ফুটবল খেলায় রেফারির হুইসেল শুনে দুই দল যেমনি মাঠে নামে তেমনি কারো হুইসেলে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত হয়নি। দুনিয়ার কোথাও সেভাবে হয়ও না। এই পৃথিবীর বুকে বহু দেশ আছে যাদের স্বাধীনতা দিবস আছে, প্রজাতন্ত্র দিবস আছে কিন্তু বিজয় দিবস নেই। কিন্তু আমাদের স্বাধীনতা এবং বিজয় দিবস দুটিই আছে।
এই গৌরবময় অর্জনের পেছনে আছে রক্তস্নাত, পিচ্ছিল, বন্ধুর, কণ্টকাকীর্ণ পথচলার ধারাবাহিকতায় লড়াই সংগ্রামের গৌরবদীপ্ত ইতিহাস। এই গিরি কান্তার, মরু দুস্তর পথ পরিক্রমনে আসমুদ্রহিমাচল নেতৃত্বের অবিসংবাদিত নেতা একজনই। তিনি শেখ মুজিব, তিনি বঙ্গবন্ধু, তিনিই জাতির পিতা।
হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, কামরুজ্জামানের মত একদল যোগ্যতম সহচর, সহযোদ্ধা, সহকর্মী আর শেখ মনি, সিরাজুল আলম খান, আব্দুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমেদদের মত আদর্শিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ একঝাঁক অবদমিত তারুণ্য। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে যারা পুরো দেশ চষে বেড়িয়েছেন, মুক্তি পাগল বাঙ্গালীকে মুক্তির মন্ত্রে উদ্দীপ্ত করেছেন, উজ্জীবিত করেছেন। অত:পর ঐতিহাসিক ৭ই মার্চে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনা মোতাবেক ” যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করে” ছিনিয়ে এনেছেন স্বাধীনতার সোনালী বৈজয়ন্তী।
দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শেষে পৃথিবীর বুকে জন্ম নিল লাল সবুজের পতাকা খচিত নতুন এক দেশ। বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ। আগেই বলেছি এই দীর্ঘ পথচলা কখনো কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না। বার বার নানান ষড়যন্ত্র আর চক্রান্তের চোরা স্রোতে পথ হারানোর ভয় ছিল। সবকিছু মুখ থুবড়ে পরার উপক্রমও যে হয়নি তা নয়। এর মাঝে সবচেয়ে ভয়ংকর ফাঁদ ছিল আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার শেষ সময়ে। সেই ভয়াল দূঃসময়ে সমান্তরালভাবে বঙ্গবন্ধু এবং বাঙ্গালীর দীর্ঘ লড়াই সংগ্রামের চূড়ান্ত পরিণতিকে রক্ষা করতে যিনি ত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন তিনি আর কেউই নন তারই সহধর্মিণী, আমাদের নির্যাতিতা মা বেগম মুজিব। বঙ্গবন্ধুর অতি প্রিয় বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলামের ” বিশ্বে যা কিছু সুন্দর চির কল্যাণকর, অর্ধেক তার সৃজিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর” এই অনন্য সাধারণ পংক্তিকে নতুন মাত্রায় ব্যঞ্জনা দিয়েছেন এই মহিয়সী নারী বঙ্গমাতা বেগম মুজিব।
একদিকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বন্দী বঙ্গবন্ধুর কবর খোড়া হচ্ছে আরেকদিকে তাকে প্যারোলে মুক্তি দিয়ে স্বাধীনতার স্বপ্নকে কবর দেয়ার আয়োজন প্রায় সম্পন্ন। এমন পাথর কঠিন সময়ে ঘাপটি মেরে থাকা মুসতাক চক্র বঙ্গবন্ধুর জীবন বাঁচানোর চরম আবেগী দাবি নিয়ে বঙ্গ মাতার দ্বারস্থ। তাদের লক্ষ্য একটাই আপাততঃ বঙ্গবন্ধুর জীবন বাঁচানোর কথা বলে তাকে প্যারোলে রাজি করাতে পারলেই ভেস্তে যাবে মুক্তি সংগ্রামের চূড়ান্ত লড়াই। আখেরে পথ হারাবে স্বাধীনতার স্বপ্ন।
আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি পৃথিবীর সব নারীই চাইবে আগে স্বামীর জীবন, তারপর অন্যকিছু। কথায় বলে ‘নিজে বাঁচলে বাপের নাম’। ষড়যন্ত্রের মুল কুশিলব মুসতাকও ভেবেছিলেন বেগম মুজিবও অন্য সব নারীদের মত সবার আগে নিজের স্বামী সন্তানের কথা ভেবে আবেগের বশবর্তী হয়ে প্যারোলে রাজি হবেন। কিন্তু তিনি রাজি হননি মুসতাকের প্রস্তাবে।
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আরেক আসামী কমোডর মোয়াজ্জেম বঙ্গবন্ধুর প্যারোলে মুক্তির খবর শুনে বেগম মুজিবের পদক্ষেপকে বর্ণনা করেছেন এভাবে 'আমি আর মুজিব ভাই কারাগারে বসে আছি, হঠাৎ দেখলাম গাড়ি থেকে বেগম মুজিব হনহন করে নেমে এসে মুজিব ভাইকে উদ্দেশ্য করে বলছেন, শুনেছি তুমি নাকি প্যারোলে মুক্তির কথা ভাবছ, তাই যদি তাহলে ঢাকা শহরে তোমার বিরুদ্ধে প্রথম যে মিছিলটি হবে সেই মিছিলে নেতৃত্ব দিব আমি আর আমার সাথে থাকবে তোমার পুত্র কন্যারা। তারপর তিনি সেভাবেই গাড়ীতে উঠে চলে গেলেন'।
প্রশ্ন হচ্ছে সেদিন তিনি কি স্বামীর জীবন, সন্তানদের ভবিষ্যতের কথা ভেবেছিলেন? যদি না ভেবে থাকেন তাহলে তিনি কেন ভাবেননি? তিনি কেন দয়ামায়াহীন নিষ্ঠুর ভুমিকায় ছিলেন। বাহ্যত বিষয়টি তেমন মনে হলেও প্রকৃত অর্থে মোটেই তা নয়। মূলত তিনি বঙ্গবন্ধুর জীবন, সন্তানের ভবিষ্যত এবং আমাদের স্বপ্নের স্বাধীনতার কথা অত্যন্ত গভীরভাবে ভেবেছিলেন বলেই বলতে পেরেছিলেন 'হয় প্যারোল না হয় আমি'।
আজীবন এই দেশের মুক্তির সংগ্রামে নিজেকে নিংড়ে দিয়ে বঙ্গবন্ধুর পাশে থাকা এই ছায়া সঙ্গী কোনদিন রাজনীতির কোন পদে না থেকেও প্রখর অন্তদৃষ্টি দিয়ে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন প্যারোলে মুক্তি নিয়ে পাকিস্তানের কবর রূপী কারাগার থেকে যে মুজিব আমার কাছে ফিরে আসবে সেই মুজিব শুধু শরীরী মুজিব। তাতে আমি নিশ্চয়ই স্বামী মুজিবকে এবং সন্তানেরা তাদের বাবা মুজিবকে ফিরে পাবে। কিন্তু মুক্তি পাগল বাঙ্গালী কি ফেরত পাবে তাদের সেই প্রিয় মুজিব ভাইকে যার হাত ধরে তারা দুইশত বছর আগে অস্তমিত স্বাধীনতার সুর্যটা আবার ছিনিয়ে আনার স্বপ্নটা প্রায়ই হাতের মুঠোয় পুরেছিল? তাহলে কি বেঁচে থাকবেন স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখানো মুজিব? আদর্শের মুজিব? যিনি দীর্ঘ তেইশ বছর যাবত তিল তিল করে এই জনপদের মানুষকে শুনিয়েছেন মুক্তির জয়গান! শত নিপীড়ন,নির্যাতন, নিগৃহ, জুলুমের মুখেও বীরদর্পে নিজেকে নিয়ে গিয়েছেন এক অনতিক্রম্য উচ্চতায়। প্যারোলে মুক্তি মানেই সেই উচ্চতা থেকে মুজিবের ধপাস পতন, বাঙ্গালীর স্বাধীনতার স্বপ্নের নির্ঘাত মৃত্যু। আদর্শ মুজিবের মৃত্যু মানে তার কাছে শুধু মুজিবের মৃত্যু নয়, স্বাধীনতারও মৃত্যু ছিল বলেই তিনি প্যারোলে মুক্তির বিপক্ষে কঠিন অবস্থান নিয়ে মুলত আমাদের স্বাধীনতাকেই নিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন।
প্যারোলে মুক্ত মুজিব পাকিস্তানী কারাগারের কবর থেকে ফিরে এলেও কবর হয়ে যেত দীর্ঘ লড়াই সংগ্রামে গড়ে উঠা মুজিবের ভাব প্রতিমার। কবর হয়ে যেত স্বাধীনতার। বাহ্যত সিম্পল গৃহিণী কিন্তু প্রখর দূর দৃষ্টি সম্পন্না বেগম মুজিব ভালো করেই জানতেন এবং বিশ্বাস করতেন, কোন মানুষই অবিনশ্বর নয় এই নশ্বর পৃথিবীতে। সবাইকে বিদায় নিতেই হয়। তবু এই নশ্বর পৃথিবীতে কিছু মানুষ তাদের কর্ম দিয়ে, আদর্শ দিয়ে কখনো কখনো অবিনশ্বর হয়ে উঠেন।
তিনি চেয়েছিলেন তার জীবনে এমন একজনকে যিনি মানুষ হিসেবে নশ্বর কিন্তু কর্মে, আদর্শে অবিনশ্বর হবেন তেমনি তার সন্তানদের জন্যও এমন একজন বাবা যিনি মানুষ হিসেবে নশ্বর কিন্তু কর্মে ও আদর্শে অবিনশ্বর হবেন। তিনি কোনভাবেই চাননি বাঙ্গালীর মুক্তির লড়াইটা আবার অনিশ্চিত অন্ধকারে পথ হারাক। পিছিয়ে যাক অন্তহীন সময়ের জন্য। তিনি চেয়েছিলেন এই যুদ্ধেই কেটে যাক অমানিশা। সুর্যোদয় হোক স্বাধীনতার। ঝাঁশির রানী, ক্ষুদিরাম, হাজী শরীয়ত উল্লাহ, মীর নিসার আলী তিতুমীর, প্রীতিলতা, মাস্টারদা সুর্যসেনের মত অসমাপ্ত, বিচ্ছিন্ন, অপূর্ণ লড়াই আর নয়। একটি পূর্ণাঙ্গ লড়াই এবং পরিপূর্ণ স্বাধীনতা। তিনি তার অন্তদৃষ্টি দিয়ে সেই পরিপূর্ণ স্বাধীনতাকে দেখতে পাচ্ছিলেন। দেখতে পাচ্ছিলেন সেই পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতার স্বাপ্নিক, রুপকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে। যার হাত ধরেই বাঙ্গালী মুক্ত হবে পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে, অবগাহন করবে স্বাধীনতার অমৃত সুধায়। সেই স্বাপ্নিক, আদর্শিক, মুক্তির দূত মুজিব ভাই তার কাছে স্বামী বা সন্তানের পিতা মুজিবের চেয়ে অনেক বড় ছিল বলেই তিনি শরীরী মুজিবের প্যারোলে রাজি হননি। সেখানে সমূহ সম্ভাবনা ছিলো শরীরী মুজিবকে হারানোর। কিন্তু তিনি জানতেন শরীরী মুজিবকে হারালেও বাঙ্গালীর মুক্তির দূত মুজিব বেঁচে থাকবেন অনন্তকাল বাঙ্গালীর হৃদ মন্দিরে। বাঙ্গালীর ভাব প্রতিমা মুজিবের স্ত্রী হিসেবে তিনি এবং সন্তানরাও যতদিন বাঁচবেন মাথা উঁচু করেই বাঁচবেন।
১৯৭৫ সালের সেই ভয়াল কালো রাতে তিনিও বঙ্গবন্ধুর সাথে ঘৃণ্য সেই খুনী ঘাতকদের হাতে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে চির অমরত্বের পথ গ্রহণ করেছেন। তার জীবনাদর্শের কিয়দংশও যদি আমরা যারা প্রতিনিয়ত বঙ্গবন্ধুর আদর্শের পতাকা হাতে রাজনীতির মাঠ গরম করি তারা নিজেদের জীবনে চর্চা করতে পারি তাহলে মুজিব কন্যা শেখ হাসিনার কালজয়ী নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠা সময়ের ব্যাপার মাত্র। এই শোকাবহ আগস্টে এই হোক আমাদের প্রদীপ্ত শপথ। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।
লেখকঃ আমিনুল ইসলাম আমিন, উপ-প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ