বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় বুয়েটে প্রধান প্রকৌশল কার্যালয়ের বিদ্যুৎ শাখা অগ্রিম গ্রহণ (২০২২-২০২৩) তালিকা অনুযায়ী বিভিন্ন সংস্কার কাজে তিন কোটি ৬২ লাখ ২১ হাজার ২৯৩ টাকা বিল করা হয়েছে। ১৯৭টি কাজের বিপরীতে ১৯৭টি ভাউচারে এ বিল করা হয়েছে।
চেক নম্বরসহ এ বিলের সব তথ্য নয়া শতাব্দীর হাতে রয়েছে। এসব কাজে দেয়া হয়নি কোনো উন্মুক্ত দরপত্র বিজ্ঞাপন। ইচ্ছেমতো অনিয়ম ও স্বেচ্ছাচারিতার মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার জন্যই কোনো উন্মুক্ত দরপত্র আহ্বান করা হয়নি বলে ধারণা সংশ্লিষ্টদের।
১৯৭টি বিলের মধ্যে মাত্র ১০টি বিল করা হয়েছে সিনিয়র ম্যানেজার আলমগীর খুরশেদের (পাওয়ায় জেনারেটর) নামে। বাকি ১৮৭টি বিল বিদ্যুৎ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী রফিকুল ইসলামের নামে। ১০টি ভাউচারে মোট বিল করা হয়েছে ১১ লাখ ৭৮ হাজার ২০০ টাকা। যা সিনিয়র ম্যানেজার আলমগীরের নামে ইস্যু করা হয়েছে।
অপরদিকে ১৮৭টি ভাউচারে ৩ কোটি ৫০ লাখ ৪৩ হাজার ৯৩ টাকা বিল ইস্যু করা হয়েছে বিদ্যুৎ বিভাবের নির্বাহী প্রকৌশলী রফিকুল ইসলামের নামে। ১৮৭টি বিলের মধ্যে ঢাকেশ্বর ও বকশীবাজারে আবাসিক এলাকার ১৬টি বাসার মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ বাবদ প্রায় ২৬ লাখ টাকার বিল করা হয়।
বিষয়টি নিয়ে প্রধান প্রকৌশলীর সন্দেহ হলে তদন্ত করে বুয়েট প্রশাসন। এসব কাজে অনিয়ম পাওয়ায় উপ বিভাগীয় প্রকৌশলী (টেলিকম, লিফট, পি এ সিস্টেম) জান্নাতুল ফেরদৌসকে সতর্কীকরণ এবং হেড ইলেকট্রিশিয়ান মো. শামীম আহমেদকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয়া হয়েছে। তবে নোটিশ আর সতর্ককরণেই আটকে আছে শাস্তি। বরং অনিয়মের পুরস্কার হিসেবে মো. শামিম আহমেদকে হেড ইলেকট্রিশিয়ান থেকে গত ১৮ জুলাই পদোন্নতি দিয়ে ইলেকট্রিক্যাল সুপারভাইজার, প্রধান প্রকৌশলীর কার্যালয় হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে।
এ নিয়ে বুয়েটের সাধারণ কর্মচারীদের মধ্যে ক্ষোভ বিরাজ করছে। তারা বলছেন, অনিয়ম ও দুর্নীতি করায় যেখানে শাস্তি হওয়া উচিত তার পরিবর্তে দেয়া হচ্ছে পদোন্নতি। এ পদোন্নতির ফলে শামিম আরও বেপরোয়া হয়ে উঠবে বলে ধারণা তাদের। একাধিক কর্মচারী অভিযোগ করে বলেন, এসব অনিয়মের সঙ্গে অবশ্যই ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ জড়িত রয়েছে। নাহলে অপরাধ করার পরও পদোন্নতি পাওয়ার কথা নয়।
জানতে চাইলে বিদ্যুৎ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘এখানে কোনো অনিয়ম হয় নাই।’ তাহলে জান্নাতুল ফেরদৌসকে সতর্কীকরণ এবং হেড ইলেকট্রিশিয়ান মো. শামীম আহমেদকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয়া হলো কেন— এমন প্রশ্নের জবাবে রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘অফিশিয়ালি কাজকর্ম করতে গেলে ত্রুটি বিচ্যুতি হলে তাদের শোকজ-সতর্কীকরণ নোটিশ দেয়া হয়। এটা রুটিন ওয়ার্ক। তাহলে অনিয়মের পড়েও মো. শামিমকে পদোন্নতি কেন দেয়া হলো— এমন প্রশ্নে তিনি বলে, এ বিষয়ে আমি কিছু বলতে পারব না। আমাদের কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলেন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, বুয়েটের তদন্ত প্রতিবেদনে উঠে এসছে ২৬/২ নম্বর বাসায় বিভিন্ন ইলেকট্রনিকস পণ্য লাগানো হয়েছে মাত্র ৬৮টি আর ভাউচারে দেখানো হয়েছে ৮৮টি। এ হাউসে বিল করা হয়েছে এক লাখ ৭৬ হাজার ৮৫২ টাকা। যার চেক নম্বর ১৩৪৯৫৯৪। ৪৬/৬ নম্বর বাসায় ইলেকট্রিক পণ্য লাগানো হয়েছে ৩১টি আর দেখানো হয়েছে ৩৮টি। এ হাউসে বিল করা হয়েছে এক লাখ ৭৫ হাজার ৩৩০ টাকা।
যার চেক নম্বর ১৩৪৯৭৩৯। এভাবে ১৬টি বাসায় প্রায় ৯১৬টি পণ্য লাগানো হলেও দেখানো হয়েছে ১২৩৬টি। অর্থাৎ অতিরিক্ত ইলেকট্রনিকস পণ্য দেখানো হয়েছে প্রায় ৩২০টি। এছাড়া বিভিন্ন ইলেকট্রনিকস তার, ক্যাবলও বেশি দেখানো হয়েছে। যার বাজারমূল্য আনুমানিক প্রায় ৬ লাখ টাকা।
এভাবে ২২/২ নম্বর বাসায় বিল করা হয়েছে ২,৩৫,২১৫ টাকা, চেক নম্বর ৬৬৫৫৩৫১। ২৯/৫ নম্বর বাসায় বিল করা হয়েছে ১,৯৯,২১৪ টাকা, চেক নম্বর ১৩৪৯৫৯৩। ২৯/৯ নম্বর বাসায় বিল করা হয়েছে ২,৩৪,৩৭৫ টাকা, চেক নম্বর ৬৬৫৫৩৭৯। ২৮/১ নম্বর বাসায় বিল করা হয়েছে ১,৭৬,৮৫১ টাকা, চেক নম্বর ১৩৪৯৫৯৬। ২৮/৩ নম্বর বাসায় বিল করা হয়েছে ২,৩৪,৮০৫ টাকা, চেক নম্বর ৬৬৫৫৩৮০। ১/বি নম্বর বাসায় বিল করা হয়েছে ১,৭৮,৪১৯ টাকা, চেক নম্বর ১৩৪৯৫৯৭। ৪৫/এইচ নম্বর বাসায় বিল করা হয়েছেন ১,৭০,৪৬৪ টাকা, চেক নম্বর ৬৬৫৫৩৮২। ৪৫/এফ নম্বর বাসায় বিল করা হয়েছে ১,২৮,৪০৬ টাকা, চেক নম্বর ১৩৪৯৬০২। ৩০/৩-ডি বাসায় বিল করা হয়েছে ১,৭৯,৫০৫ টাকা, চেক নম্বর-৬৬৫৫৩৫৭।
৬/বি নম্বর বাসায় বিল করা হয়েছে ১,৭৮,৪২৯ টাকা, চেক নম্বর-১৩৪৯৫৯৮। ৪/জে নম্বর বাসায় বিল করা হয়েছে ২,৩৯,৮১৭ টাকা, চেক নম্বর ৬৬৫৫৪১৫। ২-বি নম্বর বাসায় বিল করা হয়েছে ২৩৫১৯৮ টাকা, যার চেক নম্বর-৬৬৫৫৩৭৮। তদন্ত প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, উপরোক্ত অসংগতি ছাড়াও অনেক পণ্যের ইউনিট মূল্য বাজারমূল্যের চেয়ে বেশি দেখানো হয়েছে।
বুয়েটের কর্মচারীরা ধারণা করছেন, এভাবে ন্যূনতম চার লাখ টাকা ইউনিট মূল্যের চেয়ে বেশি দেখানো হয়েছে। সে হিসাবে মাত্র ২৬ লাখ টাকার কাজেই প্রায় ১০ লাখ টাকার অনিময়! যা শতাংশের হিসেবে দাঁড়ায় ৩৮.৪৬ শতাংশ। প্রায় সাড়ে তিন কোটি টাকার কাজের মধ্যে ২৬ লাখ টাকার কাজেই যদি ১০ লাখ টাকার অনিয়ম হয় তাহলে সাড়ে তিন কোটি টাকার কাজে কী পরিমাণে অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছে যা নিয়ে তদন্তও হয়নি। কোনো ধরনের প্রশ্ন ছাড়াই বিল ছাড় করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন বুয়েটের একাধিক কর্মচারী। পুরো কাজে ৩৮.৪৬ শতাংশ দুর্নীতি বা অনিয়ম ধরলেও প্রায় সাড়ে তিন কোটি টাকার কাজে অনিয়ম করা হয়েছে প্রায় ১ কোটি ৩৪ লাখ ৭৭ হাজার টাকার।
আগাম বিল সম্পর্কে জানতে চাইলে নির্বাহী প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম বলেন, এ টাকা আমার নামে আসে নাই। এই টাকা আমাদের অফিস প্রধান তথা প্রধান প্রকৌশলীর নামে গেছে। কিন্তু তালিকায় আপনার নাম লেখা— এমন প্রশ্নে রফিকুল ইসলাম বলেন, অফিশিয়ালি কাজ করতে গেলে অফিসিয়াল কিছু সিস্টেম আছে। আরও বিস্তারিত জানতে চাইলে আপনি আমাদের কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে আসেন— আমি আপনাকে সব দেখিয়ে দেব। আপাতত কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া আমি কোন কথা বলতে পারব না। তিনি বলেন, সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার অফিশিয়ালি নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।
এছাড়া একই বিভাগের ২১-২২ বছরেও ব্যাপক অনিয়মের ঘটনা ঘটেছে। এ ঘটনায় প্রধান প্রকৌশলীর কার্যালয়ের সহকারী প্রকৌশলী (বিদ্যুৎ) মুহাম্মদ আল আমিনকে অভিযুক্ত করে চার্জশিট দেয়া হয়েছে। চার্জশিটে আলামিনের বিরুদ্ধে শেরে বাংলা হলের কাজ বাবদ ১৭ লাখ ৩৬ হাজার ১৮৫ টাকা এবং তিতুমীর হলের কাজ বাবদ ১৭ লাখ ৫৮ হাজার ৭০০ টাকার আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ আনা হয়।
এছাড়া আরও পাঁচটি অভিযোগ আনা হয় এ সহকারী প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে। যার মধ্যে রয়েছে ১. বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক ছাত্রদের জীবনের ঝুঁকি সৃষ্টি। ২. আর্থিক অনিয়ম ও অস্বচ্ছতা। ৩. বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বার্থবিরোধী অবস্থান। ৪. দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতা ও গাফিলতি। ৫. অসৌজন্যমূলক আচরণ ও অসদাচরণ।
এতসব অভিযোগ থাকা সত্তে দৃষ্টান্তমূলক কোনো শাস্তি দেয়া হয়নি এ সহকারী প্রকোশলীকে। অদৃশ্য কোনো শক্তির বলে এত এত অভিযোগের পড়েও নেয়া হয়নি কোনো শাস্তির ব্যবস্থা। বরং সহকারী প্রকোশলী থেকে প্রেমোশন দিয়ে তাকে উপ বিভাগীয় প্রকৌশলী (বিদ্যুৎ) করা হয়েছে।
জানতে চাইলে বুয়েটের প্রধান প্রকৌশলী একেএম জাহাঙ্গীর আলম নয়া শতাব্দীকে বলেন, সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলা যাবে না। অফিশিয়ালি নিষেধ করা আছে আমাদের। বক্তব্য নিতে উপাচার্যের দপ্তরে গিয়েও উপাচার্যের সঙ্গে দেখা করা সম্ভব হয়নি। পরে একাধিকবার মোবাইল ফোনে কল এবং খুদেবার্তা পাঠানো হলেও তিনি সাড়া দেননি।
নয়া শতাব্দী/এমআর
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ