ঢাকা, শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১, ১৭ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

স্বস্তির উড়ালসড়কে ছুটে চলছে যান

প্রকাশনার সময়: ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০৭:৪২ | আপডেট: ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ২১:১৩

রোববার ভোর ৬টা থেকে খুলে দেয়া হয়েছে রাজধানীবাসীর বহুল প্রতীক্ষিত ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের একাংশ। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের উল্টো পাশের কাওলা থেকে ফার্মগেট অংশের ১১ কিলোমিটারে চলছে যানবাহন। বিমানবন্দর থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত অংশের দৈর্ঘ্য ১১ দশমিক ৫ কিলোমিটার। ১১ কিলোমিটার র‍্যাম্পসহ এ অংশটির মোট দৈর্ঘ্য ২২ দশমিক ৫ কিলোমিটার। প্রাথমিকভাবে এ অংশের ১৫টির মধ্যে ১৩টি র‍্যাম্প খুলে দেয়া হয়েছে। বনানী ও মহাখালীর র‍্যাম্প নির্মাণ শেষ হলেই খুলে দেয়া হবে। দেশের প্রথম উড়াল সড়কপথ এটি। এ পথ ধরে নির্ঝঞ্ঝাটে, ভোগান্তিহীনভাবে, দ্রুততম সময়ে চলাচল করতে পারছেন নগরবাসী। ফার্মগেট থেকে এয়ারপোর্ট পর্যন্ত যেতে যেখানে ঘণ্টার পর ঘণ্টার যানজটের ভোগান্তি পোহাতে হতো। সেখানে এ উড়ালসড়ক ব্যবহার করে মাত্র ১০ মিনিটেই ফার্মগেট থেকে এয়ারপোর্টের প্রায় এগারো কিলোমিটার পথ পাড়ি দেয়া সম্ভব হচ্ছে। যানজটের নগরে যেন এক চিলতে স্বস্তি উড়ালসড়ক। যে সড়ক বেয়ে বাধাহীন ছুটে চলেছে যান। নগর বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ‘এই এক্সপ্রেসওয়ের ফলে সাধারণ মানুষকে আর যানজটের অসহনীয় ভোগান্তি পোহাতে হবে না। ফলে বাঁচবে কর্মঘণ্টা। সেই সঙ্গে কমবে ভোগান্তি। তবে উদ্বোধনীর প্রথম দিনে এক্সপ্রেসওয়েতে তেমন চাপ দেখা যায়নি। উঠতে দেখা যায়নি গণপরিবহন। যে কারণে এক্সপ্রেসওয়ের নিচের সেই চিরচেনা যানজট খানিকটা একই রকম আছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ‘এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে গণপরিবহন না চললে এর সুফর পাবে না সাধারণ মানুষ। আর যানজট তেমন একটা কমবেও না। তাই অবিলম্বের এক্সপ্রেসওয়েতে গণপরিবহন চলাচল করার দাবি জানিয়েছেন এ রুটের যাত্রীরা। তবে গণপরিবহনের চালকরা বলছেন, ‘যেহেতু এক্সপ্রেসওয়েতে টোল আছে সেহেতু ভাড়া বাড়ানোর একটা বিষয় আছে। ভাড়া বাড়বে কিনা বা বাড়লেও কত বাড়বে সে বিষয়ে এখনও কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি। মালিক পক্ষও এখনও আমাদের এ বিষয়ে কিছু বলেনি। মালিক পক্ষ আমাদের যেখান দিয়ে গাড়ি চালাতে বলবে আমরা সেখান দিয়েই চালাব। জানতে চাইলে ভিআইপি পরিবহনের এক চালক বলেন, ‘আমরা রাস্তা থেকে যাত্রী উঠাই-নামাই। কিন্তু এক্সপ্রেসওয়ে গাড়ি থামান যাবে না। সেখানে যাত্রী উঠান বা নামানোর কোনো সুযোগ নেই। তাই ওই পথ দিয়ে গেলে আমাদের পোষাবে না।’

প্রথম দিনে চাপহীন এক্সপ্রেসওয়ে: উদ্বোধনের প্রথম দিনে এক্সপ্রেসওয়েতে তেমন চাপ লক্ষ করা যায়নি। গাড়িঘোড়াও তেমন একটা চলাচল করতে দেখা যায়নি। হাতেগোনা কিছু প্রাইভেট কার আর কাভার্ডভ্যান চলাচল করতে দেখা গেছে। সিএনজি-মোটরসাইকেলেরও নেই চলাচলের অনুমতি। ফলে প্রথম দিনে উড়ালসড়কের নিচের অংশের যানজট নিরসনে উল্লেখযোগ্য কোনো ভূমিকা রাখতে পারেনি এ উড়ালসড়ক। কোনো পরিবর্তন হয়নি সেই চিরচেনা যানজটের। রোববার সরেজমিনে এক্সপ্রেসওয়ে বিভিন্ন ওঠানামার পয়েন্টে ঘুরে এসব চিত্র দেখা গেছে। দেখা যায়, সকাল থেকেই বিমানবন্দর, বনানী ও মহাখালী অংশে এক্সপ্রেসওয়ের এর নিচে তীব্র যানজট দেখা যায়। এ বাইরে মহাখালী ও বনানীর দুটি ওঠার র‍্যাম্প বন্ধ থাকায় ওই অংশের গাড়িগুলো এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে ওপরে উঠে বিমানবন্দর বা ফার্মগেট অংশে চলাচল করতে পারছে না।

সরেজমিনে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাওলা প্রান্তে গিয়ে দেখা যায়, ব্যক্তিগত গাড়ি (প্রাইভেট কার) ও কয়েকটি ছোট পিকআপ ভ্যান এর ওপর দিয়ে চলাচল করছে। বিকাল ৩টা নাগাদ কোনো প্রকার বাস চলাচল করতে দেখা যায়নি। মহাখালীতে বাস টার্মিনাল পার হয়ে হাতের বাম পাশে দুটি র‍্যাম্প রয়েছে। এর মধ্যে একটি নেমেছে ও একটি উঠে গেছে। এ অংশে আগে থেকেই টার্মিনালকেন্দ্রিক গাড়িগুলো রাস্তা দখল করে রাখার জন্য যানজট লেগে থাকে। এক্সপ্রেসওয়ে খুলে দেয়ার পর অনেক গাড়ি এখানে নামার র‍্যাম্প দেয়ায় মহাখালীতে আসার ফলে অতিরিক্ত গাড়ির চাপ তৈরি হয়েছে। একইভাবে বনানী ও ফার্মগেট অংশে র‍্যাম্প দিয়ে গাড়িগুলো নেমে আগে থেকে সৃষ্টি জটের মধ্যে এসে পড়ছে। বনানীতে সড়ক ভবনের পাশেই একটি ওঠার র‍্যাম্প আছে। সেটিতে কাজ চলছে। যার কারণে ওই অংশের গাড়িগুলো ওপরে উঠতে পারছে না। এর কারণে মোটামুটি বনানী ও মহাখালীর এ রাস্তাতে আগের মতোই যানজট আছে। তবে কয়েকটি সিএনজিচালিত অটোরিকশা ও কিছু মোটরসাইকেল সাইকেলচালক এক্সপ্রেসওয়েতে উঠতে চাইলে পুলিশ তাদের নিচের পথ দিয়ে চলাচল করার কথা জানান।

প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছিলেন, এক্সপ্রেসওয়ে চালুর পর বিমানবন্দর সড়ক থেকে বনানী পর্যন্ত রাস্তায় গাড়ির চাপ কিছুটা কম থাকবে। তবে সরেজমিনে দেখা যায়, উল্টো আগের মতোই রাস্তায় যানজট তৈরি করেছে। সকাল ৮টা থেকেই বিমানবন্দর সড়কে তীব্র যানজট সৃষ্টি হয়। একই সঙ্গে বনানী থেকে মহাখালী ও তেজগাঁও হয়ে মগবাজার পর্যন্ত যানজট সৃষ্টি হয়।

উত্তরা থেকে ফার্মগেটগামী যাত্রী মিরাজ শেখ বলেন, উত্তরার বাসা থেকে বের হয়েই দেখি রাস্তায় তীব্র যানজট। এক্সপ্রেসওয়ে চালুতে ভেবেছিলাম আজ (গতকাল) হয়ত রাস্তায় যানজট কমবে। পরে দেখি লোকাল বাস একটাও ওপরে ওঠেনি। তবে স্বস্তির কথা জানান এক্সপ্রেসওয়ে চলাচলকারী যাত্রীরা। তারা জানান, এক্সপ্রেসওয়ের ফলে বিজয়সরণি, মহাখালী এবং বনানীর সেই চিরচেনা যানজেটের ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে না। এ যেন এক নতুন ঢাকা। একটি বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরি করেন আতিকুর রহমান। থাকেন রাজধানীর থানমন্ডিতে। সকালে ছোট ভাই সানাউল্লাহ মালয়েশিয়ার ফ্লাইট ছিল। তার সঙ্গে কথা হলে জানান, ‘প্রাইভেটকার নিয়ে এক টানে এয়ারপোর্ট চলে এসেছি। ভাবতেও পারিনি এত তাড়াতাড়ি চলে আসব। এক্সপ্রেসওয়ের ওপরে উঠলে মনে হয় অন্য কোনো দেশে আসছি।

জানতে চাইলে রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকার বাসিন্দা হামজা রহমান অন্তর বলেন, ‘এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে আমাদের নগরজীবনে নতুন মাত্রা এনে দেবে। আমাদের দৈনন্দিন জীবনের রুটিন পরিবর্তন হয়ে যাবে। চাকরিজীবীদের হাত থেকে টিফিনবক্স উঠে যাবে। বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীর টিউশনে যেতে আর দেরি হবে না। এ শহরের প্রেমিকরা তাদের প্রেমিকার কাছে পৌঁছাতে আর দেরি করবে না। সন্তানের সঙ্গে একসঙ্গে খাবার গ্রহণের অপেক্ষার প্রহর তাড়াতাড়ি ফুরাবে বৃদ্ধা বাবা-মায়ের।’

জানতে চাইলে গুলশান বিভাগের উপপুলিশ কমিশনার (ডিসি-ট্রাফিক) মোহাম্মদ আবদুল মোমেন নয়া শতাব্দীকে বলেন, ‘সকাল থেকে আমরা বনানী এলাকায় খুব বেশি গাড়ি নামতে দেখিনি। প্রাইভেট কার বেশি এক্সপ্রেসওয়ে ব্যবহার করছে। গণপরিবহন ব্যবহার করছে না। তবে আরও কয়েকদিন গেলে হয়তো মানুষ অভ্যস্ত হবে। তখন চাপ বাড়বে। এত শর্ট টাইমে আসলে কমেন্টস করার মতোও হয়নি।’

১৩ ঘণ্টায় চলেছে ১৩ হাজার গাড়ি, টোল আদায় ১১ লাখ : ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে প্রথম দিনে সকাল ৬টা থেকে যান চলাচল চালু হয়েছে। বিকাল ৭টা পর্যন্ত প্রথম ১৩ ঘণ্টায় চলাচল করেছে ১৩ হাজার ১২৫টি গাড়ি। এ সময় ১১ লাখ ৮৩ হাজার ৫২৯ টাকার টোল আদায় হয়েছে। বিমানবন্দরের কাওলা র‍্যাম্প থেকে উঠেছে ছয় হাজার ৬১৬টি গাড়ি। কুড়িল থেকে উঠেছে এক হাজার ১৯৮টি, বনানী থেকে এক হাজার ৯১টি গাড়ি উঠেছে। বিজয় সরণি র‍্যাম্প ব্যবহার করেছে এক হাজার ৯৪৯টি গাড়ি। সন্ধ্যায় ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের টোল ম্যানেজার আমিনুল রাসেল এ তথ্য জানান। এক্সপ্রেসওয়ে ব্যবহার করা গাড়ির মধ্যে অধিকাংশই প্রাইভেট কার। সরকারি-বেসরকারি কর্মজীবীদের বহনকারী অল্প কিছু বাসও চলেছে।

বর্তমানে প্রকল্পটির সার্বিক অগ্রগতি ৬৫ শতাংশ বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ। প্রকল্পটি ২০২৪ সালের জুনে শেষ হবে। ফলে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের পুরো সুফল পেতে আরও প্রায় এক বছর অপেক্ষা করতে হবে নগরবাসীকে। দেশের প্রথম পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপে তৈরি হয়েছে এ এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে। মূল এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের দৈর্ঘ্য ১৯ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার। প্রকল্পে ওঠানামার জন্য মোট ৩১টি র‍্যাম্প রয়েছে যার দৈর্ঘ্য ২৭ কিলোমিটার। র‍্যাম্পসহ এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের মোট দৈর্ঘ্য ৪৬ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার। ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের দক্ষিণে কাওলা থেকে কুড়িল-বনানী-মহাখালী-তেজগাঁও-মগবাজার-কমলাপুর-সায়েদাবাদ-যাত্রাবাড়ী হয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুতুবখালী এলাকা পর্যন্ত যাবে। প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৮ হাজার ৯৪০ কোটি টাকা।

নয়া শতাব্দী/এফআই

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ