ঢাকা, রোববার, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৭ আশ্বিন ১৪৩১, ১৮ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

সবজি রপ্তানিতে ধস

প্রকাশনার সময়: ১৩ জুন ২০২৩, ০৯:৪৩
ছবি : সংগৃহীত

চট্টগ্রামের শাহ আমানত বিমানবন্দর থেকে কার্গো ফ্লাইট অনিয়মিত হয়ে যাওয়ার কারণে চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে শাকসবজি তথা কৃষিপণ্য রপ্তানি ভয়াবহভাবে কমে গেছে। সংশ্লিষ্টদের দাবি, সমুদ্রপথে ‘ইউ ব্যাগেজ’ চালু হওয়ার কারণে কার্গো ফ্লাইট বন্ধের পথে।

এ কারণে চট্টগ্রামের শাহ আমানত বিমানবন্দর দিয়ে সবজি রপ্তানি এক প্রকার বন্ধ। একই পরিস্থিতি সিলেট ওসমানী বিমানবন্দরেও। রপ্তানিকারকদের দাবি, ফিরতি কার্গো ফ্লাইটে তারা কম টাকায় সবজি রপ্তানি করত। এখন তাদের দ্বিগুণ খরচে রপ্তানি করতে হচ্ছে। এ কারণে রপ্তানি কমে গেছে। ফলে মোটা অঙ্কের রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যানুযায়ী, ২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম সাত মাস জুলাই-জানুয়ারিতে ৩ কোটি ৪৮ লাখ ডলারের শাকসবজি রপ্তানি হয়েছে। গত অর্থবছরের একই সময়ে রপ্তানি হয়েছিল ৫ কোটি ৯৫ লাখ ডলারের পণ্য। তার মানে চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে রপ্তানি কমেছে ৪১ দশমিক ৪৫ শতাংশ।

মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপীয় বাজারে ফল ও শাকসবজির এয়ার-শিপিং থেকে মাত্র ১৫ মিলিয়ন ডলার এসেছে ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম ৪ মাসে। গত অর্থবছরের একই সময়ে এই আয় হয়েছিল ৩৮ মিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ, রপ্তানি আয় কমেছে ৬০ শতাংশ।

জানা গেছে, প্রতি সপ্তাহে শাহ আমানত বিমানবন্দরে দুটি কার্গো ফ্লাইট নামত। ফিরতি পথে মধ্যপ্রাচ্যের দেশে রপ্তানির পণ্য নিয়ে যেতো। কিন্তু চোরচালান চক্রের কবলে পড়ে বর্তমানে কোনো কার্গো ফ্লাইটই নামছে না চট্টগ্রামের শাহ আমানত বিমানবন্দরে। ২০১৬ সালে বিদেশি ‘এমিরেটস এয়ারলাইনস’ ঘোষণা না দিয়েই চট্টগ্রাম থেকে পণ্য পরিবহন বন্ধ করে দেয়।

এরপর থেকে শুধু ‘ইতিহাদ এয়ারওয়েজ’ চট্টগ্রাম থেকে সরাসরি পণ্য পরিবহন করছে। কিন্তু সেই বিমান সংস্থার সপ্তাহে দুটি শিডিউল ফ্লাইট থাকলেও পণ্য প্রাপ্তির ওপর নির্ভর করে ফ্লাইট চালায়। কখনো সপ্তাহে একটি আবার কখনো দুটি। গত বছরের নভেম্বর মাস থেকে প্রবাসীদের আনা কার্গো খালাস করতে গড়িমসি করার কারণে বর্তমানে প্রায় পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে চট্টগ্রাম থেকে সবজি রপ্তানির রুট।

চট্টগ্রাম কাস্টমস কমিশনারের একগুঁয়েমি সিদ্ধান্তের কারণে চট্টগ্রাম বিমানবন্দরের সুযোগ-সুবিধা কাজে লাগিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে বিপুল পণ্য আমদানি ও রপ্তানির সুযোগ থাকলেও সেই সম্ভাবনা হাতছাড়া হচ্ছে।

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যমতে, কৃষিপণ্যের রপ্তানি ১ বিলিয়ন ডলারে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্য থাকলেও গত নয় মাসে রপ্তানি হয়েছে মাত্র ৬৮৭ মিলিয়ন ডলার। যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৩২.৩৭ শতাংশ কম। বাংলাদেশ থেকে প্রতিদিনই কাঁচামরিচ থেকে শুরু করে লাউ, কুমড়া, বেগুন, ঢেঁড়স, পেঁপে, চিচিঙ্গা, কাঁকরোল, বরবটি, শিম, টমেটোসহ বিভিন্ন ধরনের শাকসবজি বিশ্বের অনেকগুলো দেশে রপ্তানি হচ্ছে। তবে রপ্তানির পরিমাণ দিন দিন কমছে।

তিন বছর আগেও বছরে ১৬ কোটি ডলারের সবজি রপ্তানি হতো। এরপর থেকেই ধারাবাহিকভাবে রপ্তানি কমতে থাকে। জাতিসংঘের কৃষি ও খাদ্য সংস্থার তথ্য অনুসারে, সবজি উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের তৃতীয়। গত তিন অর্থবছরজুড়ে অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি রপ্তানি খাতেও শক্তিশালী অবস্থান পেয়েছে সবজি।

সূত্র মতে, চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে দীর্ঘ আট মাসের বেশি সময় কার্গো খালাস বন্ধ রেখে জাহাজে আসা ‘ইউ ব্যাগেজ’ সুবিধার অপব্যবহার করে রাষ্ট্রের কোটি কোটি লোপাট করছে একটি চক্র। টিআর সুবিধার অপব্যবহার করে জাহাজে করে আনা হচ্ছে বাণিজ্যিক পণ্য। ‘ইউ ব্যাগেজ’ প্রক্রিয়া জনপ্রিয় করতে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে প্রবাসীদের ব্যাগেজ সুবিধায় আনা কার্গো খালাস। শুধু তাই নয় ইউ ব্যাগেজকে একচেটিয়া সুবিধা দিতে কার্গো বিমানের ফ্লাইটও বন্ধ রাখা হয়েছে।

গত ২ মার্চ থেকে চট্টগ্রাম কাস্টম কর্তৃপক্ষ কোন লিখিত ঘোষণা ছাড়াই কার্গো খালাস বন্ধ করে দিয়েছে। ফলে রমজান এবং ঈদকে কেন্দ্র করে পরিবারের সদস্যদের জন্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী পাঠালেও কাস্টম খালাস করায় প্রবাসীরা সেগুলো খালাস নিতে পারেনি। এর ফলে গত মার্চ পর্যন্ত বিমানবন্দরের কার্গো হলে জমে আছে অন্তত ৯০টি চালান। এতে পণ্য আছে প্রায় ২৫ মেট্রিক টন।

পণ্য ছাড় বন্ধ থাকার কারণে প্রবাসীরা তাদের কার্গো মালামাল ছাড় করতে পারেনি। উল্টো ১০ মার্চ সহকারী কাস্টমস কমিশনার আহসান উল্লাহ স্বাক্ষরিত একটি চিঠিতে আটকা পড়া এসব পণ্য নিলামে তোলার চিঠি দেয়া হয়েছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, চট্টগ্রাম কাস্টমস কর্তৃপক্ষের চাঞ্চল্যকর ঘুষ বাণিজ্যের তথ্য। সাধারণত দুবাইসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশেগুলোতে বসবাস করা প্রবাসীরা দেশে আসার সময় প্রয়োজনীয় শুল্ক পরিশোধ করে কার্গো করে পারিবারিক ব্যবহারের পণ্য নিয়ে আসত। একই সুবিধা জাহাজেও প্রচলিত ছিল, তবে সেটি ততটা পরিচিত ছিল না। জাহাজে করে ইউ ব্যাগেজে জনপ্রতি এক হাজার কেজি পণ্য বুকিং করা সুযোগ রয়েছে। কিন্তু এ প্রক্রিয়ার বুকিং করা পণ্য দেশে আসতে এয়ার কার্গোর চেয়ে তিনগুণ বেশি সময় লাগে।

প্রবাসীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দীর্ঘ ছয় মাসের বেশি সময় ধরে চট্টগ্রামের শাহ আমানত বিমানবন্দরে এয়ার কার্গো ফ্লাইট ও কার্গো খালাস বন্ধ থাকার কারণে বাধ্য হয়েই ইউব্যাগেজ ব্যবসায়ীদের দ্বারস্থ হতে হচ্ছে। সেই ব্যবসায়ীরা প্রবাসীদের পাসপোর্ট ব্যবহার করে অতিরিক্ত স্পসে বাণিজ্যিক পণ্য বুকিং করছেন।

ফলে ইউ ব্যাগেজে করে বাণিজ্যিক শুল্ক পরিশোধ ছাড়াই দেশের বাজারে ঢুকছে গুঁড়া দুধসহ উচ্চশুল্কের পণ্য। মধ্যপ্রাচ্যে প্রবাসী আবুল হাসেম জানান, এয়ারকার্গোতে করে প্রবাসী বাংলাদেশিরা জনপ্রতি একশ থেকে তিনশ কেজি পর্যন্ত পণ্য দেশে নিয়ে আসত। কিন্তু ইউব্যাগেজে বুকিং করার মতো এতবেশি পণ্য (এক হাজার কেজি) তাদের থাকে না। প্রবাসীদের নিয়ে আসা প্রায় পঁচিশ হাজার কেজি কার্গো পণ্য চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে আটকে দেবার কারণে সবাই ইউব্যাগেজ চক্রের ফাঁদে বন্দি। সময় বেশি লাগলেও তুলনামূলক কম খরচে ইউব্যাগেজে পণ্য আনা যায়। মূলত প্রবাসীদের মালামাল আনা কার্গো ফ্লাইটে ফিরতির সময় কম খরচে সবজি পরিবহন করত।

ইউব্যাগেজ চালু হওয়ার কারণে কার্গো ফ্লাইট বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সবজি রপ্তানি ধসে পড়ার অন্যতম কারণ। আর এর পেছনে রয়েছে একটি অসাধু চক্র। আর ওই চক্রটিকে সহায়তা করার অভিযোগ কাস্টমসের বিরুদ্ধে।

রপ্তানিকারকরা বলছেন, বছরে গড়ে ১ হাজার কোটি টাকার সবজি রপ্তানি হয়। মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ, আমেরিকাসহ অনেক দেশেই বাংলাদেশের সবজি যায়। তবে যুদ্ধ এবং জ্বালানির প্রতিকূলতায় অন্য অনেক পণ্যের মতো সবজির রপ্তানিও গতি হারিয়েছে। মধ্য প্রাচ্যের দেশগুলোতে সবজি রপ্তানি কমে যাওয়ার কারণ হলো শাহ আমানত বিমানবন্দর ও ওসমানী বিমানবন্দরে কার্গো ফ্লাইট নামছে না।

ফলে কার্গো ফ্লাইটের ফিরতি পথে রপ্তানি পণ্য পাঠানো সম্ভব হয়নি। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে সবজি রপ্তানির বাজার ভারত ও চীনের দখলে গেছে। রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা এবং প্রকৃত রপ্তানির মধ্যে ব্যবধান কেবল বাড়ছেই।

চট্টগ্রামের শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের পরিচালক ক্যাপ্টেন তাসলিম আহমেদ বলেন, মধ্য প্রাচ্যের দেশগুলো থেকে প্রবাসীদের আনা কার্গো পণ্য খালাস নিয়ে জটিলতার কারণে এখন কার্গো বুকিং কমে গেছে। ফলে শাহ আমানতে কার্গো ফ্লাইট অনিয়মিত হয়ে যায়। এ কারণে চট্টগ্রাম বিমান বন্দর থেকে যে পরিমাণ সবজি রপ্তানি হতো, সেটি বন্ধ। কাস্টমস কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তের কারণে প্রায় ২৫ টন পণ্য ওয়্যারহাউজে আটকা পড়েছে। বিমানবন্দরও রাজস্ব হারিয়েছে এই খাতে।

যদিও চট্টগ্রাম কাস্টমস কর্তৃপক্ষের দাবি, কার্গো খালাস বন্ধ নেই। একশ কেজির বেশি পণ্য খালাস বন্ধ রাখা হয়েছে। ব্যাগেজ রুল অনুযায়ী অপর্যটক যাত্রী যৌক্তিক পরিমাণ পণ্য শুল্ক পরিশোধ করে আনতে পারেন। একশ কেজির কোনো সীমারেখা ব্যাগেজ রুলে উল্লেখ নেই। তথাপি সমুদ্র পথে আনা ইউ ব্যাগেজে করে প্রতি যাত্রীর সর্বোচ্চ ছয় হাজার কেজি পণ্যও ছাড় করা হয়েছে।

জানা গেছে, প্রবাসীদের হয়রানি না করে আটকে পড়া কার্গো পণ্য ছাড় করার বিষয়ে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে ফোন করেছিলেন ইঞ্জিনিয়ার মোশারফ হোসেন এমপি, তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী ড. হাসান মাহমুদ, রেল মন্ত্রণালয় বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি এবিএম ফজলে করিম এমপি। কিন্তু চট্টগ্রামের কাস্টমস কমিশনার ফায়জুর রহমান তাদের অনুরোধও শোনেননি।

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে প্রবাসীদের পণ্য নিয়ে এমিরেটস এয়ারলাইন্স, জাজিরা এবং ওমান এয়ারের কার্গো ফ্লাইট নামত চট্টগ্রামে। ফিরতি ফ্লাইটে কম খরচে সবজি নিয়ে যেত ফ্লাইটগুলো। প্রতি কেজি দুইশ টাকার মধ্যে পরিবহনের সুযোগে দেশি রপ্তানিকারকরা মধ্যপ্রাচ্যের বাজার দখলে নেয়।

বর্তমানে বাংলাদেশ বিমানে দ্বিগুণ খরচে সবজি পাঠাতে হচ্ছে। ফলে চট্টগ্রামের শাহ আমানত বিমানবন্দর দিয়ে সবজি রপ্তানি এক প্রকার বন্ধ। একই পরিস্থিতি সিলেট ওসমানী বিমানবন্দরেও। বিদেশি কার্গো ফ্লাইট বন্ধ করে দেয়ার পুরো প্রক্রিয়াটি কিছু অসাধু কাস্টমস কর্মকর্তা পরিকল্পিতভাবে করা করেছেন বলে অভিযোগ রপ্তানিকারকদের।

বাংলাদেশ ফ্রুটস ভেজিটেবল অ্যান্ড অ্যালাইড প্রোডাক্টস এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএফভিএপিইএ) সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ মনসুর বলেন, নানা কারণে আমাদের রপ্তানিখাত বারবার হোঁচট খাচ্ছে। সম্ভাবনা থাকলেও আমরা নতুন নতুন বাজার ধরে রাখতে পারছি না। পরে ভারত ও পাকিস্তান সেটা দখল করে নিচ্ছে। কাস্টমস যদি আন্তরিকতা দেখায় তাহলে এই রপ্তানি আবার আগের অবস্থানে ফিরিয়ে নেয়া সম্ভব।

নয়া শতাব্দী/এমআর

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ