ঢাকা, শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১, ১৭ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

‘সাময়িক সুখের’ বলি নবজাতক!

প্রকাশনার সময়: ০৯ আগস্ট ২০২৩, ০৮:৪০
ছবি : সংগৃহীত

রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় নবজাতক কুড়িয়ে পাওয়ার ঘটনা নতুন নয়। পরিত্যক্ত স্থান, ডাস্টবিন, ড্রেন, ডোবা-নালা, ঝোপ-ঝাড় সর্বত্রই জীবিত অথবা মৃত নবজাতক মিলছে। একের পর এক উদ্ধার হওয়া অজ্ঞাত এসব শিশুর লাশের ৯৯ ভাগই নবজাতক।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জীবিত কিংবা মৃত অবস্থায় নবজাতক উদ্ধার করা হলেও ঘটনায় জড়িতরা বরাবরই থেকে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির অভাবে দিন দিন উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা।

পুলিশ বলছে, এসব ঘটনায় দায়ের করা মামলায় তথ্য প্রমাণের ঘাটতি থাকে। বাদী-বিবাদী না থাকায় আগ্রহ কম থাকে। তাই জড়িতদের অনেক সময় চিহ্নিত করাও সম্ভব হয় না। তারা বলছেন, নারী-পুরুষের অবৈধ মেলামেশার ফলে যে সন্তান জন্ম নিচ্ছে তা সমাজ ও তাদের পরিবার মেনে নেয় না। ফলে জন্মের পরপরই এসব নবজাতকদের ঠাঁই হচ্ছে ডাস্টবিনে।

সাধারণত বিয়েবহির্ভূত সম্পর্ক, স্বামী পরিত্যক্ত কিংবা ধর্ষণ থেকে জন্মানো শিশুগুলোর ক্ষেত্রেই এমন পরিণতি বেশি হচ্ছে বলে জানান অপরাধ বিজ্ঞানীরা। ছেলেশিশু প্রত্যাশা করার পর মেয়েশিশু জন্মানোর কারণেও অনেক পরিবার শিশুদের রাস্তায় ফেলে দিচ্ছে বলে জানান তারা।

গত ২৫ জুলাই ঢাকা নার্সিং কলেজের গেটের পাশ থেকে শপিং ব্যাগের মধ্যে কাপড়ে মোড়ানো অবস্থায় এক দিন বয়সি এক ছেলে নবজাতকের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। এর আগে ১০ জুন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল পাশের রাস্তায় কুকুরের মুখ থেকে এক নবজাতকের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ।

ওই দিন বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে ফুটপাতের কয়েকজন দোকানদার প্রথমে কুকুরের মুখে মরদেহটি দেখতে পায়। পরে পুলিশ মৃতদেহ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে পাঠায়। গত ২৬ মে বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) ক্যাম্পাসের ডাচ্-বাংলা এটিএম বুথের পাশে ডাস্টবিন থেকে কাপড়ে মোড়ানো এক নবজাতকের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।

এসব নবজাতকের লাশ উদ্ধারের প্রতিটি ঘটনায় শাহবাগ থানায় অপমৃত্যুর মামলা হয়েছে। শাহবাগ থানা পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত কেবল ঢাকা মেডিকেল কলেজসংলগ্ন এলাকা থেকে ৯টি নবজাতকের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে।

এসব ঘটনায় দায়ের হওয়া অপমৃত্যুর মামলাগুলো বর্তমানে কী অবস্থায় আছে— এমন প্রশ্নে শাহবাগ থানার ইন্সপেক্টর (তদন্ত) শাহ আলম নয়া শতাব্দীকে বলেন, ‘এসব ঘটনায় দায়ের করা মামলায় তথ্য-প্রমাণের ঘাটতি থাকে। অধিকাংশ ঘটনায় বাদী-বিবাদী না থাকায় মামলার সুরাহা করা যায় না। বেশিরভাগ নবজাতক এমন জায়গায় ফেলা হয়েছে যেখানে কোনো সিসি ক্যামেরা নেই। ফলে পর্যাপ্ত তথ্য-প্রমাণের অভাবে জড়িতদের অনেক সময় চিহ্নিত করা সম্ভব হয় না।’

রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে গত ৪ বছরে ৭১৪টি নবজাতককে পরিত্যক্ত ও মৃত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে। এর মধ্যে গত তিন মাসে উদ্ধার করা হয়েছে ৩৮টি নবজাতকের মরদেহ। সম্প্রতি এমনই এক পরিসংখ্যানমূলক তথ্য দিয়েছে বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরাম।

মূলত দেশের শীর্ষ ১৫টি দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত খবরের ভিত্তিতে তারা এ তথ্য দিয়েছে। এসব ঘটনায় পুলিশ সাধারণ ডায়রির (জিডি) পাশাপাশি অপমৃত্যুর মামলা দায়ের করে ময়নাতদন্তের জন্য পাঠালেও এখন পর্যন্ত সুরাহা মেলেনি কোনো ঘটনার।

শিশু অধিকার ফোরামের শিশু অধিকার পরিস্থিতি ২০২২ প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত বছর রাস্তা/ডাস্টবিন বা ঝোপ থেকে অজ্ঞাতপরিচয়ের ২১৭টি নবজাতক কুড়িয়ে পাওয়া যায়। ২০২১ সালে ফেলে দেয়া বা কুড়িয়ে পাওয়া নবজাতকের সংখ্যা ছিল ১২৬। অর্থাৎ এক বছরে এ ধরনের ঘটনা বেড়েছে ৮৮ শতাংশ। এসব অজ্ঞাতপরিচয়ের শিশুর ৯৯ শতাংশই ছিল নবজাতক (জন্মের পর ২৮ দিন বয়স পর্যন্ত)।

নারী ও মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, সামাজিক অবক্ষয়ের কারণেই বিয়েবহির্ভূত অনেক ধরনের সম্পর্কে জড়িয়ে যাচ্ছে নারী-পুরুষ। ফলে এ নবজাতকদের জন্ম যেমন বেড়ে গেছে, তেমনি বেড়ে গেছে জীবন্ত নবজাতককে ফেলে দিয়ে সব দায় থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার ঘটনা। এতে করে নবজাতকের জন্মদাতা বাবা-মা হয়তো নিষ্কৃতি পাচ্ছেন, কিন্তু ফেলে দেওয়া নবজাতকের কপালে কী ঘটছে?

ময়লার ভাগাড়ে, নালা-নর্দমায়, ব্যাগে বন্দি অবস্থায় রাস্তার পাশে, ঝোপঝাড়, যানবাহন, শৌচাগার থেকে উদ্ধার হওয়া এসব নবজাতকের বেশিরভাগই গুরুতর আহত, নাহয় মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। যেসব শিশু ভাগ্যক্রমে বেঁচে যায়, তাদের স্থান হয় নিঃসন্তান কোনো দম্পতির পরিবারে, না হয় সরকারি শিশু আশ্রয়কেন্দ্রে।

এমনই একটি ঘটনা ঘটে চলতি বছরের ২৫ ফেব্রুয়ারি। এদিন মিরপুর এলাকার রাস্তার পাশে এমনই এক শিশুকে পরিত্যক্ত অবস্থায় পান পেশায় শিক্ষিকা নাফিসা ইসলাম অনন্যা। তারপর বিভিন্ন হাসপাতাল ঘুরে ঘুরে মৃতপ্রায় শিশুটিকে টানা কয়েক মাসের চিকিৎসায় সুস্থ করে তোলেন তিনি। পুলিশকে জানানোর ভিত্তিতে বর্তমানে তিনি শিশুটিকে একটি নিঃসন্তান দম্পতির কাছে দিয়েছেন এবং নিয়মিত খোঁজ রাখছেন।

শিক্ষিকা নাফিসা ইসলাম বলেন, রাতের বেলা হেঁটে যাওয়ার সময়ই বাচ্চার কান্নার শব্দ শুনতে পাই। পরে দেখি রাস্তার পাশে কাপড়ে মোড়ানো ছোট একটা বাচ্চা। আমি কতক্ষণ সেখানে অপেক্ষা করি। দেখি যে, কেউ নেই। পরে বাচ্চাটাকে কোলে নেয়ার পর বুঝলাম— সে শ্বাস নিতে পারছে না।

শিক্ষিকা অনন্যা বলেন, শিশুটির অবস্থা দেখে কোনো হাসপাতালই শুরুতে তাকে ভর্তি করতে চায়নি। পরে অনেক অনুরোধ করে বিভিন্ন হাসপাতাল ঘুরে ঘুরে চিকিৎসা দিয়ে তাকে সুস্থ করে তুলি আমি। এখন সে একটা নিঃসন্তান পরিবারে অনেক যত্নে আছে।

সবার কাছে অনুরোধের সুরে তিনি বলেন, যারা তাদের বাচ্চা-কাচ্চা রাখতে চান না, তারা যদি সুস্থ অবস্থায় বাচ্চাটাকে হাসপাতালে রেখে যায়, মসজিদের সামনে রেখে যায়, কেউ না কেউ তাদের বাঁচাবে। একটা বাচ্চাকে তো তারা মেরে ফেলতে পারে না!

সাধারণত এসব শিশুকে জীবিত বা মৃত অবস্থায় উদ্ধারের পর পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডির ফরেনসিক বিভাগের কাছে শিশুর নমুনা পাঠানো হয়। সেই নমুনার ডিএনএ পরীক্ষা করে শিশুটির প্রোফাইল তৈরি করেন ফরেনসিক বিশেষজ্ঞরা।

যদি কেউ শিশুর মা অথবা বাবা হিসেবে পরিচয় দাবি করে, তাহলে তাদের সঙ্গে সেই শিশুর ডিএনএ প্রোফাইল মেলানোর মাধ্যমে সেটা প্রমাণ করা হয়। কিন্তু এ শিশুদের অধিকাংশকে স্বেচ্ছায় ফেলে যায় তাদের বাবা-মা। এজন্য এর তদন্ত করা বেশ কঠিন হয়ে পড়ে।

জানতে চাইলে সিআইডির ফরেনসিক ল্যাবের বিশেষ পুলিশ সুপার রুমানা আক্তার বলেন, বহির্বিশ্বের মতো বাংলাদেশের সব মানুষের যদি ডিএনএ ডাটাবেজ থাকত, তাহলে সহজেই শিশুর ডিএনএ ওই ডাটাবেজের সঙ্গে মিলিয়ে মা-বাবাকে শনাক্ত করা যেত।

তিনি বলেন, আমাদের যে ডিএনএ ব্যাংক আছে সেখানে শুধু অপরাধীদের প্রোফাইল করা আছে। যেটার পরিসর অনেক সীমিত। যদি এ ডাটাবেজে বাংলাদেশের সব মানুষকে অন্তর্ভুক্ত করা যেত, তাহলে মুহূর্তেই বেরিয়ে আসত এসব শিশুর বাবা-মাকে।

এ বিষয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য সমাজবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. ইফতেখার উদ্দিন বলেন, বাংলাদেশে সরকারিভাবে এসব শিশুর আশ্রয়ের ব্যবস্থা থাকলেও সচেতনতার অভাবে বা পরিচয় ফাঁস হয়ে সামাজিকভাবে হয়রানির মুখে পড়তে পারেন এমন আশঙ্কা থেকে বেশিরভাগই কোনো ঝুঁকি নিতে চান না। আমাদের সামাজিক কাঠামোতে অনেক বড় ধরনের প্রভাব পড়েছে।

বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক বেড়ে গেছে, বিবাহবিচ্ছেদ বেড়েছে, প্রযুক্তির অনেক বড় একটা প্রভাব আছে। জন্মনিয়ন্ত্রণ বা জন্ম নিরোধ বিষয়ে সচেতনতার অভাবও একটা বড় কারণ। এ শিশুদের যে সরকারি ব্যবস্থাপনায় আশ্রয় দেয়া যায়, সেটা জানা না থাকার কারণেও অনেকে এ সবের দিকে ঝুঁকছে। এমন অবস্থায় পারিবারিক বন্ধন ও নৈতিকতার শিক্ষা দৃঢ় করা প্রয়োজন।

তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের আইনানুযায়ী, কোনো শিশু মাতৃগর্ভে ৪ মাস পার করলে শিশুটি পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে গণ্য হয়। এবং জন্ম হওয়ার আগে তার নামে সম্পত্তিও লিখে দেয়া যায়। তাই এ শিশুগুলোকে কারা ফেলে গেছে সেগুলোর সুষ্ঠু তদন্ত হওয়া রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব বলে মনে করেন এ সমাজবিজ্ঞানী।

নয়া শতাব্দী/এমআর

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ