বুয়েটের কম্পট্রোলার অফিসের কল্যাণ ট্রাস্টের লাখ লাখ টাকা নামে বেনামে তুলে নেয়ার অভিযোগ পায় নয়া শতাব্দী। অনুসন্ধানে অভিযোগের সত্যতাও মেলে। দেখা যায়, বুয়েটের সিনিয়র ক্রাফ্ট ইন্স্ট্রাকটর হাবিবুর রহমান নামের এক ব্যক্তি Coronary Artary disease নামের একটি রোগের জন্য চলতি বছরের ৪ এপ্রিল দুই লাখ ৫০ হাজার টাকা তুলে নেন।
সিনিয়র ক্লিনার সুফিয়া বেগম নামে আরও এক ব্যাক্তি Anal Fissure নামের একটি রোগের কথা বলে একই দিন আরও ৪০ হাজার টাকা তুলে নেন। তবে বুয়েটের একাধিক কর্মচারী নয়া শতাব্দীকে নিশ্চিত করেছেন যে হাবিবুর রহমান এবং সুফিয়া বেগম নামে বুয়েটে কোনো কর্মচারীই নেই।
অনুসন্ধানে নিলুয়ারা বেগম নামে আরও এক ব্যক্তির অস্তিত্ব পাওয়া যায়। যিনি এক এক সময় এক এক সেক্টরে কাজ করেন, এক এক সময় এক এক রূপ ধারণ করেন। এই নিলুয়ারা বেগম অসুস্থতার অজুহাতে বুয়েটের কল্যাণ ট্রাস্ট থেকে হাতিয়ে নিয়েছেন অন্তত কয়েক লাখ টাকা।
নয়া শতাব্দীর হাতে আসা তথ্য প্রমাণ বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, গত ২৪ মার্চ নিলুয়ারা বেগম, পিতা আইয়ুব আলী, বুয়েট আইডি M২০১১৫৩১৮৫, পদবি- ক্লিনার গ্রেড ফোর প্রকৌশল বিভাগ এবং মূল বেতন দেখানো হয় ১৫, ২০০ টাকা উল্লেখ করে চোখের ছানি অপারেশনের জন্য আড়াই লাখ টাকা চেয়ে আবেদন করেন। এরপর ২৭ মার্চ ৫০ হাজার টাকা উপাচার্য অনুমোদন করেন। যার ব্যাংক হিসাব নম্বর ০১০৩৯৪৮৮। এই আবেদনে তার যোগদানের তারিখ দেখানো হয়েছে ০১-০২-২০১১।
একই নিলুয়ারা বেগম আবার গত ১০ এপ্রিল ব্রেন টিউমারের চিকিৎসার জন্য তিন লাখ টাকা চেয়ে আবেদন করেন। এবার পিতার নাম আইয়ুব আলী ও ব্যাংক হিসাব নম্বর ঠিক থাকলেও পরিবর্তন করা হয়েছে বুয়েট আইডি, পদবি ও মূল বেতন। এই আবেদনে উল্লেখ করা হয় নিলুয়ারা বেগম ছাত্রী হলে এমএলএসএস।
বুয়েট আইডি- M২০১৬৬৫২০০ ও মূল বেতন দেখানো হয় ১২০০০ টাকা। এই আবেদনটি উপাচার্য মে মাসের ১৭ তারিখে অনুমোদন করেন। এবার যোগদানের তারিখ দেখানো হয়েছে ১৬-৩-২০১৬। একই নিলুয়ারা বেগম পুনরায় গত ১৮ এপ্রিল বাম কাঁধের সমস্যা দেখিয়ে ২১৪৬০০ টাকা চেয়ে আবেদন করেন।
এবারো নিলুয়ারা বেগমের বাবার নাম ও ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নম্বর ঠিক থাকলেও পরিবর্তন করা হয়েছে বাকি সব তথ্য। এবার নিলুয়ারা বেগমের বুয়েট আইডি দেখানো হয়-M২০১৭৮৫০৮৩, পদবি দেখানো হয়েছে পরিচ্ছন্নতাকর্মী (প্রকৌশল অফিস), মূল বেতন দেখানো হয়েছে ১৪,৪৪০ টাকা। যোগদানের তারিখ দেখানো হয়েছে ৫-১১-২০১৭। এই আবেদনের প্রেক্ষিতে গত ১৭ এপ্রিল উপাচার্য দেড় লাখ টাকা অনুমোদন করেন। কে এই বহুরূপী নিলুয়ারা বেগম?
বুয়েটের তথ্য প্রমাণ বলছে, নিলুয়ারা বেগম নামে আদৌ কোনো কর্মচারী নেই বুয়েটে। তাহলে সাধারণ কর্মচারীদের এই টাকা যাচ্ছে কোথায়? কার টাকা কে নিচ্ছে? কীভাবে নিচ্ছে? কে এই অদৃশ্য নিলুয়ারা বেগম। অনুসন্ধানে হাতে আসে একটি ব্যাংক স্টেটমেন্ট। স্টেটমেন্টে দেখা যায়, নিলুয়ারা অ্যাকাউন্ড থেকে ই-ওয়ালেট এর মাধ্যমে টাকাগুলো অন্য একটি অ্যাকাউন্টে ট্রান্সফার করা হচ্ছে। চলতি বছরের ২৪ এপ্রিল থেকে ৯ মে পর্যন্ত ১২ লাখ ২৮ হাজার ৬৭৪ টাকা ট্রান্সফার করা হয়েছে। বর্তমানে ওই অ্যাকাউন্টে মাত্র ১ হাজার টাকা অবশিষ্ট রয়েছে। অ্যাকাউন্ট নম্বর ৪৪০৪-০০১০২৭৭৬৩।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এই অ্যাকাউন্টটির মালিক বুয়েটের ফান্ড শাখার হিসাবরক্ষক সুরভি আক্তার। উপরে উল্লেখিত অসুস্থতার অজুহাতে হাতানো প্রত্যেকটি বিলেই প্রস্তুতকারক হিসেবে স্বাক্ষর করেছেন এই সুরভি আক্তার। এই সুরভি আক্তারের সঙ্গে নিলুয়ারার কী সম্পর্ক? অদৃশ্য নিলুয়ারার টাকা কেন সুরভির অ্যাকাউন্টে যাচ্ছে? এ বিষয়ে আমরা বিস্তারিত জানতে চাই সুরভির কাছে।
সুরভি প্রথমে স্বীকার করেন- তিনিই এই নিলুয়ারা বেগম। আদৌতে নিলুয়ারা বলতে কেউ নেই। এর সঙ্গে অন্য আরও কেউ জড়িত আছেন কি না এই বিষয়ে জানতে চাইলে সুরভি বলেন, ‘তিনি কম্পট্রোলারের অনুমতি ব্যতিত কিছু বলতে পারবেন না। এরপর এই প্রতিবেদককে তার অফিসে বসিয়ে রেখে তিনি কম্পট্রোলারের সঙ্গে কথা বলতে যান। ফিরে এসে সুরভি নয়া শতাব্দীকে বলেন, ‘এই বিষয়ে তদন্ত চলছে, তার স্যার তাকে মানা করেছেন। তাই এ বিষয়ে তিনি বিস্তারিত কিছু বলতে পারবেন না। বুয়েটের একাধিক কর্মচারী অভিযোগ করে বলেন, এখানে মাত্র কয়েকটা অনিয়মের বিষয় ধরা পড়েছে। তাদের আশঙ্কা এই অনিয়ম আরও হয়েছে।
কর্মচারীরা বলেন, এই ঘটনার সঙ্গে তৎকালীন কম্পট্রোলারএকেএম জসিম উদ্দিন আকন্দ এবং সিনিয়র সহকারী পরিচালক কাজী শরিফুল ইসলাম জড়িত। তাদের ছত্রছায়ায় ফান্ড শাখার সুরভি এসব অনিয়ম করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়েছেন। তারা জড়িত না থাকলে সুরভি এসব কাজ করার সাহস পেত না বলে মনে করেন বুয়েটের একাধিক কর্মচারী। অভিযোগের বিষয় নিয়ে কথা বলতে গেলে কাজি শরিফুল ইসলাম কথা বলতে রাজি হননি।
আর কম্পট্রোলার জসিম উদ্দিন আকন্দকে বিভিন্ন অনিয়মের দায়ে বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠানোয় তাকে তার দপ্তরের পাওয়া যায়নি। জানতে চাইলে বুয়েটের অডিট শাখার এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা নাম না প্রকাশ করার শর্তে নয়া শতাব্দীকে বলেন, এসব অনিয়ম প্রথম আমাদের চোখেই ধরা পড়ে। এরপর আমরা বিষয়টি উপাচার্যকে জানাই। এরপর এই চক্র আমাদের ওপর ক্ষিপ্ত।
এই অফিসার হাউমাউ করে কান্না করে দিয়ে বলেন, ‘এই অপরাধীদের ধরার পর এই সুরভি আমাদের নামে উপাচার্য বরারব শ্লীলতাহানির অভিযোগ দিয়েছে। যা সম্পূর্ণ মিথ্যা ও ভিত্তিহীন।
নয়া শতাব্দী/এমআর
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ