ঢাকা, শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১, ১৭ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

স্বর্ণ পাচারে জড়িত ‘সর্ষের ভূত’

প্রকাশনার সময়: ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০৮:৩৯

দেশে স্বর্ণ আমদানিতে ট্যাক্সের হার বেড়ে যাওয়া এবং বৈধভাবে মাত্র একটি গোল্ডবার ব্যাগেজ সুবিধায় বিনা ট্যাক্সে নিয়ে আসার নিয়ম করার পর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে বিভিন্ন ধরনের কৌশলে স্বর্ণ পাচার করছে একটি চক্র। এ চক্রের সদস্যরা কখনো কখনো হাতেনাতে ধরা পড়ছে। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখে ফাঁকি দিয়ে হাওয়া হয়ে যাচ্ছেন। ফলে প্রতিবছর বড় অঙ্কের রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার। অভিযোগ রয়েছে এ কাজে সংশ্লিষ্ট চক্রের সঙ্গে আবারও নতুন করে জড়িয়ে পড়েছেন বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) ও রাষ্ট্রীয় উড়োজাহাজ সংস্থা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের কতিপর অসাধু কর্মীরা। তারা বিদেশ থেকে ফেরার সময় সঙ্গে করে স্বর্ণ নিয়ে আসেন। আবার নির্ধারিত দেশেও নিয়ে যান। বিভিন্ন সময়ে বিপুল পরিমাণ অবৈধ স্বর্ণসহ দেশে-বিদেশে এ দুই সংস্থার লোকেরা আটকও হয়েছেন। এ যেন সরষেতে ভূত থাকার মতোই।

জানা গেছে, সাম্প্রতিক সময়ে বেবিচক-বিমানের বেশ কয়েকজন কর্মী আটক-গ্রেপ্তার হওয়ার পর তাদের অপরাধের বিষয়টি প্রকাশ্যে আসে। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পুলিশ তাদের রিমান্ডে নিলে সেখানেও তারা নিজেদের অপকাণ্ডের বিষয়ে স্বীকার করেন। জানতে চাইলে বিমানবন্দর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আজিজুল হক মিয়া বলেন, ‘রিমান্ডে নেয়ার পর প্রথম দিনই মুখ খুলেছেন আসামিরা। জিজ্ঞাসাবাদে তারা দায়িত্ব পালনের আড়ালে চোরাকারবারিদের বহন করা কোটি কোটি টাকার স্বর্ণ পাচারের চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছেন। এগুলো খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’

নয়া শতাব্দীকে দেয়া এক সূত্র বলছে, বিমানের নিজস্ব নিরাপত্তাকর্মী, সিসি ক্যামেরা থাকার পরও প্রতিনিয়ত চোরাচালানের সঙ্গে বিমানের কর্মীরা জড়িয়ে পড়ছেন। চোরাচালানের কারণে কোনো কর্মী আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরা পড়লে বরখাস্ত করে দায় সারে বিমান। কখনও কখনও তদন্ত কমিটি গঠিত হলেও সেসব কমিটি দায়ীদের শনাক্ত করতে পারেনি। তবে এসব তদন্ত প্রতিবেদনে বিমানের ক্যাটারিং সার্ভিস ও প্রকৌশল বিভাগের কর্মীরা জড়িত বলেই উল্লেখ করা হয়!

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক কাস্টমস কর্মকর্তা বলেন, ‘বিমানের কর্মীরা অফিসে আসা-যাওয়া, উড়োজাহাজে ওঠার সময় নিরাপত্তাকর্মীরা প্রতিনিয়ত তল্লাশি করলেই অনেক ক্ষেত্রে চোরাচালান কমে আসবে। কিন্তু পরিস্থিতি থেকে মনে হচ্ছে, চোরা চালানে সহায়তার করার উদ্দেশ্যেই বিমানের ঊর্ধ্বতন কেউ কেউ এসব বিষয় এড়িয়ে যান।’

তথ্য বলছে, গত ২১ আগস্ট ৬৮ স্বর্ণের বার (৮ কেজি) স্বর্ণসহ শফিকুল ইসলাম নামে বিমানের এক এয়ারক্রাফট মেকানিক আটক হন। এয়ারপোর্টের আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) হাতে আটক হওয়া শফিকুলের কাছে থাকা স্বর্ণের বাজারমূল্য প্রায় ৮ কোটি টাকা। এ ঘটনাটি সামনে আসার পর থেকেই বেবিচক-বিমানের ভূমিকা নিয়ে ওঠে প্রশ্ন। শুরু হয় আলোচনা-সমালোচনা। গত ১৭ আগস্ট ৩৭ ভরি স্বর্ণসহ গ্রেপ্তার হন আরও পাঁচজন। তারা হলেন— বিমানবন্দরে কর্মরত বেবিচকের লাউঞ্জ অ্যাটেনডেন্ট আবদুল ওহাব, কনভেয়ার বেল্টম্যান হাসান ও শাহজাহান এবং তাজুল ইসলাম ও জামাল উদ্দিন। তাদের মধ্যে তাজুল ও জামাল পাচার চক্রের সদস্য। তাদের নামে বিমানবন্দর থানায় মামলা হয়। গত ১৪ এপ্রিল বেবিচকের গাড়িচালক সালেহকুজ্জামান পাঁচটি স্বর্ণের বার ও ৫০টি স্বণ্যের চেইনসহ আটক করে এপিবিএন। তার আগে গত ৪ জুন জেদ্দা বিমানবন্দরে বিপুল পরিমাণ অবৈধ স্বর্ণসহ এফএস জিয়াউল নামে বিমানের এক কেবিন ক্রুকে আটক করে সৌদি আরবের পুলিশ। এরও আগে, জেদ্দা বিমানবন্দরে অবৈধ স্বর্ণ ও মুদ্রাসহ পুলিশের হাতে আটক হয়ে চাকরি হারান রুহুল আমিন শুভ নামে বিমানের আরেক কেবিন ক্রু।

এর আগে ২০১৯ সালের ২৮ ডিসেম্বর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজ থেকে ৬৪ কেজি স্বর্ণ উদ্ধার করেছে ঢাকা কাস্টমস হাউস। কাঠের চারটি ক্যারেটের কাঠামোর মধ্যে লুকিয়ে রাখা স্বর্ণের বার পাওয়া যায়। এ স্বর্ণগুলো ২৭ ও ২৮ ডিসেম্বর সিঙ্গাপুর থেকে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের বিজি০৮৫ ফ্লাইটে ঢাকায় আসে। কাস্টমস কর্মকর্তাররা সে সময় প্রাথমিকভাবে সন্দেহ করেছিলেন, এ ঘটনায় বিমানকর্মীরা জড়িত থাকতে পারেন।

তারও আগে ২৩ নভেম্বর ৭ কেজি ১৯০ গ্রাম স্বর্ণসহ বিমানকর্মীকে আটক করে ঢাকা কাস্টমস হাউস। একই সঙ্গে বিমানটিও জব্দ করা হয়। সেদিন দুবাই থেকে আসা বিমানের ফ্লাইটে (বিজি০৪৮) সিটের নিচে রাখা ৪ কেজি ৬৪০ গ্রাম স্বর্ণের বার পাওয়া যায়। অন্যদিকে, একই দিনে আমদানি কার্গো কমপ্লেক্সের বহিরাংশসংলগ্ন রানওয়ে এলাকায় বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের টেকনিক্যাল হেলপার মেহেদি হাসানের কাছ থেকে ২ কেজি ৫৫০ গ্রাম স্বর্ণ পাওয়া যায়। গত ১৩ নভেম্বর আবুধাবি থেকে আসা বিমানের একটি উড়োজাহাজ থেকে ৮ কেজি ৮০০ গ্রাম স্বর্ণ উদ্ধার করে ঢাকা কাস্টমস হাউস। উড়োজাহাজটির সিটের নিচের পাইপের মধ্যে এসব স্বর্ণ লুকানো ছিল। এ ঘটনায়ও উড়োজাহাজটি জব্দ করে ঢাকা কাস্টমস হাউস। একই বছরের ১৩ জুলাই শাহজালাল বিমানবন্দরের হ্যাঙ্গার গেটের কাছ থেকে বিমানের ট্রাফিক হেল্পার এমদাদ হোসেন চৌধুরী ও তার সহযোগী আব্দুর রহিমকে ৪ কেজি স্বর্ণসহ আটক করেন বিমানবন্দর আর্মড পুলিশের সদস্যরা। তারা দুজনই সেদিন আমদানি কার্গোতে একটি প্যালেট থেকে এসব স্বর্ণ নিজেদের হেফাজতে নেন।

তথ্য বলছে, ২০১৭ সালে স্বর্ণ চোরাচালানের দায়ে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সকে ২০ লাখ টাকা জরিমানা করে ঢাকা কাস্টমস হাউস। একই সঙ্গে চোরাচালানের পণ্য বহনের দায়ে বিমানের বোয়িং ৭৩৭ উড়োজাহাজ (এস২-এএইচভি) ময়ূরপঙ্খীকে বাজেয়াপ্তও করে কাস্টমস। যদিও ৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ড দিয়ে উড়োজাহাজটি অবমুক্তির সুযোগ দিয়েছিল কাস্টমস।

সূত্র জানায়, উড়োজাহাজে করে স্বর্ণের বার বিদেশ থেকে নিয়ে আসে কারবারিরা। এরপর বিমানবন্দরে সেগুলো হেফাজতে নেন বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) চক্রে জড়িত কর্মীরা। তারা অবৈধ পণ্যগুলো নিরাপদে পৌঁছে দেন চক্রের হোতার কাছে। নিজেদের ডিউটির আড়ালেই এ চোরাচালান চক্রে জড়িয়ে পড়ছেন তারা। পরিকল্পিত চক্র হওয়ায় তাদের ধরা পড়ার আশঙ্কা একেবারেই কম!

স্বর্ণ চোরাচালান প্রতিরোধে কাজ করে এমন বাহিনীর সদস্যরা বলছেন, ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশ স্বর্ণ চোরাচালানের একটি গুরুত্বপূর্ণ রুট হিসেবে ব্যবহূত হয়। আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে এ দেশের স্বর্ণের দামের তারতম্য রয়েছে। চোরাচালানের মাধ্যমে স্বর্ণ আনলে অনেক বেশি লাভ করা যায়। তাই দিন দিন চোরাচালান বাড়ছে। নীতিগত জায়গায় পরিবর্তন না আনলে এটি নিয়ন্ত্রণে আনা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়বে। পাশাপাশি স্বর্ণ উদ্ধারের ঘটনায় আসামিদের বিচারহীনতার সংস্কৃতিও এক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করছে।

স্বর্ণ চোরাচালান প্রতিরোধে অসংখ্য সফল অভিযান পরিচালনা করেছেন এয়ারপোর্ট এপিবিএনের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোহাম্মদ জিয়াউল হক জিয়া। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, স্বর্ণ চোরাচালান একটা লাভজনক বিষয়। স্বর্ণ বৈধভাবে আনলে মোটা অঙ্কের ট্যাক্স লাগে। সেই ট্যাক্সটা ফাঁকি দেয়ার জন্য নিয়মিত চোরাচালান হয়। খরচ কম হওয়ায় বাংলাদেশ স্বর্ণ চোরাচালানের রুট হিসেবে ব্যবহূত হয়। আবার দেশে ব্যবহারের জন্যও আসে। সব মিলিয়ে এটা লাভজনক; তাই এত স্বর্ণ উদ্ধারের পরও চোরাচালান ঠেকানো যাচ্ছে না।

বেবিচকের সদস্য (প্রশাসন) মাহবুব আলম তালুকদার বলেন, সম্প্রতি স্বর্ণ পাচারের কয়েকটি ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে বেবিচকের ১০ কর্মীকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। এরপরও বিমানবন্দরে ডিউটির আড়ালে স্বর্ণ পাচার করছেন অসাধু কর্মীরা। তারা অন্যদের সঙ্গে মিলেমিশে এ কাজ করায় সহজে ধরা পড়ে না। তবে ধরা পড়লে তাদের কোনো ছাড় দেওয়া হবে না। জানতে চাইলে

হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নির্বাহী পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন কামরুল ইসলাম বলেন, চোরাচালান বন্ধে আমরা সব সময় জিরো টলারেন্স নীতিতে আছি। এজন্যই আসলে বিষয়টি সামনে এসেছে। আমরা ভবিষ্যতেও এ তৎপরতা অব্যাহত রাখব। বিমানবন্দরে যারা আছেন, কাস্টমস কর্তৃপক্ষ, এপিবিএন, শুল্ক গোয়েন্দা সবাই মিলেই আমরা টিম ওয়ার্ক করে জড়িতদের শনাক্ত করা, সেই সঙ্গে কেউ যাতে চোরাচালানে উৎসাহী না হয় সে চেষ্টা করে যাচ্ছি।

নয়াশতাব্দী/এমটি

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ