈধ মানি চেঞ্জার্স প্রতিষ্ঠান রয়েছে। কিন্তু অবৈধভাবে রয়েছে ১ হাজার ২০০টির বেশি। যেগুলো নিয়ে এখন তদন্ত হচ্ছে। তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, এতদিন অবৈধভাবে বিপুলসংখ্যক মানি চেঞ্জার্স কীভাবে কাদের সহায়তায় চলেছে সেটিই বড় প্রশ্ন।

সূত্র মতে, গত ১৭ জানুয়ারি রাজধানীর আদাবর থানাধীন রিং রোডস্থ জাপান টোকিও স্কয়ার শপিং কমপ্লেক্সের নিচতলায় আলম অ্যান্ড ব্রাদার্স ফাইমা ট্রাভেলস নামক দোকানে অভিযান চালিয়ে গ্রেপ্তার করা হয় হাসনাত এ চৌধুরী, মো. শামসুল হুদা চৌধুরী রিপন, মো. সুমন মিয়া ও তপন কুমার দাস। এ ঘটনায় বিশেষ ক্ষমতা আইনে আদাবর থানায় একটি মামলা করা হয়। গ্রেপ্তার করার সময় তাদের কাছ থেকে দেশি-বিদেশি মুদ্রায় বাংলাদেশি টাকায় ২৭ লাখ ৩৩ হাজার ৪২৩ টাকা উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনার পর চলতি বছরের ২৪ সেপ্টেম্বর ডলার কারসাজি ও হুন্ডি প্রতিরোধে রাজধানীর উত্তরা এলাকার বেশ কয়েকটি মানি এক্সচেঞ্জে অভিযান পরিচালনা করে জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা (এনএসআই)। অভিযানে বিপুল পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রাসহ ৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গ্রেপ্তাররা হলেন, নোভা মানি এক্সচেঞ্জের এমডি সাইফুল হাসান ভূঁইয়া, একই প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী মো. নাইমুল ইসলাম সুজন, কর্মচারী মো. আব্দুল আউয়াল, আল মদিনা ফটোস্ট্যাটের মালিক রেজাউল করিম সোহেল ও মার্ক মানি এক্সচেঞ্জের মালিকপক্ষের প্রতিনিধি মো. রফিকুল ইসলাম মানিক। অভিযানে নোভা মানি এক্সচেঞ্জের বিভিন্ন কাউন্টার থেকে ৭ হাজার ২৪৭ ইউএস ডলার, ৮৮ হাজার ৯৪০ ভারতীয় রুপি, ৬৫ হাজার ৯৬৫ নেপালি রুপি, ৮ হাজার ১১৪ সৌদি রিয়াল, ১১ হাজার রিঙ্গিত, ৩৭ হাজার ৭০০ রুবল, ৯ হাজার ৮২৫ ইউরো ও ১ হাজার ৫৯০ পাউন্ডসহ ৩৯টি দেশের ফরেন কারেন্সি জব্দ করা হয়। প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম লঙ্ঘন করে ফরেন কারেন্সি সীমার বাইরে অতিরিক্ত মজুত ও অতিরিক্ত মূল্যে ব্যবসা করে আসছিল।

অন্যদিকে মার্ক মানি এক্সচেঞ্জ থেকে অবৈধ ৭৬ হাজার ৬৫০ ভারতীয় রুপি, ১৯ হাজার ৯৪০ সৌদি রিয়াল, ১০ হাজার ৭০০ চায়না ইউয়ান, ১ হাজার ১০০ ইউরো, ৪ হাজার ৩৩৫ দিরহাম ও ৪ হাজার ৪৪২ রিঙ্গিতসহ ১৫টি দেশের ফরেন কারেন্সি জব্দ করা হয়। এছাড়া মার্ক মানি এক্সচেঞ্জে ৯ লাখ, ৪৬ হাজার টাকা মালিকবিহীন অবস্থায় পাওয়া যায়। মার্ক মানি এক্সচেঞ্জ মূলত মানি এক্সচেঞ্জ ব্যবসার আড়ালে অবৈধভাবে বিভিন্ন দেশের বিদেশি মুদ্রা গোপনে মজুদ করে আসছিল বলেও অভিযানে সংশ্লিষ্টরা জানতে পারে। একই সময় উত্তরার প্যারাডাইস, রিল্যায়াবল, ঢাকা, প্যারামাউন্ট, এইচ এস, রামাদা, রুবি মানি এক্সচেঞ্জসমূহেও পরিদর্শন ও অভিযান পরিচালনা করা হয়। সঠিক নিয়ম মেনে ব্যবসা পরিচালনা করার জন্য এসব প্রতিষ্ঠানের মালিক পক্ষকে মৌখিকভাবে সতর্ক করা হয়েছে।

এ ঘটনার পর গত ৩০ আগস্ট রাজধানীতে চারটি মানি এক্সচেঞ্জে অভিযান চালায় জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা (এনএসআই) ও পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ও অর্থ পাচার প্রতিরোধের কেন্দ্রীয় সংস্থা বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইনটেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। দৈনিক বাংলা মোড় ও গুলশানে এ অভিযান চালানো হয়। অভিযানে প্রায় দুই লাখ ডলার জব্দ ও হুন্ডি কারবারে জড়িত একাধিক ব্যক্তিকে আটক করা হয়।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, দৈনিক বাংলা মোড়ে অভিযান চালানো হয় আরএস ভবনের দ্বিতীয় তলায় অবস্থিত নিহন মানি এক্সচেঞ্জে। সেখানে ১ লাখ ৭০ হাজার মার্কিন ডলার (১ কোটি ৯০ লাখ ৪০ হাজার টাকা), ৩০ হাজার কানাডিয়ান ডলারসহ (২৬ লাখ ৫৫ হাজার টাকা) আরও কিছু দেশের মুদ্রা ও টাকা পাওয়া যায়। এ ছাড়া সেখানে হুন্ডির অর্থ বহনকারী মিরাজুল ইসলামের কাছে ৩৮ লাখ ১৮ হাজার টাকা পাওয়া যায়। তিনি এসব টাকা নিহন মানি এক্সচেঞ্জের মালিক শহীদের কাছে জমা দিতে এসেছিলেন। এ সময় তাকে হাতেনাতে ধরা হয়। মানি এক্সচেঞ্জের আড়ালে এভাবে হুন্ডির কারবার চালিয়ে আসছিলেন শহীদ। সেই তথ্য পায় এনএসআই। এই কারবারের মূল হোতা গোপাল মালয়েশিয়ায় বসবাস করেন। সূত্র বলছে, মতিঝিল ও পল্টন এলাকার মানি এক্সচেঞ্জগুলোতে বিদেশি মুদ্রা সরবরাহের একটি শক্তিশালী নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছেন মন্টু নামের এক ব্যক্তি। মন্টু চক্রের সদস্য ওমর ফারুক নিহন মানি এক্সচেঞ্জে অর্থ সরবরাহ দিতে এসে ডলারসহ আটক হন। তাকে জিজ্ঞাসাবাদে গোয়েন্দারা জানতে পেরেছেন, মন্টুর বাসা থেকে প্রতিদিন মানি এক্সচেঞ্জগুলোতে বিদেশি মুদ্রা সরবরাহ করা হয়। সারা দিনের লেনদেন শেষে সন্ধ্যায় মন্টুর নয়াপল্টনের বাসায় টাকা ও ডলার পৌঁছে দেয়া হয়।

নয়া শতাব্দী/এফআই

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ