ঢাকা, সোমবার, ১১ নভেম্বর ২০২৪, ২৬ কার্তিক ১৪৩১, ৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

রাতের সড়ক বাসের দখলে

প্রকাশনার সময়: ২৯ আগস্ট ২০২৩, ০৭:২১

মসজিদের নগরী কিংবা রিকশার নগরী হিসেবে ঢাকার পরিচিতি রয়েছে। আবার দিনের বেলা ঢাকাকে যানজটের নগরীও বলা চলে। তবে রাত্রী নামলেই দেখা মেলে নতুন আর এক ঢাকার। রাস্তার দুই পাশে সারি সারি বাস দেখলে মনে হয় রাতের ঢাকা যেন বাসের দখলে। শহরের এক একটি রাস্তা পরিণত হয় বাস পার্কিং জোনে।

সড়কের পাশে রাখা বাসের মধ্যে অনেক রাত পর্যন্ত হেলপার ও চালকরা আড্ডা দেন। বাসের আড়ালে রাতভর চলে মাদক সেবন। এক একটি বাসে মাদকের আসর বসান চালক-হেলপাররা। এসব এলাকায় প্রায়ই ঘটছে ছিনতাইয়ের ঘটনা। স্থানীয় বাসিন্দারা খানিকটা জিম্মি হয়েই থাকেন বাসের পার্কিং জোনগুলোতে।

তথ্যমতে, নগরীতে প্রতিদিন সাড়ে ৫ হাজার বাস চলছে। প্রশাসনের নাকের ডগায় সড়কে অবৈধভাবে বাস রাখা হলেও কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। তবে মালিক-চালকরা বলছেন, নির্দিষ্ট কোনো জায়গা না থাকায় সড়কে বাস রাখা হচ্ছে।

রাত ১টা। নীলক্ষেত মোড় থেকে শুরু করে রাস্তার দু’পাশ ঘিরে আজিমপুর বাসস্ট্যান্ড ছাড়িয়ে প্রায় এক কিলোমিটার জায়গাজুড়ে সারি সারি বাস। দেখা মেলল দেওয়ান পরিবহন, ভিআইপি, বিকাশসহ কয়েকটি কোম্পানির প্রায় শতাধিক গাড়ি। বাস রাখার কারণে রাস্তা সংকোচিত হয়ে দুই তৃতীয়াংশই দখল হয়ে গেছে। রাত ২টা। তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল। তেজগাঁও লিংক রোড, রহিম মেটাল বটতলা ও শরীফ তাজউদ্দিন সড়কের ২ পাশে রাখা হচ্ছে প্রায় ২০০ বাস। রাত ২টা ৩০ মিনিট।

মিরপুর কিডনি ফাউন্ডেশন থেকে মিরপুর কলেজের পেছনের শাখা সড়ক (লাভ রোড) হয়ে শেরেবাংলা জাতীয় স্টেডিয়ামের মোড় পর্যন্ত অবৈধভাবে সড়কে ৭০টি বাস রাখা হয়েছে। এসব বাস বসুমতি, প্রজাপতি, তেতুলিয়া, রবরব, ইন্টারসিটি, মিরপুর লিংক, আকিক পরিবহন, আল মক্কা কোম্পানির। মিরপুর-১২ নম্বর ফিলিং স্টেশন থেকে সাগুপ্তার গেট পর্যন্ত সড়কের ২ পাশে ৬০-৭০টি বাস রাখা হচ্ছে।

এখানে রাখা বাসগুলো বসুমতি, প্রজাপতি, তেতুলিয়া, রবরব, আল মক্কা, ইন্টারসিটি, মিরপুর লিংক, আকিক পরিবহনের। রাত ৩টা। মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ড থেকে তিন রাস্তার মোড় পর্যন্ত রাস্তার একপাশে দুই লাইনে শতশত বাস দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। পর্বত থেকে গাবতলী, পুরান ঢাকার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে গিয়ে রাস্তার ওপর বাস দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়।

এ ছাড়াও রাজধানীর গাবতলী, শ্যামলী, কল্যাণপুর, কমলাপুর ও মহাখালীসহ একাধিক জায়গায় প্রধান সড়কের ওপর প্রতিদিন পার্কিং করা হচ্ছে দূরপাল্লার বাস। টার্মিনাল বাদ দিয়ে প্রধান সড়কের অর্ধেকেরও বেশি দূরপাল্লার বাসের দখলে চলে যায়। এতে সড়ক ও বাস টার্মিনালের পার্থক্য বোঝা কঠিন হয়ে পড়ছে।

এসব বাস কার নির্দেশে কীভাবে রাখা হয়— অনুসন্ধান করে নয়া শতাব্দী। অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে স্থানীয় রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ ও জনপ্রতিনিধি এবং পুলিশকে ম্যানেজ করে রাখা হয় এসব বাস। একাধিক বাসের লাইনম্যানের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রতি রাতে প্রতিটি বাসের জন্য ১২০ টাকা করে চাঁদা দিতে হয়।

যাত্রীকল্যাণ সমিতির তথ্যমতে রাজধানীতে বাস আছে সাড়ে পাঁচ হাজারের কিছু বেশি। এসব গাড়ির মধ্যে ঢাকা শহরে অন্তত তিন হাজার গাড়ি রাখা হয় বলে ধারণা সংশ্লিষ্টদের। গাড়ি প্রতি ১২০ টাকা করে চাঁদা উত্তোলন করা হলে প্রতি রাতে চাঁদা উত্তোলন করা হয় ৩ লাখ ৬০ হাজার টাকা। আর মাসে উত্তোলন করা হয় ১ কোটি ৮ লাখ টাকা। সে হিসাবে বছরে শুধু রাজধানীতে বাস পার্কিংয়ে চাঁদাবাজি হয় ১২ কোটি ২৯ লাখ টাকা।

আজিমপুর গিয়ে দেওয়ান পরিবহনের একটি বাসের মধ্যে আলো জ্বলতে দেখা যায়। কাছে গিয়ে কথা বললে আব্দুর রহমান নামের এক ড্রাইভার নয়া শতাব্দীকে বলেন, ‘আমাদের কোম্পানি এখানে রাখতে বলেছে তাই রাখছি ‘বিস্তারিত জানতে চাইলে তিনি রুবেল নামের তাদের কোম্পানির এক লাইন ম্যানের সঙ্গে কথা বলতে বলেন। লাইন ম্যানের সঙ্গে কথা বলতে তাকে ডাক দিলে সে কথা না বলে দ্রুত গতিতে স্থান ত্যাগ করেন।

এরপর নুর আলম নামের আর এক ড্রাইভার বলেন, ‘আমাদের কোম্পানির রাখার জায়গা নাই। আমরা এখনও সেরকম জায়গা পাইনি। তিনি জানান, দুই/তিন বছর ধরে এ কোম্পানিতে চাকরি করছেন। শুরু থেকেই তিনি এখানে গাড়ি রাখছেন। ভিআইপি পরিবহনের আর এক ড্রাইভার বলেন, ‘আমাদের কোম্পানির গাজীপুরে বাস রাখার একটি যায়গা আছে। তবে ঢাকার ভিতরে নাই। তাই ঢাকার ভিতরে গাড়িগুলো রাস্তার উপরে রাখা হয়।’

বিআরটিএ সূত্রে জানা যায়, ঢাকার রাস্তায় নতুন কোনো গণপরিবহন চলাচলের অনুমতি নেওয়ার সময় যানবাহনের পার্কিংয়ের জায়গা দেখানো বাধ্যতামূলক। কাগজে-কলমে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) এ নির্দেশনা মানা হলেও ঢাকার রাস্তায় দেখা যায় উল্টো চিত্র। অনুমোদন নেওয়ার সময় পার্কিংয়ের জায়গা দেখালেও বাসগুলো মূলত রাতের বেলা রাস্তার ওপরেই রাখা হয়।

বাস মালিকরা বলছেন, গাড়ির সংখ্যা বেশি হওয়ায় তাদের ‘কিছু’ বাস রাস্তায় রাখতে হয়। এ ছাড়া রাস্তায় পার্কিংয়ের জন্য কিছু ক্ষেত্রে পুলিশ এবং স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের মোটা অঙ্কের টাকাও দিতে হয় বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

জানতে চাইলে প্রজাপতি পরিবহনের এমডি রফিকুল ইসলাম নয়া শতাব্দীকে বলেন, ‘বাস রাখেন গাড়ির মালিকরা। এখানে কোম্পানির কিছু করার নাই। মালিকরা সড়কের নিরাপত্তায় নিয়োজিত পাহাড়াদারদের টাকা দিয়ে তাদের ম্যানেজ করে গাড়ি রাখে।’

বিকাশ পরিবহনের চেয়ারম্যান হারুন-আর রশিদ বলেন, ‘বাইপাইল নবিনগর আমাদের পার্কিং। আমরা সেখানে গাড়ি রাখি। সকালে যাওয়ার জন্য কয়েকটা গাড়ি রাস্তায় আজিমপুর রাখা হয়। আবার কিছু ড্রাইভার টাকা পয়সাা না দিয়ে ক্যাশ নিয়ে গাড়ি ফালাই রাইখা চইলা যায়।’

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১৯ সালে ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের (ডিটিসিএ) করা খসড়া পার্কিংয়ের নীতিমালায় বলা হয়েছে বাণিজ্যিক পরিবহন, যেমন— বাস, ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান, ওয়াটার ট্যাংকার, লরি ইত্যাদি যানবাহনের জন্য রাত্রিকালীন শুধু স্থানীয় কর্তৃপক্ষ কর্তৃক নির্ধারিত সড়কে পার্কিং ফি প্রদানের ভিত্তিতে পার্কিংয়ের অনুমতি প্রদান করা যেতে পারে। তাছাড়া গণপরিবহনের নিবন্ধনের অনুমতি দেওয়ার আগেই পার্কিংয়ের স্থান নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, কোম্পানিগুলো নামমাত্র জায়গা দেখিয়ে বিআরটিএ থেকে বাসের অনুমোদন নিচ্ছে।

জানতে চাইলে ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েত উল্লাহ নয়া শতাব্দীকে বলেন, ‘রাজধানীতে টার্মিনাল নাই তাই সড়কে রাখা হয়। টার্মিনাল থাকলে আর এ সমস্যা হবে না। কিন্তু রুট পারমিটের সময় তো পার্কিংয়ের জায়গা দেখানোর আইন রয়েছে— এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ওই আইন ব্রিটিশ আমলের। ওই আইনের কার্যকারিতা নাই।

গণপরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান বলেন, অনেক ক্ষেত্রে আমরা দেখি বাসের অনুমোদনের সময় রাজনৈতিক প্রভাব এবং সুপারিশের মতো ঘটনা ঘটে। সেক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনীয় অনুসন্ধান না করেই অনুমোদন দিয়ে দেয়। এগুলো নিয়ন্ত্রণ না করা গেলে এবং যথাযথ জবাবদিহি নিশ্চিত না করতে পারলে কাগুজে নীতিমালা সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে কোনো কাজে আসবে না।

এর আগে ঢাকা মহানগরীর যানজট নিরসনে রাত ১২টার পর সড়কের ওপর গাড়ি পার্ক করার বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিলেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস। সেই নিষেধাজ্ঞা ২০২১ সালের ১ জানুয়ারি থেকে কার্যকর হওয়ার কথা থাকলেও এখনও আলোর মুখ দেখেনি।

জানতে চাইলে ট্রাফিক তেজগাঁও বিভাগের উপ-কমিশনার (ডিসি) শাহেদ আল মাসুদ নয়া শতাব্দীকে বলেন, ‘আসলে ঢাকার ভিতরে টার্মিনালে যে যায়গা তার চেয়ে অনেক বেশি পরিবহন হওয়ার রাস্তার উপর গাড়ি রাখতে দিতে হয়। তা ছাড়া রাতে সড়কে গাড়ির চাপও কম থাকে। তবে আমরাও বারবার বলে আসছি- এ ধরনের টার্মিনালগুলো শহরের প্রান্ত সীমায় নিয়ে গেলে ভালো হয়। তখন এ সমস্যাগুলো সহজেই সমাধান হবে। মাদক-ছিনতাইয়ের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এই বিষয়ে আমাদের ক্রাইম ডিভিশন প্যাট্রল টিম রয়েছে। তারা কাজ করে থাকে।’

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে বিআরটিএ রোড সেফটি বিভাগের পরিচালক মাহবুব-ই রব্বানী নয়া শতাব্দীকে বলেন, ‘সড়কে গাড়ি থাকার কথা নয়। তবে থাকলে পরিবহনের রুট পারমিট দেয়ার জন্য ৮ সদস্যের একটা কমিটি আছে। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ কমিটির কাছে দিলে ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ রয়েছে। তাছাড়া সড়কের বিষয়টা দেখার দায়িত্ব তো পুলিশের। আপনারা পুলিশের সঙ্গে কথা বলেন।’

নয়া শতাব্দী/এমআর

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ