মানব পাচারকারীদের হটস্পট হিসেবে পরিচিত মাদারীপুর জেলা। প্রতিনিয়ই দালাল চক্রের খপ্পরে পড়ে গ্রামের সাধারণ মানুষ সংসারে সচ্ছলতা আনতে ভূমধ্যসাগরের উত্তাল ঢেউয়ে জীবন বাজি রেখে পাড়ি জমান এক অজানার উদ্দেশে। কেউ ভাসতে ভাসতে ইতালি পৌঁছান আবার কেউ সাগরের উত্তাল ঢেউয়ে হারিয়ে যান।
কখনও জেলেরা লাশ খুঁজে পান সাগরে আবার কখনও কখনো চলে যান সমুদ্রের হাঙর ও তিমির পেটে। অনেক সময় প্রিয় সন্তান বেঁচে আছেন না মারা গেছেন সেটাও জানতে পারেন না জন্মদাতা মা-বাবা। আবার অনেকে লিবিয়ার মাফিয়া চক্রের খপ্পরে পড়ে টাকা-পয়সা দিয়েও মুক্তি মেলে না। মাদারীপুরের মানবপাচার চক্র নিয়ে নয়া শতাব্দীর অনুসন্ধানে এমনই চাঞ্চল্যকর তথ্য মিলেছে।
মাদারীপুর সদর উপজেলার ছিলারচর ইউনিয়নের চুন্নু বালির ছেলে তোফায়েল বালি। ঢাকায় ড্রাইভারের চাকরি করে মাসে আয় করতেন হাজার পঁচিশেক টাকা। এতে টানাটানি থাকলেও চলে যেত সংসার। তবে আরও একটু ভালো থাকার আশায়, সংসারে সচ্ছলতা আনতে স্থানীয় এক দালালের খপ্পরে পড়ে লিবিয়া হয়ে পাড়ি জমান ইতালির উদ্দেশে।
প্রায় ১০ মাস লিবিয়ার গেম ঘরে আটকা রয়েছেন তোফায়েল। ইতালির দেখা পাননি এখনও। উল্টো তোফায়েলকে ভালো রাখার জন্য তার পরিবারকে নিয়মিত দালাল চক্রকে দিতে হচ্ছে টাকা। এভাবে সব মিলিয়ে দালাল চক্র হাতিয়ে নিয়েছে প্রায় ১৭ লাখ টাকা। (টাকা লেনদেনের কিছু চেক নয়া শতাব্দীর হাতে রয়েছে।)
সূত্রের মাধ্যমে যোগাযোগ করা হলে লিবিয়ার গেম ঘর থেকে তোফায়েল নয়া শতাব্দীকে বলেন, ‘আমি লিবিয়ায় আটকা রয়েছি। দালালের বাড়ির পাশে আমার এক আত্মীয় আছে। তার মাধ্যমে কথা হয়েছে। সে আমাকে জিজ্ঞেস করেছে ইতালি যাব কি না। আমি বলেছি ওটা তো রিস্কের পথ। তারপর সে বলেছে— কোন সমস্যা নেই। আমার ওখানে লোক আছে, একদম ভিআইপিভাবে পার করব; কোনো সমস্যা হবে না। ঢাকায় গেলাম। ঢাকা নিয়ে আমারে পাসপোর্ট দিল— আর একটা দুবাইয়ের কাগজ। এরপর ওই কাগজ দিয়া বিমানে উঠছি— দুবাইতে ওদের লোক আছে।
এরপর দুবাইতে নামার পর আমি ভয়েস দিছি যেই নম্বর দিছে। এরপর ওরা এয়ারপোর্টের সামনে দাঁড়াই রইছে— এরপর গাড়িতে করে ওদের গন্তব্যে নিয়া গেছে। ওখানে দুদিন রাখার পর আবার গাড়িতে করে বিমানবন্দরে আনে। ওখান থেকে এর পরদিন আমরা লিবিয়া নামি। এরপর লিবিয়া ওখানে ওদের লোক আছে।
প্রথমে বেনগাজী পরে ত্রিপোলি আনে। আনার পর কয়দিন ভালোই যোগাযোগ করত। এখানে নেয়ার পর টাকা চাইছে— বলেছে বাসায় টাকা দিয়া আয়। আমার সঙ্গে ৮ লাখ টাকা কন্ট্রাক হয়েছে। তবে আমি বলেছি যদি আমারে ভালোভাবে নিতে পারেন— কোনো সমস্যা না হয় তাইলে আপনারে আরও ৫০ হাজার টাকা আমি বেশি দিমানে। ওইডা মাইনাই ও আমারে আনছে। এরপর আমি পুরা আট লাখ টাকা দিয়া দিছি।
আমারে এক রুমের মধ্যে আইটকাইছে— আইজ নেয়, কাইল নেয়; করতে করতে আর নেয় না। এর কয়দিন পর দেহি আর যোগাযোগও করে না। আমি ভয়েস পাঠাইছি কোনো রিপ্লাইও দেয় না। এরপর বাড়ি থেকে ওর বাড়িতে লোক পাঠাইছি— তখন তারা বলে বেশি কথা বললে— ‘পোলা নাই কইরালামু। সময় হইলেই পাঠামুনে। আরও টাকা লাগব।’ অ্যাকাউন্ট দিছে, চেকের মাধ্যমে এ অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠাও। এরপর ওর বোন ফোন দিয়া কয়, এহন তাড়াতাড়ি বিকাশে ২০ হাজার টাকা মারেন। এ ২০ হাজার টাকা বিকাশে নিয়েছে। বাকি সব অ্যাকাউন্টে। (বিকাশের স্টেটমেন্ট নয়া শতাব্দীর হাতে রয়েছে)। তোফায়েল বলেন, ‘সব মিলিয়ে নিয়েছে ১৭ লাখ বিশ হাজার টাকা। এখনো আমাকে পার করে নাই— উল্টো ভয়ভীতি দেখায়।
জানতে চাইলে তোফায়েলের মা মনিরা নয়া শতাব্দীকে বলেন, কামরুল মাদবর আমার ছেলেরে পাঠানোর কথা বলে আমাদের কাছ থেকে টাকা নিছে। আমাদের কাছ থেকে এতগুলা টাকা নিয়াও আমার ছেলেরে ইতালি না পাঠাইয়া উল্টো লিবিয়ায় মাফিয়ার কাছে বেইচা দিছে। সেখান থেকে আবার অনেক টাকা দিয়া ছাড়াই আনছি।
এখন টাকা চাইলে উল্টো থ্রেড দেয়। বলে, আমার ছেলেরে লিবিয়ায় মাইরালাইব। আমার ছেলে এখন পলাই আছে। বলে, পুলিশ নাকি তাদের পকেটে থাকে। মামলা করলে আমাদের টাকা দিয়াই নাকি আমাদের সঙ্গে বুঝবে। আমরা শিবচর থানায় একটা অভিযোগ দিছিলাম। পুলিশ তাদের বাসায়ও আসছিল, এরপর চলে গেছে। আর কিছু বলে না— পুলিশ আইলেই টাকা দেয় আর পুলিশ চলে যায়।
টাকা কে কে নিছে জিজ্ঞেস করলে তোফায়েলের মা জানান, টাকা নিছে কামরুলের মা, বাবা, তার বউ এবং বোন। সবাই নিছে। টাকা দেয়ার সময় ওখানকার হ্যাপি নামের এক মহিলা মেম্বারও ছিল।
জানতে চাইলে শিবচরের দক্ষিণ বয়রাতলা এলাকার ৭, ৮ ও ৯ নং ওয়ার্ডের সংরক্ষিত মহিলা মেম্বার আসমা (হ্যাপি) নয়া শতাব্দীকে বলেন, টাকা দেয়ার সময় আমি ছিলাম এবং আরও সাক্ষী আছে। তাছাড়া ব্যাংকের চেকে লেনদেন হয়েছে সব ডকুমেন্টস আছে। ও নেবে নেবে বলে নেয়নি। উল্টো ও অন্য এক দালালের কাছে বিক্রি করে দিয়ে আমাদের বলে যে, লোক পালাই গেছে। এতগুলা টাকা দিয়ে মানুষ পালাবে কেন? তার কি টাকা-পয়সার মায়া নেই?
এরপর লিবিয়ার এক দালাল ফোন দিয়া বলে— আপনাদের দালালের কাছে আমি টাকা পাব। এখন ৮ লাখ টাকা দেবেন না হলে আমি ওরে মাফিয়ার কাছে বেইচা দিয়া আমার টাহা উঠাই নেব।
তিনি আরও বলেন, ‘পুলিশের কথা বলায় ও আমারে হুমকি দেয়। আমি এখানকার মহিলা মেম্বার। ওরা আমারে হুমকি দেয়। আমারে বলে তোগো টাহা দিয়া তোগো লগেই বুঝব।’ অভিযোগের বিষয়ে জানতে অভিযুক্ত দালাল কামরুল মাদবরের মা, বাবা এবং স্ত্রীর মোবাইলে ফোন করা হলে বন্ধ পাওয়া যায়। তাই তাদের বক্তব্য নেয়া যায়নি। পরে বোন সাগরিকার নম্বরে ফোন দেয়া হয়। ফোন করে অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি ফোন তার ছেলের কাছে দিয়ে দেন। তার ছেলে অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘এসব অভিযোগ ভিত্তিহীন।’
এর কিছুক্ষণ পরই ইতালি থেকে এ প্রতিবেদকের মোবাইলে একটি কল আসে। পরিচয় জানতে চাইলে তিনি বলেন যে, তিনি কামরুল মাদবরের বন্ধু। তাকে তার ভাগিনা ফোন দিয়ে বলায় সে ফোন দিছে। প্রতিবেদক কামরুল মাদবরকে চাইলে তিনি বলেন, সে আসলে আমি কল দিতে বলব। এরপর আরও ২-৩ বার ফোন দিয়ে কে অভিযোগ দিছে জানতে চায় প্রতিবেদক না বলে কামরুল মাদবরকে চাইলে সে ফোন কেটে দেয়।
পরে স্থানীয়দের ভয়েস শোনালে তারা নিশ্চিত করেন ওটা দালাল কামরুল মাদবরেই ছিল। এরপর সন্ধ্যায় একই নম্বর থেকে আবার কল দিয়ে প্রতিবেদকের ইমু নম্বর চাওয়া হয়। ইমু নম্বর নেই জানিয়ে প্রতিবেদক দালালকে দিতে বললে একই ব্যক্তি আবারও ফোন কেটে দেন। এর কিছুক্ষণ পরে আবার কল দিয়ে পরিচয় দেয়া হয় যে তিনি কামরুল মাদবর।
এর পর তার কাছে অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি জানান যে, এসবের সঙ্গে জড়িত নয়। তার পরিবারের বাবা, মা, স্ত্রী এবং বোন যদি তার নাম বলে কারও থেকে টাকা নিয়ে থাকে সেটা তাদের বিষয়। সে বিষেয় আইন অনুযায়ী তারা শাস্তি পাবে।
এরপর আবার অভিযুক্ত দালাল সাগরিকাকে ফোন দেয়া হলে ফোন রিসিভ করে একজন তার ছেলে পরিচয় দেয়। কামরুল মাতবরের নাম বলে তারা টাকা নিয়েছেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, আসলে আমাদের সঙ্গে পারিবারিক কিছু ঝামেলা আছে। যে কারণে তারা এমন অভিযোগ দিচ্ছে।
জানতে শিবচর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেনকে ফোন দেয়া হলেও তাকে পাওয়া যায়নি। পরে অফিসার ইনচার্জ (তদন্ত) আমির হোসেন বলেন, আমাদের কাছে এ রকম কোনো মামলা বা অভিযোগ নেই। থানায় অভিযোগ দেয়া হয়েছে এবং সে অভিযোগের কপি নয়া শতাব্দীর কাছে রয়েছে বললে তিনি জানান, তাহলে আমার নলেজে নেই। আমি তো ওসি না ভাই। কপি থাকলে আমাকে পাঠান তাহলে দেখে আমি বলতে পারব।
জানতে চাইলে মাদারীপুর জেলা পুলিশ সুপার মো. মাসুদ আলম নয়া শতাব্দীকে বলেন, ভাই, আসলে আমি অফিসে গিয়ে দেখে বিষয়টা জানাতে পারব। তবে এ নামের কেউ আমার কাছে আসে নিই— তবে কোনো মামলা, মোকদ্দমা থাকলে সেটা আমি খোঁজ নিয়ে দেখতে পারব।
থানায় অভিযোগ দেয়া হয়েছিল কিন্তু পুলিশ ব্যবস্থা নেয়নি— এমনো অভিযোগ রয়েছে আমাদের কাছে এ বিষয়ে জেলা পুলিশ সুপার নয়া শতাব্দীকে বলেন, তাহলে ভাই তাদের আমার কাছে আসতে বলেন। আমি ব্যবস্থা নেব।
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ