ঢাকা, শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১, ১৬ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প ঋণে নেতিবাচক প্রভাব

প্রকাশনার সময়: ৩১ আগস্ট ২০২৩, ০৮:২৫

অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে ধীরগতি, চলমান রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, ডলার সংকট ও শিল্পের কাঁচামাল-মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি কমায় শিল্পঋণে ভাটা পড়েছে। চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে (জানুয়ারি-মার্চ) শিল্পঋণ কমেছে ১৮ হাজার কোটি টাকা। এই প্রান্তিকে ব্যবসায়ীরা ঋণ নিয়েছে ১.৩১ লাখ কোটি টাকা। যা তার আগের প্রান্তিকে ছিল ১.৪৯ লাখ কোটি টাকা।

ব্যাংকাররা জানান, আন্তর্জাতিক মার্কেটে তেল, গ্যাসসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য মূল্য ও ডলারের দাম ব্যাপক বৃদ্ধির কারণে ব্যবসায়ীদের আমদানি ব্যয় বেড়ে গেছে। এছাড়া ডলারের সংকটে শিল্পের কাঁচামাল আমদানি করতে না পারায় উৎপাদনে অনেক কমেছে। যার প্রভাবে শিল্পখাতের ঋণ বিতরণ কমেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২৩-এর মার্চ প্রান্তিকে শিল্পখাতের ব্যবসায়ীরা ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিয়েছে ১.৩১ লাখ কোটি টাকা। ২০২২-এর ডিসেম্বর প্রান্তিকে এ ঋণের পরিমাণ ছিল ১.৪৯ লাখ কোটি টাকা।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলেন, গ্লোবাল ইকোনমিক স্লো গ্রোথ, ইন্টারনাল ও এক্সটারনাল ঋণের সুদ বেড়ে যাওয়ায় ও মূল্যস্ফীতির কারণে শিল্প কারখানাগুলোর উৎপাদন ব্যাপক ব্যাহত হয়েছে। যার কারণে শিল্পঋণের চাহিদা অনেক কম ছিল। তারা আরও জানান, বিশ্বের বেশিরভাগ দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি মোকাবিলা করতে একই কৌশল ব্যবহার করছে। প্রধান অর্থনৈতিক দেশগুলোর কেন্দ্রীয় ব্যাংক মূল্যস্ফীতি রোধে সুদহার বাড়িয়েছে। দেশে কোভিডের পর থেকে অর্থনৈতিক কার্যকলাপ পুরোদমে শুরু হলে শিল্পঋণের চাহিদা ব্যাপক বৃদ্ধি পায়। যদিও ইউক্রেন রাশিয়া যুদ্ধের পর থেকে সাপ্লাই চেইন ব্যাহত ও আমদানি মূল্য বাড়ার কারণে শিল্পঋণ পরিমাণে বাড়লেও ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক স্লো ডাউনের কারণে উৎপাদন বাড়েনি।

মূল্যস্ফীতির ব্যাপক বৃদ্ধি এবং ডলার সংকট ও আমদানিতে শর্তারোপ থাকায় শিল্প খাতের উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে। যা এ খাতের ঋণ বিতরণ কমিয়ে দিয়েছে। উইন্ডি গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মেজবাহ উদ্দিন খানকে বলেন, বেশ কিছু কারণে শিল্প খাতে বিনিয়োগ কমছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো গ্লোবাল মার্কেট ঘোলাটে থাকা। এনার্জি ও ডলার মূল্য বেশি থাকা। ব্যাংকগুলোর ইন্টারেস্ট রেট বেড়ে গেছে যার কারণে শিল্প খাতের বিনিয়োগ কমছে। তিনি আরও বলেন, কিছু কিছু ব্যাংকের তারল্য সংকট রয়েছে। অন্যদিকে নির্বাচনের বছর হওয়ায় ব্যবসায়ীরা বিনিয়োগে নানা চিন্তাভাবনা করছেন। এসব কারণে বিনিয়োগ কমছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, কাঁচামাল আমদানি ও ক্যাপিটাল মেশিনারি গেল অর্থবছরে ব্যাপক পরিমাণে কমেছে, যার কারণে এই খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধিতে ব্যাহত হয়েছে। বিদায়ী অর্থবছর ২০২২-২৩ এর (জুলাই-মার্চ) ৯ মাসে এলসি সেটেলমেন্ট কমেছে যথাক্রমে ৩১ শতাংশ এবং ৬.৬৮ শতাংশ।

শিল্প খাতের আমদানির মধ্যে টেক্সটাইল ফেব্রিক, ফার্মাসিউটিক্যাল ‘র’ ম্যাটেরিয়াল, ‘র’ কটন, কটন ইয়ার্ন, সিন্থেটিক ফাইবার ও ইয়ার্নের জন্য এলসি খোলা ৩০ থেকে ৭০ শতাংশ কমেছে। ক্যাপিটাল মেশিনারির বেলায় এলসি ওপেনিং ও সেটেলমেন্ট কমেছে যথাক্রমে ৫৫.৮৮ শতাংশ ও ১৪.৯৩ শতাংশ। মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং সিইও সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, শিল্প খাতের ইনভেস্টমেন্ট কমার অন্যতম কারণ হলো এলসি রিলেটেড ক্যাপিটাল মেশিনারি ও ‘র’ ম্যাটেরিয়াল আমদানি কমছে, যার ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। তিনি বলেন, ব্যাংকগুলোর লিকিউডিটি অনেকটা চাপে রয়েছে। ওয়ার্ল্ড রিসেশন ও দেশের অবস্থার ওপর ভিত্তি করে ব্যবসায়ীরা বিনিয়োগ নিয়ে চিন্তাভাবনা করছেন। যার কারণে বিনিয়োগ কমছে।

আরেকটি বেসরকারি ব্যাংকের এমডি নাম প্রকাশ না করা শর্তে বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক মূল্যস্ফীতি কমাতে প্রাইভেট সেক্টরের ঋণের লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে এনেছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের ন্যয় বাংলাদেশও পলিসি রেট বাড়িয়েছে যার কারণে এই খাতের ঋণের পরিমাণ কমছে। গত জুনে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথমার্ধের জন্য মুদ্রানীতি ঘোষণা করে। এ নীতিতে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধির প্রজেকশন ১৪.১ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১১ শতাংশ করা হয়। বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি টানা সাত মাস ধরে কমতে কমতে এ বছরের জুনে ছিল ১০.৪৯ শতাংশ। যা ১৯ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। জুলাইয়ে মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৯.৬৯ শতাংশ, যা এক বছর আগে একই সময়ে ছিল ৭.৪৮ শতাংশ। মে মাসে মূল্যস্ফীতি ছিল ৯.৯৪ শতাংশ। যা ১১ বছর দুই মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে শিল্প খাতে বকেয়া ঋণের পরিমাণ ২০ শতাংশ বেড়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যে দেখা গেছে, যেখানে শিল্প খাতে বকেয়া ঋণের পরিমাণ ২০২৩ সালের মার্চ শেষে এক লাখ ১২ হাজার ৩ কোটি টাকায় পৌঁছেছে। যা ২০২২ সালের ডিসেম্বরে ছিল ৯৩ হাজার ৮১৩ কোটি টাকা। নির্দিষ্ট সময় পেরিয়ে গেলেও যেসব ঋণ পরিশোধ করা হয়নি, সেগুলোকে বকেয়া ঋণ হিসেবে গণ্য করা হয়।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২২ সালে ব্যাংকগুলো শিল্পখাতের ঋণ বিতরণ করেছে ৫ লাখ ৩১ হাজার কোটি টাকা। যা এর আগের বছরের তুলনায় এক লাখ এক হাজার ৩২১ কোটি টাকা বেশি। গত ২০২২ অর্থবছরের আগস্ট থেকে আমদানির পরিমাণ কমতে থাকায় বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি কমছে। ২০২৩-এর ফেব্রুয়ারিতে বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১২.১৪ শতাংশ যা গত ১১ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি কমলেও উল্টো চিত্র দেখা গেছে শিল্পখাতের ঋণ প্রবৃদ্ধিতে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের এক রিপোর্টে দেখা যায়, ২০২০-এর জানুয়ারির তুলনায় ২০২৩-এর জানুয়ারিতে অতি প্রয়োজনীয় আট ধরনের পণ্যের গড় মূল্য বৃদ্ধির হার- কয়লা ২৮৫ শতাংশ, পেট্রোলিয়াম ৩০০ শতাংশ, লোহা ও ইস্পাত ২০ শতাংশ, সয়াবিন ৭৬ শতাংশ, গম ৬৩ শতাংশ, চিনি ১০০ শতাংশ, সার ৭৫ শতাংশ, তুলা ৬৮ শতাংশ। অর্থাৎ, গড়ে ৭৭ শতাংশ মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে।

নয়াশতাব্দী/এমটি

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ