ঢাকা, রোববার, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৭ আশ্বিন ১৪৩১, ১৮ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

চার দেশ রাজনীতির কেন্দ্রে

প্রকাশনার সময়: ০৫ জুলাই ২০২৩, ০৮:৪৬

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সৃষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করতে তৎপর আন্তর্জাতিক মহল। দেশের সাধারণ জনগণের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে বিদেশি কূটনীতিকরা। কোন পদ্ধতিতে দেশের নির্বাচন হবে— এটাই এখন টপ অফ দ্যা কান্ট্রি। নির্বাচন বাংলাদেশে হলেও মূল চালিকাশক্তি বিদেশিদের হাতে। ২০০৬ সালের মতোই এবারও আগেভাগেই ভোট ইস্যুতে মাঠে নেমে পড়েছেন তারা।

দফায় দফায় বৈঠক করছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও মাঠের প্রধান বিরোধী দল বিএনপির সঙ্গে। রাষ্ট্রদূতদের ভূমিকা নিয়েও কথা বলছেন বড় দুই রাজনৈতিক দল। তবে রাজনৈতিক দলগুলোর আলোচনা নিয়ে কম আগ্রহ জনগণের। চায়ের টেবিলে থেকে শুরু করে রাজনৈতিক মহলে সর্বত্র আলোচনা বিশ্বের চার পরাশক্তি দেশ বাংলাদেশের পরবর্তী সংসদ নির্বাচন প্রশ্নের তাদের অবস্থা কী? এ আলোচনার শীর্ষে আমেরিকা।

এরপর চীন, ভারত ও রাশিয়া। পাশাপাশি পশ্চিমা দেশগুলোর আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে বাংলাদেশের রাজনীতির ইস্যু। ভোট বাংলাদেশে হলেও সামনে দিন যতই এগোবে ততই স্পষ্ট হবে— নির্বাচন ইস্যুতে এ চার দেশের উদ্দেশ্য ও গতিপথ। এমনটিই মনে করেছেন দেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।

তাদের মতে, বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন সামনে রেখে প্রকাশ্য মুখ খুলেছে আমেরিকা। অপরদিকে আমেরিকার তৎপরতাকে ইঙ্গিত করে মুখ খুলেছে চীন ও রাশিয়া। তবে ভারত এখনও নীরব। আবার রাশিয়ায় ভাগনা সেনাদের বিদ্রোহের মাধ্যমে তাদের নতুন মেসেজও দিয়েছে আমেরিকা।

নরেন্দ্র মোদির আমেরিকার সফরকালে ভারতকেও সর্তকবার্তা দিয়েছে বাইডেন প্রশাসন। বাংলাদেশের নির্বাচন ইস্যুতে আমেরিকা না চীন-রাশিয়া বলয়ে যোগ দেবে ভারত তার ওপর নির্ভর করে দৃশ্যমান সবকিছু। বাংলাদেশের রাজনীতিতে ঘটতে পারে নতুন মেরুকরণ।

আর সাধারণ জনগণ মনে করছে, বর্তমান রাজনৈতিক সংকট সমাধানে উদ্যোগ নেবে না রাজনৈতিক দলগুলো। তাই যদি বিদেশি চাপে বড় দুই দলের মধ্যে সমঝোতা হয়। সরকার বা বিরোধী সব রাজনৈতিক দলই তাদের মতো করে বিদেশিদের সমর্থন নিতে চাইছে এবং ক্ষমতার মসনদে বসা। বাংলাদেশের আগ্রহের কারণেই বর্তমানে বিদেশিরাও কথা বলছে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা আরও বলছেন, ভূরাজনীতির কারণে আগামী নির্বাচন ঘিরে বাংলাদেশকে কাছে টানার প্রতিযোগিতা চলছে বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলোর মধ্যে। ইতোমধ্যে ভূ-রাজনীতির খেলোয়াড়রা মাঠে নেমে পড়েছে। তবে আমেরিকার স্যাংশন ও নতুন মার্কিন ভিসানীতি নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচনে সহায়ক হবে।

এতে সরকার, বিরোধী দল ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ সংশ্লিষ্ট সবাই নড়েচড়ে বসেছেন। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয় দলই আবার ভিসা নীতির পক্ষে কথা বলছে। কিন্তু সব পক্ষই কিছুটা সহনশীল।

জানতে চাইলে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, বাংলাদেশের রাজনীতি ও আগামী নির্বাচন নিয়ে বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা নিয়েই কথা হচ্ছে বেশি। কারণ বাইডেন প্রশাসন গণতন্ত্র এবং মানবাধিকার নিয়ে তাদের অবস্থান বার বার স্পষ্ট করছে। বাংলাদেশে তারা সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন দেখতে চায়। এজন্য তারা সক্রিয় আছে। তবে রাজনৈতিক সমাধানে দেশের বড় দুই দলকেই প্রথমে এগিয়ে আসতে হবে।

আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের ব্যাপারে ভারতের ভূমিকা সবার জানা। আর চীন হচ্ছে তার ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান থেকে কথা বলে। ইউরোপ এবং যুক্তরাজ্যের কথায় মার্কিন নীতির প্রতিফলন আছে। তারাও বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচন চায়। দেশের মানুষ একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন চায়। দেশের সরকার, রাজনৈতিক দল সেই প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হচ্ছে। তাই স্বাভাবিক কারণেই মানুষ বিদেশিদের তৎপরতা নিয়ে আগ্রহী। আর রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতা ধরে রাখা এবং ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য বিদেশিদের সঙ্গে সব সময়ই যোগাযোগ রাখে— যা লজ্জার।

বিশিষ্ট রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও আইনজ্ঞ ড. শাহ্দীন মালিক বলেছেন, সুষ্ঠু নির্বাচনে বিদেশিদের চাপ অবশ্যই সহায়ক হিসেবে কাজ করবে। অনেক সময় বিদেশিদের চাপে সরকারের নীতি পরিবর্তনে বাধ্য করতে পারে। বর্তমান বিশ্বে দ্বিপক্ষীয় অর্থনৈতিক ও বাণিজ্য সম্পর্ক বজায় রাখতে পরস্পরের শর্ত অনেক সময় অনিচ্ছা সত্ত্বেও মানতে হয়। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তার ব্যত্যয় হওয়ার সুযোগ নেই। এ ক্ষেত্রে বিরোধী দল বিএনপিও এর সুফল পেতে পারে। তবে তাদের মাঠের শক্তিও দেখাতে হবে।

সূত্রমতে, নির্বাচনকে সামনে রেখে এরই মধ্যে রাজনীতির মাঠে নতুন এসেছে সেন্টমার্টিন দ্বীপ। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, সেন্টমার্টিন লিজ দিলে ক্ষমতায় থাকতে অসুবিধা নেই। দেশের কোনো সম্পদ বিদেশিদের দিয়ে ক্ষমতায় থাকতে চান না তিনি। যদিও আমেরিকা দূতাবাস পক্ষ থেকে বলা হয়েছে এ ধরনের কোনো কথাই তারা কখনোই বলেননি। আর বিএনপি বলছে, এটা সরকারের রাজনৈতিক কৌশল। বিএনপি দেশের স্বার্থ কখনো বিক্রি করেনি এবং স্বার্থবিরোধী চুক্তিও করেনি এবং ভবিষ্যতেও করবে না।

জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন বলেন, এর নানা ধরনের লেন্স আছে। একটি হলো বাংলাদেশের গুরুত্ব বেড়েছে। এর ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব বেড়েছে। ফলে অনেক দেশেরই বাংলাদেশ নিয়ে আগ্রহ আছে।

আবার বাংলাদেশে বিভিন্ন সময় যারা ক্ষমতায় ছিলেন তারা দেশের জনগণকে গুরুত্ব দেননি। ফলে এখন সেটা হচ্ছে বিদেশিরা কথা বলছেন, দেশের মানুষ শুনছেন। রাজনৈতিক দলগুলোও বিদেশমুখী হচ্ছে। তাদের কাছে সাধারণ মানুষ গুরুত্ব না পাওয়ায় ও তাদের প্রত্যাশা পূরণ না হওয়ায় এ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, দেশের সাধারণ মানুষেরও যতটা তৎপর বা প্রতিবাদী হওয়া প্রয়োজন ততটা হচ্ছে না। তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেই কথা বলছে কেউ কেউ। ফলে সব দিকেই একটা প্রবণতা বাইরে থেকে কেউ কিছু একটা করে দেবেন।

জানতে চাইলে বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স বলেন, গণতন্ত্র, নির্বাচন ও মানবাধিকারের বিষয়গুলো বিশ্বব্যাপী এবং সার্বজনীন। বিদেশিরা এগুলো নিয়ে তো কথা বলবেই। আমেরিকা তো বলছেই যে তারা এ বিষয়গুলো এখন ফোকাস করছে। তারা তো নির্বাচন, গণতন্ত্র, মানবাধিকার এ বিষয়গুলো নিয়েই কথা বলছে। এর বাইরে অন্য কোনো উদ্দেশ্য তো আমরা দেখছি না। বরং প্রধানমন্ত্রী অযাচিতভাবে সেন্টমার্টিন ইস্যু টেনে এনে যে কথা বলছেন এর পক্ষে তো আমরা কোনো তথ্য প্রমাণ দেখছি না। এটা রাজনৈতিক অপকৌশল।

তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ অনৈতিকভাবে ক্ষমতা ধরে রাখতে এবং আবারও একটি সাজানো, পাতানো ও ষড়যন্ত্রের নির্বাচন করতে গিয়ে বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক খেলার মাঠ বানিয়েছে। এটা ব্যাটেল ফিল্ডে পরিণত হয়ে যেতে পারে। আমাদের আশঙ্কা বাংলাদেশ এ ব্যাটেল ফিল্ডে না আবার ক্রসফায়ারে পড়ে যায়। এর জন্য দায়ী বর্তমান সরকার। নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন ছাড়া এ পরিস্থিতি থেকে বের হয়ে আসার আর কোনো পথ নেই।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও আন্তর্জাতিক উইংয়ের প্রধান আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, বিশ্বের গণতান্ত্রিক বড় দেশ ও সংস্থাগুলো সব সময়ই মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের পক্ষে কথা বলে আসছে। বাংলাদেশের বিগত দুটি নির্বাচনের চিত্র দেখে আগামী নির্বাচন সম্পর্কে তারা আগাম সতর্কবার্তা দিচ্ছে। বিষয়টি নির্যাতিত ও ভোটাধিকার হারা মানুষ ইতিবাচক হিসেবে নিয়েছে। বিএনপি গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। সামনে দেশের মানুষকে সম্পৃক্ত করে রাজপথেই সব ফয়সালা হবে বলেও জানান। অন্যদিকে, বিদেশিদের এসব তৎপরতাকে প্রকাশ্যে ‘আমলে’ নিচ্ছে না ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। তবে পর্দার আড়ালে ভিন্ন চিত্র। নানামুখী কূটনৈতিক তৎপরতা, লবিস্ট নিয়োগ ও বাণিজ্যিক সুযোগ-সুবিধা দিয়ে আস্থা অর্জনের চেষ্টা করছে দলটি।

আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এসএম কামাল হোসেন মনে করেন, দেশের সাধারণ মানুষও যে বিদেশিদের কথা ও ভূমিকা নিয়ে আগ্রহ দেখাচ্ছে এটা ইতিবাচক। তারা বিদেশিদের কথা বুঝতে চায়, তথ্য চায়। জানতে চায় তারা যা বলছে তা সঠিক কিনা।

মানুষ সচেতন হচ্ছে। আর বাংলাদেশ ভূ-রাজনৈতিক দিক দিয়ে একটি গুরত্বপূর্ণ দেশ। এ কারণে অনেকেই বাংলাদেশকে নিয়ে কথা বলছে, ভাবছে। তিনি বলেন, যেসব রাজনৈতিক দল দেউলিয়া তারাই বিদেশিদের কাছে যায়, ধরনা দেয়। আওয়ামী লীগ যায় না। আমরা বিদেশিদের সঙ্গে কথা বলি, ধরনা দিই না।

নয়া শতাব্দী/এমআর

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ