রাজধানীর মিরপুরের মনিপুর উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজের জ্যেষ্ঠ শিক্ষক জাকির হোসেনকে প্রতিষ্ঠানটির ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব দেয়ার নির্দেশ দিয়েছে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতর। হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুসারে প্রতিষ্ঠানটির ম্যানেজিং কমিটির সভাপতিকে এ নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তিন কার্যদিবসের মধ্যে জাকির হোসেনকে প্রতিষ্ঠানটির প্রধান শিক্ষকের ভার দিয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতরকে জানাতে বলা হয়েছে। গত সোমবার মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতর থেকে এ নির্দেশ দিয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে মনিপুর উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজের পরিচালনা পর্ষদের সভাপতির কাছে।
অধিদফতরের সহকারী পরিচালক এস এম জিয়াউল হায়দার হেনরীর সই করা নির্দেশনায় বলা হয়, ‘মহামান্য সুুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট ডিভিশনের রিট পিটিশনের নির্দেশনার আলোকে ঢাকা মহানগরীর মনিপুর উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজের শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে অ্যাকাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রম সচল রাখার স্বার্থে জ্যেষ্ঠ শিক্ষক জাকির হোসেনকে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব দিয়ে তিন কর্মদিবসের মধ্যে অধিদফতরকে জানাতে বলা হলো। এ বিষয়ে চলমান মামলার বিষয়ে মহামান্য আদালত থেকে পরবর্তীতে যে নির্দেশনা আসবে সে মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’
চিঠিতে আরও বলা হয়, ‘হাইকোর্টের রিট পিটিশনের নির্দেশনার আলোকে ঢাকা মহানগরীর মিরপুর থানার মনিপুর উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজে এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের জ্যেষ্ঠতা যাচাইয়ে তথ্য পাঠাতে প্রতিষ্ঠানটির প্রধানকে চিঠি দেয়া হয়েছিল। কিন্তু তথ্য না পাওয়ায় গত ১৭ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠান প্রধানকে তাগিদপত্র দেয়া হয়। প্রতিষ্ঠানটির সর্বশেষ এমপিও শিটে সহকারী প্রধান শিক্ষক হিসেবে আখলাক আহমেদের নাম মুদ্রিত রয়েছে। গত ১৭ জানুয়ারি সহকারী প্রধান শিক্ষক আখলাক আহমেদকে চিঠি দিয়ে তার সহকারী শিক্ষক হিসেবে প্রথম নিয়োগপত্র, যোগদানপত্র ও প্রথম এমপিও শিটের কপি এবং সহকারী প্রধান শিক্ষক পদে নিয়োগপত্র, যোগদানপত্র, সহকারী প্রধান শিক্ষক হিসেবে প্রথম এমপিও শিটের কপি, ৯ কোডে বেতন-ভাতা পাওয়ার লিখিত ব্যাখ্যা এবং প্রাসঙ্গিক প্রমাণের মূল কপি সশরীরে উপস্থিত হয়ে প্রদর্শন করার জন্য বলা হয়। নির্ধারিত সময় শেষ হওয়ার পরও তথ্য পাওয়া যায়নি। হাই কোর্টের নির্দেশনার আলোকে গত ১৬ ফেব্রুয়ারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ও এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের মধ্যে জ্যেষ্ঠ শিক্ষককে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব দিয়ে তিন কার্যদিবসের মধ্যে অধিদফতরকে জানাতে সভাপতিকে বলা হয়েছিল। কিন্তু এ বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।’
অধিদফতর আরও বলছে, মামলার পিটিশনারের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী জ্যেষ্ঠতম শিক্ষক আবদুর রশিদ এরই মধ্যে সহকারী শিক্ষক পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন। সে মোতাবেক পরবর্তী জ্যেষ্ঠতম শিক্ষক হলেন জাকির হোসেন। তাই জাকির হোসেনকে প্রতিষ্ঠানটির ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব দিতে বলেছে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতর। প্রতিষ্ঠানটির প্রধানের পদ অবৈধভাবে আঁকড়ে ছিলেন আগের প্রধান শিক্ষক ফরহাদ হোসেন। প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেলেও তিনি নিজেকে পরিচয় দিতেন অধ্যক্ষ বলে। ২০২০ সালের জুলাই মাসে তার বয়স ৬০ পূর্ণ হয়। তাই সে বছরই তার প্রতিষ্ঠান প্রধানের দায়িত্ব ছাড়ার কথা। কিন্তু তাকে অবৈধভাবে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয়া হয়। যা বিধিসম্মত হয়নি বলে প্রমাণ পেয়েছিল ঢাকা বোর্ডের তদন্ত কমিটি। ১৩ নভেম্বর তাকে দায়িত্ব পালনের সুযোগ দিয়ে হাইকোর্টের সিদ্ধান্ত স্থগিত করে দিয়েছিল আপিল বিভাগের চেম্বারজজ আদালত। তবে প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষক-কর্মচারীরা বলছেন, তিনি এখনও জোর করে প্রতিষ্ঠান প্রধানের পদ দখল করে আছেন।
এর আগে ২৯ জানুয়ারি ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে মনিপুর উচ্চ বিদ্যালয় অভিভাবক ফোরাম সংবাদ সম্মেলন করে। ফোরামের সভাপতি সাইফুল ইসলাম প্রতিষ্ঠানটির বর্তমান অধ্যক্ষ ফরহাদ হোসেনের বিরুদ্ধে অনিয়ম, দুর্নীতি ও লুটপাটের চিত্র তুলে ধরেন। তিনি জানান, ‘বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটিতে শিক্ষার্থী সংখ্যা প্রায় ৪০ হাজার। এর বার্ষিক আয় শতকোটি টাকারও বেশি। কিন্তু আয়-ব্যয়ের কোনো হিসাব নেই। আয়ের বেশিরভাগ টাকাই ভাগ-বাটোয়ারা করে নিয়ে যাচ্ছেন অধ্যক্ষ ও তার অনুসারীরা।’
মনিপুর উচ্চবিদ্যালয় ও কলেজের ৬টি ক্যাম্পাস। মনিপুর এলাকায় বালক ও বালিকাদের জন্য পৃথক ক্যাম্পাস রয়েছে। এর বাইরে শেওড়াপাড়া, ইব্রাহীমপুর ও রূপনগরে শাখা রয়েছে। রূপনগরে আলাদাভাবে করা হয়েছে কলেজ ক্যাম্পাস। এসব শাখায় ছাত্রছাত্রীদের আইডি কার্ড ফি, স্পোর্টস ফি, পানি-গ্যাস ফি, মিলাদ ফি, বিদ্যুৎ ফি, দরিদ্র তহবিলের খাতে টাকা নেয়া হলেও শিক্ষার্থীরা এর কোনোটিই পায় না। শাখা প্রধানরা বিদ্যালয়ে বসে কোচিং বাণিজ্য চালান। অভিভাবকরা কোনো অভিযোগ নিয়ে গেলে স্থানীয় এমপি কামাল আহমেদ মজুমদারের ভয় দেখান অধ্যক্ষ ফরহাদ হোসেন। পুনঃভর্তি ফি আদায়ে সরকারের নিষেধাজ্ঞা থাকলেও তা নেয়া হচ্ছে। বর্তমান অধ্যক্ষের মেয়াদে চার শতাধিক শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। যার প্রতিটি নিয়োগ দেয়া হয়েছে পাঁচ থেকে সাত লাখ টাকার বিনিময়ে। নিয়ম ভেঙে কোনোরকম বিজ্ঞপ্তি ছাড়াই দেয়া হয়েছে এসব নিয়োগ। সূত্র জানায়, প্রায় চার কোটি টাকা ব্যয় করে অধ্যক্ষের বাসভবন ও ২৭ কোটি ৪৬ লাখ টাকায় একটি ছাত্রী হোস্টেল নির্মাণ করলেও সেখানে মাত্র ১৩ ছাত্রী আছেন। ৩১ কোটি ৬৮ লাখ টাকার কাজের প্রয়োজনীতা ও যথাযথ হিসাব দিতে পারেনি স্কুল কর্তৃপক্ষ। এর বাইরে গত সাত বছরে আইন ভেঙে প্রতিষ্ঠানের গভর্নিং বডি প্রায় দেড় কোটি টাকার সম্মানী নিয়েছে। বিশেষ ক্লাসের নামে শিক্ষকদের নামে বরাদ্দ দেখান হয়েছে প্রায় ২১ কোটি টাকা। ছয় বছরে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ম্যাগাজিন ফি বাবদ তিন কোটি টাকা তোলা হলেও কোনো ম্যাগাজিন বের হয়নি। ২০১৬ থেকে ২০২২ সালের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত গভর্নিং বডির সভাপতি, সদস্য ও সদস্য সচিবের সম্মানী বাবদ ১ কোটি ৫৪ লাখ টাকা ব্যয় দেখানো হয়েছে। ২০১৫ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত মূল ক্লাসের পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের বিশেষ ক্লাস নেয়া হয়। এসব ক্লাসের সম্মানী বাবদ পরিশোধ করা হয়েছে ২০ কোটি ৯০ লাখ টাকার বেশি। আয়কর অধ্যাদেশ অনুযায়ী সম্মানী থেকে ১০ শতাংশ উৎসে কর কর্তন করার কথা। সে হিসাবে সরকারকে রাজস্ব বঞ্চিত করা হয়েছে ২ কোটি ৯ লাখ ২ হাজার টাকার বেশি।
জানা গেছে, মনিপুর উচ্চবিদ্যালয় ও কলেজ এমপিওভুক্ত হওয়ার পরও নিয়ম ভেঙে ২০১৯ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি রেজিস্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানিজ অ্যান্ড ফার্মস থেকে ট্রাস্ট গঠন করা হয়েছে। যাদের অধীনেই চলছে প্রতিষ্ঠানটি। বর্তমান ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান রাশেদা আক্তার, যিনি সর্বশেষ গভর্নিং বডিরও সভাপতি ছিলেন। সদস্য সচিব অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ফরহাদ হোসেন। সদস্য হিসেবে রয়েছেন বর্তমান সরকারের শিল্প প্রতিমন্ত্রী কামাল আহম্মেদ মজুমদার, এ কে এম দেলোয়ার হোসেন, তৌহিদুল ইসলাম, জাকিয়া শিল্পী, ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন, ড. মোহাম্মদ শহিদুল্লাহ শিকদার এবং রেজাউল হক ভুঁঞা।
নয়াশতাব্দী/জেডআই
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ