ঢাকা, রোববার, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৭ আশ্বিন ১৪৩১, ১৮ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

‘গায়েব’ মাঠ-পার্ক

প্রকাশনার সময়: ২৮ আগস্ট ২০২৩, ০৭:৩৬

বাসযোগ্যতা হারাচ্ছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) আবাসন প্রকল্পগুলো। চাহিদা বেশি থাকায় প্রকল্পগুলোতে খেলার মাঠ, পার্কসহ কমন স্পেসগুলো কেটে প্লট বানানো হয়েছে। ১০ লাখ মানুষের থাকার উপযোগী করে পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পের নকশা করেছিল রাজউক। কিন্তু পরে পূর্বাচল উপশহর প্রকল্পে বসতির সংখ্যা দ্বিগুণেরও বেশি বেড়ে গেছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা প্রকল্পটি আন্তর্জাতিক মানের দাবি করলেও বাস্তবতা হলো, আন্তর্জাতিক মানের তো নয়ই, এমনকি রাজউক যে ভিত্তিকে মানদণ্ড ধরে আবাসন প্রকল্পের নীতিমালা তৈরি করেছে, সেটাও অনুসরণ করা হয়নি। নগর পরিকল্পনাবিদগণের জিজ্ঞাসা নকশায় থাকা খেলার মাঠ ও পার্কসহ কমন স্পেসগুলো গায়েব হয়ে গেল কোথায়?

জানা গেছে, রাজউকের পূর্বাচল প্রকল্পেই প্লটের সংখ্যা বাড়াতে ৫ দফা নকশা কাটছাঁট করা হয়েছে। চতুর্থবার কাটছাঁট করার পর হাইকোর্ট নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল আর কাটছাঁট না করার। কিন্তু আদালতের সেই নির্দেশ উপেক্ষা করেই পঞ্চম দফা মূল নকশা কাটছাঁট করেছে রাজউক।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে রাজউকের এক কর্মকর্তা বলেন, শুরুতে মানদণ্ড ঠিক রেখে প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের চেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু দিন যতই যায়, ততই উন্মুক্ত স্থান, পার্ক বা স্কুলের জায়গা কমিয়ে প্লট বানানো হয়েছে। এভাবে পূর্বাচল প্রকল্পে পাঁচবার লে-আউট প্ল্যান সংশোধন করা হয়েছে। এ নিয়ে বহু ঝামেলাও হয়েছে। পরিবেশবাদী সংগঠন বাংলাদেশ এনভায়রনমেন্টাল ল ইয়ার্স অ্যাসোসিয়েশন (বেলা) এ নিয়ে মামলা করে।

পরে আদালত নির্দেশ দেন, এখন কোনো পরিবর্তন করতে হলে আদালতের অনুমতি নিতে হবে। কিন্তু তত দিনে যা ক্ষতি হওয়ার হয়ে গেছে। এসব প্রসঙ্গে রাজউকের নগর পরিকল্পনাবিদ ও ডিটেইল এরিয়া প্ল্যানের (ড্যাপ) প্রকল্প পরিচালক আশরাফুল ইসলাম বলেন, আবাসন প্রকল্প প্রণয়নের শুরুতে যে পরিকল্পনা ছিল সে অনুযায়ী জনসংখ্যা বসবাস করলে সমস্যা হতো না। কিন্তু পরে পূর্বাচল উপশহর প্রকল্পে বসতির সংখ্যা বেড়ে গেছে।

পূর্বাচলে ১০ লাখ মানুষের বসবাসের কথা চিন্তা করে পরিকল্পনা করা হয়েছিল। এখন দ্বিগুণ মানুষের বসবাসের কথা বলা হচ্ছে। যদি ১০ লাখ মানুষ বসবাস করে, তাহলে মানদণ্ড ঠিক থাকে। কিন্তু ১০ লাখের বেশি মানুষ পূর্বাচলে বাস করলে সেখানে মানদণ্ড অনুযায়ী নাগরিক সুবিধাদি থাকবে না। জনঘনত্ব নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে পূর্বাচলও ধানমন্ডি, গুলশানের মতো হয়ে যাবে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রকল্পগুলোর শুরুতে রাজউক স্ট্যান্ডার্ড অনুসরণ করেছিল। কিন্তু পরে পার্ক ও খোলা জায়গা কমিয়ে প্লটের সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। খেলার মাঠ কেটেও প্লট করা হয়েছে।

রাজউকের সাবেক চেয়ারম্যান এবিএম আমিন উল্লাহ নূরী বলেন, ‘আগে কী হয়েছিল সে ব্যাপারে আমি কিছু বলব না। যত প্রভাবশালীই হোক না কেন, আমি দায়িত্বে থাকাকালে কোনো খেলার মাঠ বা পার্কের জায়গা প্লট বানিয়ে কোনো ব্যক্তিকে বরাদ্দ দেয়া হয়নি।’

নগর পরিকল্পনাবিদরা বলেন, পরিকল্পিত আবাসিক এলাকার জন্য রাজউকের একটি মানদণ্ড রয়েছে। ৫০ একর জমিতে সাড়ে ১২ হাজার মানুষ বাস করবে। প্রতিটি ইউনিটে দেড় একর জমিতে তিনটি প্রাথমিক বিদ্যালয়, দুটি উচ্চ বিদ্যালয়, দুটি পার্ক এবং একটি জলাধার থাকবে। তিনটি খেলার মাঠ, দুটি কমিউনিটি সেন্টার এবং দুটি কমিউনিটি ক্লাব থাকবে।

ড্যাপ প্রণয়নে সম্পৃক্ত নগর পরিকল্পনাবিদ হিশাম উদ্দিন চিশতি বলেন, পরিকল্পিত ও মানসম্মত আবাসিক এলাকায় প্রতি সাড়ে ১২ হাজার জনসংখ্যার জন্য এক একর জায়গায় পার্ক ও দুই একর জায়গায় খেলার মাঠ থাকার কথা। তাদের জরিপে প্রয়োজনের ছয় ভাগের এক ভাগও পাওয়া যায়নি। যেটুকু খেলার মাঠ তারা পেয়েছেন, সেগুলোরও বেশ কিছু সাধারণের জন্য উন্মুক্ত নয়। নকশায় থাকা খেলার মাঠ ও পার্কসহ কমন স্পেসগুলো গেল কই?

রাজউকের পূর্বাচল উপশহর প্রকল্পের নথিপত্র পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, এ প্রকল্পের শুরুতেই প্রয়োজনীয় সুবিধা রাখা হয়নি। শুরুতে নার্সারি ও প্রাথমিক বিদ্যালয় রাখা হয় ১৮২টি। অথচ সেখানে প্রয়োজন ছিল ২৪০টি। সেকেন্ডারি স্কুল অ্যান্ড কলেজ রাখার কথা ছিল ৩৬০টি। সেখানে রাখা হয় ২৯৯টি।

মাঠ রাখার কথা ছিল ২৪০টি। রাখা হয় ১৩৭টি। আর যেখানে পার্ক রাখার কথা ১২০টি, রাখা হয় ৬১টি। এভাবে ৭২০ একর জায়গায় জলাধার রাখার কথা ছিল। সেখানে রাখা হয় ২৬০ একর। এভাবে অনেক কিছু কর্তন করে পরিকল্পনা করা হয়। তারপর পাঁচবার লে-আউট প্ল্যান সংশোধন করা হয়। প্রতিবারই এসব সুবিধা আরও কমানো হয়।

সর্বশেষ পূর্বাচল উপশহরে মোট শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১০২টি। অথচ চতুর্থ সংশোধনীতেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ছিল ১৫৭টি। নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, ১৫ লাখ মানুষের বসতি ধরে রাজউক পূর্বাচলের পরিকল্পনা করেছে। এখন সেখানে পাঁচ লাখ মানুষের নাগরিক সুবিধা রাখা হয়েছে।

এ বিষয়ে নগর পরিকল্পনাবিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক এবং বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সভাপতি ড. আকতার মাহমুদ বলেন, একটি আবাসন প্রকল্প করতে হলে তার পপুলেশন ডিজাইন থাকতে হয়। ওই এলাকায় কতগুলো প্লট থাকবে, কতগুলো ফ্ল্যাট হবে, কতগুলো পরিবার থাকবে।

এসব বিবেচনায় নিয়ে কমিউনিটি সুবিধা ও নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করতে হয়। এসবের মধ্যে প্রথম যে বিষয়টি আসে সেটি হলো স্কুল। বর্তমানে রাজউকের যে ইমারত নির্মাণ বিধিমালা আছে সেই নীতিমালা অনুসরণ করলে পূর্বাচলে ৩০ লাখ মানুষ বসবাস করবে। অথচ সেখানে ওই পরিমাণ নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করা হয়নি। এই চিত্র পূর্বাচল ছাড়াও অন্যান্য আবাসন প্রকল্পেও আছে।

স্কুল-কলেজ-খেলার মাঠ তো ওই অনুপাতে নেই। ফলে দেখা যাবে এসব প্রকল্পেও এক সময় জনসংখ্যা বেড়ে যাবে। আবাসিক ভবনের মধ্যে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় চালু হবে। বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু হবে। এ সমস্যার সমাধানের জন্য ডিটেইলড এরিয়া প্ল্যান (ড্যাপ) ও ইমারত নির্মাণ বিধিমালার মধ্যে সমন্বয় থাকা প্রয়োজন।

ড. আকতার মাহমুদ মনে করেন, জেলা-বিভাগীয় পর্যায়ে আরও বিনিয়োগ প্রয়োজন। বর্তমান যে কেন্দ্রমুখী নীতিমালা আছে এটা দিয়ে ঢাকার আবাসন সমস্যার সমাধান করা যাবে না।

পূর্বাচল উপশহর প্রকল্পের পিডি (প্রকল্প পরিচালক) মনিরুল হক বলছেন, বর্তমানে ১৫ লাখ মানুষের বসবাসের কথা বলা হলেও এই সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। তিনি বলেন, ঢাকা শহরের অন্যান্য জায়গার অবস্থা কী? সেসব স্থানে প্রয়োজনীয় স্কুল-কলেজ-পার্ক-মাঠ আছে? বরং সে তুলনায় পূর্বাচলে অনেক বেশি স্কুল-কলেজ থাকবে। তিনি আরও বলেন, প্রকল্পের পরিকল্পনা তো রাজউক একা করেনি। রাজউকের সঙ্গে কনসালটেন্ট ছিল। কনসালটেন্টেরও দায় আছে।

পূর্বাচলের কনসালটেন্ট প্রতিষ্ঠান ডাটা এক্সপার্ট লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী জাহাঙ্গীর কবির এ প্রসঙ্গে বলেন, এ নিয়ে অনেক কথাবার্তা চলছে। কিন্তু ২০০৪ সালে যে নীতিমালা ছিল, পরে তা সংশোধন করা হয়। আমি ২০০৪ সালের নীতিমালা অনুসরণ করেই পূর্বাচলের পরিকল্পনা করেছিলাম। পরে রাজউক অনেক কিছু কাটছাঁট করে এসব করেছে। আমি কনসালটেন্সি করি। আমি স্কুলের সংখ্যা কমালে আমার লাভ কী? আমি সঠিক মানদণ্ড ধরেই করেছিলাম। বাস্তবতা হলো, রাজউক চাইলে কনসালটেন্টের কিছু করার থাকে না।

নয়া শতাব্দী/এমআর

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ