দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারসহ ১০ দফা দাবি আদায়ে সমমনা রাজনৈতিক দলগুলো নিয়ে রাজধানীতে গতকাল শুক্রবার গণমিছিল করেছে বিএনপি। যুগপৎ আন্দোলনে প্রথম এই কর্মসূচিতে বিএনপির সঙ্গে অংশ নিয়েছে জামায়াত, এলডিপি, গণতন্ত্র মঞ্চ, ১২ দলীয় জোটসহ মোট ৩২ দল। দলগুলো রাজধানীর বিভিন্ন পয়েন্টে অবস্থান নিয়ে পৃথকভাবে এ কর্মসূচি পালন করেছে। সকাল থেকেই ঢাকা মিছিলের নগরীতে পরিণত হয়। গণমিছিলকে কেন্দ্র করে গত কয়েক দিন ধরেই উত্তাপ-উত্তেজনা ছিল চারদিকে। হাজার হাজার নেতাকর্মী গণমিছিলে অংশ নিয়ে গা গরম করলেও শেষ পর্যন্ত কর্মসূচি এসেছে ঠাণ্ডা। গণমিছিলের আগে বিভিন্ন হুঁশিয়ারি-হুমকি দিলেও কর্মসূচি ঘোষণায় আসেনি উত্তাপ। গণমিছিল শেষে কর্মীদের শান্তিপূর্ণভাবে বাড়ির ফেরার নির্দেশ দেয়া হয়।
গণমিছিলে অংশ নিতে এদিন জুমার নামাজের আগে থেকেই নয়াপল্টনে কেন্দ্রীয় পার্টি অফিসের সামনে জড়ো হন বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মিছিল আকারে ঢাকা মহানগরীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে নেতাকর্মীরা নয়াপল্টন-কাকরাইল মোড়-ফকিরাপুল, দৈনিক বাংলা, পুরানা পল্টন পর্যন্ত সড়কে অবস্থান নেন। পুলিশের অনুরোধে দূরত্ব কমিয়ে নয়াপল্টন থেকে মগবাজার পর্যন্ত গণমিছিল করে দলটি। আড়াই কিলোমিটার দূরত্বের এই পথের বিভিন্ন স্থান থেকে গণমিছিলে যুক্ত হন বিএনপিসহ ১৩টি অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মী ও সমর্থকরা। বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে বিএনপির নয়াপল্টন কার্যালয়ের সামনে থেকে গণমিছিলটি শুরু হয়। শেষ হয় ৪টা ১০ মিনিটে। এর আগে বেলা পৌনে ৩টায় কোরআন তেলাওয়াতের মধ্য দিয়ে শুরু হয় গণমিছিল। কোরআন তেলাওয়াত করেন ওলামা দলের নেতা মাওলানা আলমগীর হোসেন।
গণমিছিলের মূল ট্রাকে ছিলেন- বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, ড. আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী, বেগম সেলিমা রহমান, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু, ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান, ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর বীরউত্তম, মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ বীরবিক্রম, মুক্তিযোদ্ধা দলের সভাপতি ইশতিয়াক আজিজ উলফাত। গণমিছিলের সমন্বয় করেন ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন। এছাড়া মহিলা দল, ছাত্রদল, যুবদল, কৃষক দল, স্বেচ্ছাসেবক দল, ঢাকা মহানগর বিএনপি উত্তর-দক্ষিণ, জাসাস, মুক্তিযোদ্ধা দলসহ ১৩ অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা নির্ধারণ স্থানে রঙবেরঙের ক্যাপ, গেঞ্জি পরে মিছিলে অংশ নেন। মিছিল থেকে খালেদা জিয়ার মুক্তি, মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ নেতাকর্মীদের মুক্তির দাবি জানান হয়। মিছিলে অংশ নেয়া নেতাকর্মীরা বলেন, বিএনপির ১০ দফা দাবি মানতে হবে। নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন দিতে হবে। বেগম খালেদা জিয়াসহ গ্রেফতার সব নেতাকর্মীকে মুক্তি দিতে হবে। শেখ হাসিনার অধীনে কোনো নির্বাচন এ দেশে হবে না। মিছিলপূর্ব সংক্ষিপ্ত সমাবেশ থেকে নতুন কর্মসূচির ঘোষণা দেন খন্দকার মোশাররফ। তিনি বলেন, আগামী ১১ জানুয়ারি সারা দেশে সব বিভাগীয় শহরে সকাল ১০টা থেকে বেলা ২টা পর্যন্ত গণঅবস্থান কর্মসূচি পালন করবে বিএনপি। রাজধানীতে এই গণঅবস্থান হবে নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে। যেসব দল ও জোট আজ গণমিছিল কর্মসূচি পালন করেছে, তারাও গণঅবস্থান কর্মসূচির ঘোষণা দেবে বলেও আমরা বিশ্বাস করি। যারা বাধা উপেক্ষা করে গণমিছিলে উপস্থিত হয়েছেন, সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে বিএনপির এই নেতা বলেন, আজকে বিএনপির গণসমাবেশ থেকে জনগণ অংশ নিয়ে আওয়াজ তুলছে, অবিলম্বে এই সরকারবক পদত্যাগ করতে হবে। তাদের আর জনগণ ক্ষমতায় দেখতে চায় না। আমরা আমাদের ১০ দফা আদায়ে শান্তিপূর্ণভাবে কর্মসূচি পালন করব। আমরা গণতান্ত্রিকভাবে এসব কর্মসূচি পালন করব। এই স্বৈরাচারী সরকারকে বিদায় করতে হলে রাজপথে কঠোর আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। খন্দকার মোশাররফ বলেন, ক্ষমতাসীন এ সরকার আন্তর্জাতিকভাবে হাইব্রিড সরকার নামে পরিচিত। কারণ, তারা দিনের ভোট রাতে করে। এছাড়া জনগণের সঙ্গে তাদের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। ১০ দফা আন্দোলনের প্রথম কর্মসূচি রাজধানীতে। সব কিছুর পক্ষে এই গণমিছিল। শুধু বিএনপি নয়, অধিকাংশ রাজনৈতিক দল এ আন্দোলনে শরিক হয়েছে। আমাদের ১০ দফার মূল হলো অবিলম্বে গায়ের জোরের সরকারকে পদত্যাগ করতে হবে। নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে। স্বাগত বক্তব্য গণমিছিল কর্মসূচির প্রধান সমন্বয়ক এ জেড এম জাহিদ হোসেন বলেন, আমরা ১০টি বিভাগীয় গণসমাবেশ শান্তিপূর্ণভাবে করেছি। বিএনপির সৈনিকরা কতটা সুশৃঙ্খল থাকতে পারে, তার উদাহরণ সৃষ্টি করব। মগবাজারের মোড়ে গণমিছিল পৌঁছানোর পর সেখান থেকে কর্মসূচির সমাপ্তি ঘোষণা করেন ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির আহ্বায়ক আমানউল্লাহ আমান। তিনি বলেন, আমাদের আজকের গণমিছিল এখানেই শেষ। আপনারা সবাই শান্তিপূর্ণভাবে বাড়ি ফিরে যাবেন। পথে কোনো ধরনের ঝামেলা করবেন না। এদিকে গণমিছিলকে কেন্দ্র করে রাজধানীর মগবাজার মোড় থেকে পুরানা পল্টন পর্যন্ত জায়গায় জায়গায় সতর্ক অবস্থানে ছিল পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলার রক্ষাকারী বাহিনীর অন্যান্য সদস্য। শেষ পর্যন্ত কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ছাড়াই শেষ হয় বিএনপির গণমিছিল।
জামায়াতে ইসলামী: এদিন বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদ থেকে মিছিল বের করার ঘোষণা দিলেও জামায়াত জুমা নামাজের পর মালিবাগ রেলগেট এলাকা থেকে গণমিছিল বের করে। এ সময় পুলিশের সঙ্গে তাদের ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া হয়। এ ঘটনায় জামায়াতের ১১ নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করেছে বলে জানিয়েছে পুলিশ। এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) রমনা বিভাগের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (ডিসি) শাহেন শাহ মাহমুদ বলেন, মালিবাগ মোড়ে হোসাফ টাওয়ারের সঙ্গের মসজিদে নামাজ শেষে জামায়াতের ব্যানারে কিছু লোক মিছিল বের করার চেষ্টা করে। এক পর্যায়ে পুলিশের ওপর চড়াও হয় তারা। এতে বেশ কিছু পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন। সংঘর্ষের সময় বেশ কয়েকজনকে আটক করা হয়েছে।
এলডিপি: লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি) প্রধান কার্যালয় থেকে গণমিছিল বের হয়ে মগবাজার রেলগেট-ওয়ারলেস-মালিবাগ মোড় প্রদক্ষিণ করে বিকাল সাড়ে ৪টায় আবার কার্যালয়ের সামনে এসে শেষ হয়। শারীরিক অসুস্থতার কারণে মিছিলে যোগ দেননি এলডিপির চেয়ারম্যান কর্নেল (অব.) ড. অলি আহমদ (বীর বিক্রম)। তবে মিছিল শেষ হওয়া পর্যন্ত দলীয় কার্যালয়ে অবস্থান করেন তিনি। মিছিল শেষে বিএনপির ১০ দফার সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে আগামী ১১ জানুয়ারি অবস্থান কর্মসূচির ঘোষণা করেন অলি আহমদ। সকাল ১০টায় শুরু করে শেষ হবে বেলা ২টা পর্যন্ত চলবে বলেও জানান। মিছিল শুরুর আগে নেতাকর্মীদের উদ্দেশে অলি আহমদ বলেন, আমাদের একমাত্র দাবি- তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচন। যার মাধ্যমে জনগণ উৎসবমুখর পরিবেশে কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দিতে পারবে। এই আন্দোলনের মাধ্যমে জনগণ আমাদের পক্ষে থাকবে। গণমিছিল থেকে এলডিপির নেতারা জাতীয় সরকার গঠন, রাষ্ট্র সংস্কার ও সরকার পতনের নানা স্লোগান দেয় নেতাকর্মীরা।
গণতন্ত্র মঞ্চ: যুগপৎ আন্দোলনের কর্মসূচি হিসেবে বেলা ১১টায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে বিক্ষোভ সমাবেশ করে সাত দলীয় জোট-গণতন্ত্র মঞ্চ। সমাবেশ থেকে ১১ জানুয়ারি তিন ঘণ্টার গণ-অবস্থান কর্মসূচির ঘোষণা দিয়েছে জোটটি। পরে গণমিছিল বের করে। এটি পল্টন মোড়, বিজয়নগর সড়ক হয়ে কাকরাইল মোড়ে এসে শেষ হয়। সমাবেশে গণতন্ত্র মঞ্চের নেতারা বলেন, সরকারের পতন ঘণ্টা বাজতে শুরু করেছে। তাই আগামীর আন্দোলনে দলমত নির্বিশেষে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান। গণমিছিলে অংশ নেয় ৭ দলের সহস্রাধিক নেতাকর্মীরা। ‘ভোট চোর সরকার, আর নাই দরকার’, ‘শেখ হাসিনার সরকার, আর নাই দরকার’, ‘আগুন জ্বালাও আগুন জ্বালাও, ভোট চোরের আস্তানায়’ ইত্যাদি স্লোগান দেন নেতাকর্মীরা। এর আগে ‘নিশিরাতে ভোট ডাকাতির ৪ বছর: ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সরকার ও শাসনব্যবস্থার পরিবর্তনে ঐক্যবদ্ধ হোন: সমাবেশ ও গণমিছিল’ ব্যানারে সমাবেশ করে।
১২-দলীয় জোট: বিজয়ের মাসে যুগপৎ আন্দোলন শুরু হয়েছে। চূড়ান্ত বিজয় না হওয়া পর্যন্ত এই আন্দোলন চলবে বলে ঘোষণা দিয়েছে ১২-দলীয় জোট। গতকাল বিকালে রাজধানীর বিজয়নগর পানির ট্যাংকের সামনের সড়কে আয়োজিত সংক্ষিপ্ত সমাবেশে জোটের নেতারা এ ঘোষণা দেন। পরে বিএনপির ১০ দফা দাবি সমর্থন করে এসব দাবি আদায়ে গণমিছিল বের করেন নেতাকর্মীরা। মিছিলটি বিজয়নগর পানির ট্যাংকের সামনে থেকে শুরু হয়ে পুরানা পল্টন মোড় ঘুরে কাকরাইল মোড়ে গিয়ে শেষ হয়। গণমিছিলে ‘এই মুহূর্তে দরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকার’, ‘নিশিরাতের সরকার আর না আর না’, ‘পুলিশ দিয়ে আন্দোলন বন্ধ করা যাবে না’ ইত্যাদি স্লোগান দেন নেতাকর্মীরা।
গণমিছিলের আগে সমাবেশে জাতীয় পার্টি (জাফর) চেয়ারম্যান মোস্তফা জামাল হায়দার বলেন, দেশের রাজনীতির ইতিহাসে আজ নতুন পর্বের সূচনা হয়েছে। দাবি আদায়ে ১১ জানুয়ারি বেলা ১১টায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে অবস্থান কর্মসূচির ঘোষণা দেন। যুগপৎ আন্দোলন এ দেশে নতুন পরিস্থিতির জন্ম দেবে বলে মনে করেন। মিছিলে অংশ নেয়- জাতীয় পার্টি (জাফর), বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি, বাংলাদেশ লেবার পার্টি, বাংলাদেশ জাতীয় দল, এনডিপি, বাংলাদেশ এলডিপি, বাংলাদেশ মুসলিম লীগ, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, মাওলানা আবদুর রকীবের ইসলামী ঐক্যজোট, তাসমিয়া প্রধানের জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি (জাগপা), নুরুল ইসলামের বাংলাদেশ সাম্যবাদী দল, বাংলাদেশ ইসলামিক পার্টি।
জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট: যুগপৎ আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানিয়ে আগামী ১১ জানুয়ারি অবস্থান কর্মসূচির ঘোষণা করেছে ১১টি দলীয় জোট। ওইদিন বেলা ১১টা থেকে বেলা ২টা পর্যন্ত জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে এ অবস্থান কর্মসূচি পালন করবে। গতকাল গণমিছিলের আগে প্রেসক্লাবের সামনে এ কর্মসূচি ঘোষণা করেন জোটের সমন্বয়ক ও ন্যাশনাল পিপলস পার্টির (এনপিপি) চেয়ারম্যান ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদ। এরপর বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে প্রেসক্লাবের সামনে থেকে গণমিছিল শুরু হয়ে পুরানা পল্টন হয়ে বিজয়নগর পানির ট্যাঙ্কি মোড়ে গিয়ে শেষ হয়। গণমিছিলে অংশ নেন জাগপার সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা খন্দকার লুৎফর রহমান, ডেমোক্রেটিক লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইফুদ্দিন আহমেদ মনি, ন্যাপ ভাসানীর সভাপতি আজহারুল ইসলাম, বিকল্পধারা বাংলাদেশের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. নুরুল আমিন বেপারী, মহাসচিব অ্যাডভোকেট শাহ আহমেদ বাদল, বাংলাদেশ ন্যাপের চেয়ারম্যান শাওন সাদেক ও গণদলের চেয়ারম্যান এটিএম গোলাম মাওলা চৌধুরী।
নয়াশতাব্দী/জেডআই
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ