বিদেশে বাংলাদেশি কর্মীদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। আর্থিক সচ্ছলতা ও জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের আশায় বিদেশে পাড়ি দেয়া লোকদের পাশাপাশি বাড়ছে প্রতারণার শিকার হওয়া অভিবাসী ও অভিবাসন প্রত্যাশীদের সংখ্যাও। বেতন না দেয়া, ভুয়া চাকরির প্রস্তাব এবং অনিয়মিত কর্মসংস্থানসহ বিভিন্ন ধরনের প্রতারণার শিকার হচ্ছেন বিদেশগমন ইচ্ছুকরা।
জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি)-এর তথ্য অনুসারে, ২০২৩ সালের প্রথম ছয় মাসে ১ হাজার ১১২ জন অভিবাসী ও অভিবাসনকামী ব্যক্তি মধ্যস্বত্বভোগী বা নিয়োগকর্তাদের বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগ করেছেন। এরমধ্যে ৫৮ শতাংশ পুরুষ এবং বাকি ৪২ শতাংশ নারী। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শ্রম অভিবাসনের বর্তমান এ ধারা অব্যাহত থাকলে চলতি বছরের শেষ নাগাদ অভিযোগের সংখ্যা দ্বিগুণ হতে পারে।
অভিবাসন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আনুষ্ঠানিকভাবে কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দেয়া অভিযোগের তুলনায় প্রকৃত অভিযোগের সংখ্যা অনেক বেশি; কারণ উল্লেখযোগ্য সংখ্যক অভিবাসী ও অভিবাসন প্রত্যাশীরা আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযোগ দায়ের করেন না। এছাড়া, এনজিওর সহায়তায় গ্রাম্য সালিশের মাধ্যমে তৃণমূল পর্যায়ে অসংখ্য অভিযোগ সমাধান হয়ে যায় বলেও উল্লেখ করেন তারা। চলতি বছরের জুন পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে ৬ লাখ ১৭ হাজার কর্মী বিদেশে পাড়ি দিয়েছে। বিএমইটির তথ্য অনুসারে, ২০২২ সালে এ সংখ্যা ছিল ১১ লাখ ৩৫ হাজার।
গন্তব্য দেশগুলোতে অভিবাসীরা প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী চাকরি না পাওয়া, অনিয়মিত কর্মসংস্থান, ভুয়া কোম্পানি, অনিয়মিত বেতন, অনেক সময় বেতন না পাওয়া এবং শারীরিক নির্যাতনসহ নানা ধরনের প্রতারণার সম্মুখীন হয়ে থাকেন।
জানা গেছে, অভিবাসন প্রত্যাশীদের অনেকেই দেশের মধ্যেও প্রতারণার শিকার হয়ে অভিযোগ দায়ের করেন। মধ্যস্বত্বভোগীরা অভিবাসনের কথা বলে এসব লোকের কাছ থেকে টাকা-পয়সা নিলেও শেষ পর্যন্ত প্রতিশ্রুতি রাখেননি। অনেকে আবার শ্রম অভিবাসনের কথা বলে করেছেন মানবপাচার।
উদাহরণস্বরূপ, কুমিল্লার অভিবাসন প্রত্যাশী মো. রহমত ২০২০ সালের মার্চে ভিয়েতনামে যাওয়ার জন্য এক মধ্যস্বত্বভোগীকে প্রায় ২ লাখ টাকা দিয়েছিলেন। একটি রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে বিএমইটি ক্লিয়ারেন্স কার্ডও পেয়েছিলেন তিনি। তবে কোভিড-১৯ মহামারির কারণে সংস্থাটি তাকে আর গন্তব্য দেশে পাঠাতে পারেনি। এরপর তিনি টাকা ফেরত চাইলে এজেন্সি এবং মধ্যস্থতাকারী উভয়েই তা প্রত্যাখ্যান করেন। ২০২২ সালের জানুয়ারিতে এজেন্সির বিরুদ্ধে বিএমইটিতে অভিযোগ দায়ের করেন মো. রহমত। কিন্তু বিএমইটিতে একাধিক সালিশের পরেও তিনি এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত টাকা ফেরত পাননি।
কুয়ালালামপুরে বাংলাদেশ হাইকমিশনের তথ্য অনুসারে, চলতি বছর মালয়েশিয়ায় কয়েকটি ভুয়া কোম্পানিতে অন্তত ২০০ বাংলাদেশিকে নিয়োগ দেয়া হয়। হাইকমিশনের সহায়তায় পরে তারা অন্য কোম্পানিতে চাকরি পেয়েছেন।
বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী, সরকার নির্ধারিত অর্থের চেয়ে বাংলাদেশি অভিবাসীরা সৌদি আরবে যাওয়ার জন্য ২.৬ গুণ, মালয়েশিয়ার জন্য ২.৫ গুণ এবং সিঙ্গাপুরের জন্য ২.২ গুণ অর্থ বেশি খরচ করেছেন। যদিও দেশের রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর দাবি, অভিবাসী শ্রমিকদের দায়ের করা বেশিরভাগ অভিযোগই মিথ্যা।
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সির (বায়রা) সভাপতি মোহাম্মদ আবুল বাশার বলেন, ‘আমি এটি বলব না যে, কোনো অভিযোগই সত্য নয়। তবে এর ৮০ ভাগই মিথ্যা।’
মোহাম্মদ আবুল বাশার বলেন, ‘মূলত কিছু এনজিওর যোগসাজশে বিএমইটিকেন্দ্রিক একটি চক্র তৈরি হয়েছে, যারা সহজ-সরল কর্মীদের বা তাদের আত্মীয়স্বজনদের নানাভাবে ম্যানেজ করে মিথ্যা অভিযোগ দায়ের করে থাকে। এর মাধ্যমে তারা এজেন্সিগুলো থেকে টাকা আদায়ের ফন্দি করে।’
আবুল বাশার আরও বলেন, ‘আমাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বিদেশে অবস্থিত বাংলাদেশি দূতাবাসগুলোতে এখন থেকে নতুন চাকরির ডিমান্ড লেটারগুলো ভালোভাবে যাচাই সাপেক্ষে কর্মীর অ্যাটাস্টেশন দেওয়া হবে। এতে প্রতারণা কমবে।’
জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) মহাপরিচালক মো. শহিদুল আলম বলেন, ‘কর্মীর গমনাগমন বাড়ার সঙ্গে হয়তো অভিযোগ বাড়ার সম্পর্ক থাকতে পারে। তবে আমরা বেশি জনবল সম্পৃক্ত করে অভিযোগগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির ওপর জোর দিয়েছি। জেলা কর্মসংস্থান অফিসেও যাতে অভিযোগ দায়ের করা যায়, সে সুযোগ তৈরি করেছি।’
সৌদি আরবের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, ‘সৌদিতে আগে নিয়োগকর্তারা সরাসরি কর্মী নিয়োগ দিত। তবে সম্প্রতি সেখানে আউট সোর্সিং কোম্পানি নিয়োগ দেওয়ায় এ ধরনের সমস্যা বাড়তে পারে।’
এনজিও কর্তৃক ভুয়া অভিযোগ দায়ের হচ্ছে, এমন অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘যেসব অভিযোগ আমরা পাই তার অর্ধেকেরও বেশি প্রমাণিত হচ্ছে। সুতরাং ঢালাওভাবে এনজিও বা কর্মীদের দোষ দেওয়া যাবে না, বরং অনেক সময় কর্মীদের পক্ষে প্রমাণ হাজির করা সম্ভব হয় না।’
যেভাবে নিষ্পত্তি হচ্ছে অভিযোগ : সৌদি আরব প্রবাসী মো. ফরিদ সম্প্রতি একটি রিক্রুটিং এজেন্সির বিরুদ্ধে তার স্ত্রীর মাধ্যমে বিএমইটি-তে অভিযোগ দায়ের করেছেন। বিদেশে যাওয়ার আগে তাকে একটি নির্দিষ্ট চাকরির প্রতিশ্রুতি দেয়া হলেও সেখানে পৌঁছানোর পর তাকে একই নিয়োগকর্তার অধীনে একজন পরিচারকের কাজ দেয়া হয়। কাজটি অনিয়মিত হওয়ায় তিনি বেতনও পান না নিয়মিত। বিএমইটি অফিসে শুনানির পর রিক্রুটিং এজেন্সির প্রতিনিধির উপস্থিতিতে কর্তৃপক্ষ পরবর্তী কার্যক্রমের জন্য দুই সপ্তাহের সময় মঞ্জুর করে। বিএমইটি কর্মকর্তারা এজেন্সিকে পরবর্তী শুনানির সময় কর্মীর ইকামা (ওয়ার্ক পারমিট)সহ সব প্রাসঙ্গিক নথি সরবরাহের নির্দেশ দেন। সৌদি আরবের নিয়োগকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করে সমস্যাটি দ্রুত সমাধানের চেষ্টা করা হবে বলে কর্তৃপক্ষকে আশ্বস্ত করেন সংস্থাটির প্রতিনিধি।
উল্লেখ্য, চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে বিএমইটি সফলভাবে ৪৫৯টি অভিযোগ সমাধান করেছে; এর মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্তদের তাদের ক্ষতিপূরণ হিসেবে ৩.৩৩ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া গত বছর ১,২৪০টি অভিযোগের মধ্যে ৩৩৯টির নিষ্পত্তি হয়, যার ফলে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো থেকে ১.৬০ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ বাবদ আদায় করা হয়।
তবে নিষ্পত্তিকৃত অভিযোগের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম হওয়ার বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হলে বিএমইটির এক কর্মকর্তা বলেন, ‘প্রতিটি অভিযোগের সমাধানের ক্ষেত্রে সময়টা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এ বছর নিষ্পত্তি হওয়া অনেক অভিযোগ আগের বছরগুলোতে দায়ের করা হয়েছিল।’ বিএমইটির প্রচেষ্টার পাশাপাশি ‘অভিবাসী অধিকার ফোরাম’ নামের একটি সংস্থাও তৃণমূল পর্যায়ে বিভিন্ন অভিযোগ নিষ্পত্তিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। সংস্থাটি স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ের ১১৩টি এনজিওর সমন্বয়ে গঠিত একটি নেটওয়ার্ক।
ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য রাইটস অব বাংলাদেশি ইমিগ্রেন্টস (ডব্লিউএআরবিই) ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ সাইফুল হক বলেন, ‘রিক্রুটিং এজেন্সির সঙ্গে যুক্ত নয় এমন অভিযোগগুলো আমরা গ্রাম্য সালিশের মাধ্যমে সমাধানের চেষ্টা করি। যদি সমস্যাটি নিয়োগকারীদের সঙ্গে সম্পর্কিত হয়, তাহলে আমরা সেই অভিযোগ বিএমইটি অফিসে পৌঁছে দেই।’
তিনি বলেন, ‘অনেকে বেশি টাকা দিয়ে বিদেশে যাওয়ার পর যখন কাজ পায় না, তখন ফিরে আসতে বাধ্য হয়। তখন দালালের কাছ থেকে টাকা আদায় করা নিয়ে সমস্যা তৈরি হয়।’
সৈয়দ সাইফুল হক বলেন, ‘সরকারের উচিত সংখ্যায় বেশি কর্মী পাঠানোর চাইতে দক্ষ কর্মী প্রেরণ করা এবং রিক্রুটমেন্ট সিস্টেমে ভিসা বাণিজ্যের বিষয়গুলো তদন্ত করে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া।’ প্রশিক্ষিত ও দক্ষ কর্মীদের শারীরিক নির্যাতনের শিকার হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে। তাই নারী কর্মীদের আরও প্রশিক্ষণ দিয়ে বিদেশে পাঠানো উচিত বলে মন্তব্য করেন সৈয়দ সাইফুল হক।
নয়াশতাব্দী/এমটি
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ