ঢাকা, শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১, ১৭ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

বেতন সমতার ‘বুয়েট’ স্টাইল

প্রকাশনার সময়: ৩১ জুলাই ২০২৩, ০৭:২১

অনিয়মিতভাবে অসম গ্রেডের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বেতন সমতাকরণের ফলে আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) কর্তৃপক্ষ। বেতন সমতাকরণের ফলে বুয়েট কর্তৃপক্ষকে অতিরিক্ত ৫৪ লাখ ১৪ হাজার ৬৯৩ টাকা পরিশোধ করতে হয়েছে। এ সংক্রান্ত একটি গোপন প্রতিবেদন নয়া শতাব্দীর হাতে এসেছে। প্রতিবেদনের সূত্র ধরে অনুসন্ধানে নেমে মিলেছে এর সত্যতা।

অনিয়মের বিবরণ বিষয়ে প্রতিবেদনে লেখা হয়, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকার ২০১৭-১৮ অর্থবছরের হিসাব নিরীক্ষা ১০/০৪/২০১৯ খ্রি. তারিখ হতে ৩০/০৪/২০১৯ খ্রি. তারিখ পর্যন্ত সময়ে সম্পন্ন করা হয়।

নিরীক্ষা কালে নগদান বহি, বেতন রেজিস্ট্রার, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাগণের চাকুরি বহি ও সমতাকরণের বেতন বিল এবং সংশ্লিষ্ট রেকর্ডপত্র নিরীক্ষাকালে দেখা যায় যে, ১৪ জন প্রথম শ্রেণির নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তা যারা প্রাপ্য না হওয়া সত্ত্বেও অনিয়মিতভাবে নিম্ন গ্রেডের পদোন্নতিপ্রাপ্ত কর্মকর্তাগণের (তৃতীয় শ্রেণিতে নিয়োগপ্রাপ্ত) সঙ্গে বেতন সমতা করে বেতন গ্রহণ করায় বেতন ভাতা বাবদ ৫৪,১৪,৬৯৩/-টাকা অতিরিক্ত পরিশোধ করা হয়েছে।

কিন্তু অর্থ মন্ত্রণালয়ের আদেশ অনুযায়ী প্রথম শ্রেণির পদে পদোন্নতিপ্রাপ্ত কর্মকর্তার সঙ্গে সরাসরি নিয়োগপ্রাপ্ত প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তার বেতন স্কেল সমতা করা যায় না। তবে বুয়েট কর্তৃপক্ষ অর্থ মন্ত্রণালয়ের এই আদেশকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদনক্রমে বেতন সমতা করা হয়েছে। ওই গোপন নথিতে লেখা রয়েছে- এই বিষয়টিতে উপাচার্যের অনুমোদন নাই।

তবে বুয়েটের কম্পট্রলার অফিসের একাধিক কর্মকর্তা নয়া শতাব্দীকে জানিয়েছেন, উপাচার্যের অনুমতি ব্যতিত এভাবে টাকা হাতিয়ে নেয়া সম্ভব নয়। তারা বলছেন, হয়তো উপাচার্যকে তারা কোনোভাবে ম্যানেজ করে স্বাক্ষর নিয়েছেন। এ বিষয়ে কথা বলতে উপাচার্যের দপ্তরে গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করা সম্ভব হয়নি। পরবর্তীতে তাকে একাধিকবার মোবাইল ফোনে কল এবং ক্ষুদেবার্তা পাঠিয়েও সদুত্তর পাওয়া যায়নি।

অনুসন্ধানে জানা যায়, মো. মোসাদ্দেক হোসেন ২০০৬ সালের মে মাসের ২৭ তারিখে একাউন্টস অফিসার হিসেবে বুয়েটে যোগদান করেন। ২০১১ সালের মে মাসের ২৭ তারিখ তিনি পদোন্নতি পেয়ে সহকারী পরিচালক (বিআরটিসি) হয়েছেন। তার বর্তমান গ্রেড-৭। অন্যদিকে তিনি বেতন সমতা করেছে মো. কেরামত আলীর সঙ্গে।

কেরামত আলী ১৯৮২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ৮ তারিখ বুয়েটে যোগদান করেন হিসাব সহকারী হিসেবে। এরপর ২০১১ সালের মার্চ মাসের ২ তারিখে তিনি পদোন্নতি পেয়ে হন সিনিয়র সহকারী পরিচালক। মো. মোসাদ্দেকের মোট বেতন ছিল ৪৫,৩৩০ টাকা। মো. কেরামতের সঙ্গে সমন্বয় করে তার বেতন বৃদ্ধি করা হয়েছে ১০,৭০০ টাকা, বাড়িভাড়া বৃদ্ধি ৫,৩৫০ টাকা।

মোট বৃদ্ধি করা হয়েছে ১৬,০৫০ টাকা। আর মোট বৃদ্ধি বাবদ তিনি ২০১৮ সালের জুন মাস পর্যন্ত বকেয়া নিয়েছেন ৫ লাখ ৫৪ হাজার ৯৬৩ টাকা। যা সম্পূর্ণ নিয়ম বহির্ভূত। এ ছাড়াও কম্পট্রলার অফিসের সিনিয়র সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান বেতন সমতা করেছেন সিনিয়র সহকারী পরিচালক মো. শাজাহান কবিরের সঙ্গে। মনিরুজ্জামানের মোট বেতন বৃদ্ধি পেয়েছে ১০,৮৯০ টাকা।

তিনি বকেয়া বাবদ বুয়েট থেকে হাতিয়েছেন ৪ লাখ ৭ হাজার ৩১২ টাকা। কম্পট্রলার অফিসের উপ কম্পট্রলার সজিবুর রহমান বেতন সমতা করেছেন ডেপুটি রেজিস্ট্রার মো. সোহরাব হোসেনের সঙ্গে। বাড়ি ভাড়াসহ তার বেতন বৃদ্ধি পেয়েছে ১৮,৩১৫ টাকা। তিনি বুয়েট থেকে বকেয়া বাবদ হাতিয়েছেন পাঁচ লাখ ৬৫ হাজার ৩৮৪ টাকা।

সিনিয়র সহকারী পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মিসেস ফাতেমা ইয়াসমিন বেতন সমতা করেছেন সিনিয়র সহকারী রেজিস্ট্রার মো. আকমল হোসেনের সঙ্গে। ফাতেমা ইয়াসমিনের বেতন বৃদ্ধি পেয়েছে ১৬০৫০ টাকা। তিনি বুয়েট থেকে হাতিয়েছেন ৫ লাখ ৭৪ হাজার ২৫০ টাকা।

কম্পট্রলার অফিসের সহকারী পরিচালক শরীফুল ইসলাম বেতন সমতা করেছেন সিনিয়র সহকারী পরিচালক মো. শফিকুল ইসলামের সঙ্গে। শরিফুলের সর্বমোট বেতন বৃদ্ধি পেয়েছে ২৭৯০ টাকা। তিনি বুয়েট থেকে হাতিয়েছেন ৭০,৮৬২ টাকা। কম্পট্রলার অফিসের সহকারী পরিচালক মো. নজরুল ইসলাম বেতন সমতা করেছেন সহকারী রেজিস্ট্রার আবুল কাসেমের সঙ্গে। তার মোট বেতন বৃদ্ধি পেয়েছে ৮,৭৯০ টাকা।

তিনি বুয়েট থেকে হাতিয়েছেন ২,৩৩,৭৭৪ টাকা। কম্পট্রলার অফিসে সহকারী পরিচালক রফিকুল ইসলাম বেতন সমতা করেছেন সিনিয়র সহকারী রেজিস্ট্রার মো. মনিরুজ্জামান মোল্লার সঙ্গে। তার বেতন বৃদ্ধি করা হয়েছে ২২,৩৮৮০ টাকা। তিনি বুয়েট থেকে বেতন সমতার নামে হাতিয়েছেন ৭,৪৯,৫৬৯ টাকা।

ইঞ্জিনিয়ারিং অফিসের সিনিয়র সহকারী পরিচালক কাজী শামসুল হক বেতন সমতা করেছেন মো. জাহাঙ্গীর মিঞার সঙ্গে। তার বেতন বৃদ্ধি করা হয়েছে ৩৪৬৫ টাকা। তিনি বুয়েট থেকে হাতিয়েছেন ১,১৭,৭৩২ টাকা। ডিএসডব্লিউ অফিসের সিনিয়র সহকারী পরিচালক অরুনাংশু বড়ুয়া বেতন সমতা করেছেন হিসাব সহকারী মো. মনিরুজ্জামান মোল্লার সঙ্গে। তার বেতন বৃদ্ধি পেয়েছে ৭৯৯৫ টাকা।

তিনি বুয়েট থেকে তুলে নিয়েছেন ২,৫৯,৮৪০ টাকা। আরইজি অফিসের এআর সুলতান উদ্দিন আহমেদ বেতন সমতা করেছেন সহকারী রেজিস্ট্রার ছবির আহমেদের সঙ্গে। তার বেতন বৃদ্ধি পেয়েছে ২৭৯০ টাকা। তিনি বুয়েট থেকে হাতিয়েছেন ৭০৮৬০ টাকা। ডিএইআরএস অফিসের ডিডি ড. মো. সেলিম কায়সার বেতন সমতা করেছেন কম্পিউটার অপারেটর মো. সোহরাব উদ্দিনের সঙ্গে। তার বেতন বৃদ্ধি পেয়েছে ১০৯৮০ টাকা। তিনি বুয়েট থেকে হাতিয়েছেন ৪৩৯৫১৮ টাকা। ডিএইআরএস অফিসের ডিডি এম নুর নবীউল আহসান বেতন সমতা করেছেন ডেপুটি রেজিস্ট্রার এ কে এম ছিদ্দিকুর রহমানের সঙ্গে। তার বেতন বৃদ্ধি পেয়েছে ৩৪২০ টাকা।

তিনি হাতিয়েছেন ১৩৯৭৩২ টাকা। আইআইসিটি অফিসের সিস্টেম অ্যানালাইসিস জয়দেব কুমার সিনা বেতন সমতা করেছেন সিনিয়র টেকনিক্যাল অফিসার আব্দুল মান্নানের সঙ্গে। তার বেতন বৃদ্ধি পেয়েছে ১৪,৮৫০ টাকা। তিনি বুয়েট থেকে হাতিয়েছেন ৫৬৩ ০৫৯ টাকা।

আরইজি অফিসের সিসটেম অ্যানালাইসিস রাকিব আহমেদ বেতন সমতা করেছেন সিনিয়র টেকনিক্যাল অফিসার আব্দুল মান্নানের সঙ্গে। তার বেতন বৃদ্ধি পেয়েছে ১৮১৬৫ টাকা। তিনি বুয়েট থেকে হাতিয়েছেন ৬৬৭৮৩৫ টাকা।

এসব বিষয়ে বক্তব্য জানতে যোগাযোগ করা হয় বুয়েটের অডিট শাখার অ্যাকাউন্টস অফিসার মো. নাজিমের সঙ্গে। তিনি কথা বলতে রাজি হননি। নাজিম বলেন, ‘আমি এখানে নতুন জয়েন করেছি। আমার জয়েন করার আগেই এই ঘটনা ঘটে গেছে। আমি এই বিষয়ে কথা বলব না। তাছাড়া বিষয়টি নিয়ে তদন্ত হচ্ছে। এরপর অডিট শাখার এক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে কথা বলতে রাজি হন।

তিনি অনুরোধ করে বলেন, ‘এই অনিয়মের বিষয়টি প্রথমে আমরাই ধরি। এটি ধরে আমরা বিপাকে আছি। আমাদের হুমকি-ধমকি দেয়া হচ্ছে। তারা তো সংঘবদ্ধ। তবে তিনি বলেন, ‘গত ১৩ তারিখের মিটিংয়ে অডিট শাখা থেকে বিষয়টি পুনরায় তুলে ধরা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এটা নিয়ে কাজ করছে।

তিনি আরও বলেন, ‘এখানে তো মাত্র কয় টাকা। এরপর আরও সাত-আট কোটি টাকার বিল জমা দিয়েছেন তারা। যেটি আমরা আটকিয়েছি। এরপর থেকে তারা আমাদের ওপর আরও ক্ষিপ্ত। নারী দিয়ে আমাদের চরিত্র হননেরও চেষ্টা করা হচ্ছে।’

এই কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘আপনারা বিষয়টি নিয়ে কম্পট্রলার স্যারের সঙ্গে কথা বলেন। তিনি অনুমতি দিলে আমরা কথা বলতে পারব। আমাদেরকে গণমাধ্যমকে কথা না বলার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে নোটিশ দেয়া হয়েছে।

এরপর কম্পট্রলারের সঙ্গে কথা বলতে তার অফিসে গিয়ে তার সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি। সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে মাত্র ৫ মিনিট কথা বলার জন্য কম্পট্রলারের সহকারীকে দিয়ে দুইবার রিকোয়েস্ট পাঠালেও তিনি কথা বলতে রাজি হননি।

নয়া শতাব্দী/এমআর

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ