বাতিল হয়ে যাওয়া তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যু আবারও আলোচনায়। মাঠের বিরোধী দল বিএনপি ও সমমনাদের দাবি, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার পুনঃপ্রবর্তন ছাড়া তারা কোনো নির্বাচনে যাবে না। বিএনপির এমন কঠোর অবস্থানে জনমনে আতঙ্ক-দেশ কি ফিরে যাবে ২০১৪ সালের পরিস্থিতিতে? কেননা সরকার দৃঢ়ভাবেই জানিয়ে দিয়েছে, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে সংবিধান মেনে। যা গেছে, তা আর আসবে না কোনোভাবেই।
গত ১০ ডিসেম্বর গোলাপবাগের সমাবেশ থেকে বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিষয়ে বলে, ১৯৯৬ সালে সংবিধানে সংযোজিত ধারা ৫৮-খ, গ ও ঘ অনুচ্ছেদের আলোকে একটি দলনিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন সরকার/অন্তর্বর্তীকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করতে হবে। দাবি আদায়ে জোরালো আন্দোলন করার কথাও বলে দলটি। তবে প্রশ্ন হলো- বিএনপির দাবি মেনে কি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থায় আদৌ আর ফেরা সম্ভব?
এ বিষয়ে সাবেক আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ বলেন, এককথায় বললে বলব তত্ত্বাবধায়ক সরকার মনে হয় না দরকার আছে। কারণ দেশকে এগিয়ে নিতে হলে যথাযোগ্য মর্যাদা নিয়ে একটা সরকার চলতে হবে। খুশিমতো আজকে এটা, কালকে ওইটা, তা তো হবে না। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে আমি এটা জাজ করছি। যদিও বেশি সংখ্যক জনগণ ওই ব্যবস্থাটা আবার চায়, তাহলে যে কোনো কিছুই সম্ভব। তবে এটা আনা সঠিক হবে কি না সেটাই আমার প্রশ্ন।
বিএনপির আইন বিষয়ক সম্পাদক কায়সার কামাল বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা কায়েম হয়েছিল ‘ডকট্রিন অব নেসেসিটি’র ভিত্তিতে। অর্থাৎ দেশের রাজনৈতিক প্রয়োজনেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা পাস হয়। কালের পরিক্রমায় এটা প্রমাণিত হয়েছে যে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাটা অপরিহার্য।
১৯৯১, ৯৬ ও ২০০১ সালে দেশে চমৎকার নির্বাচন হয়েছে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, বর্তমান সরকার ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করার জন্য জনমতের বিপরীতে গিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করেছে।
বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, আপিল বিভাগ তার রায়ে বলেছে, জাতীয় সংসদ চাইলে আরও দুবার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন করতে পারবে। তাহলে কী হলো- কোর্ট ছেড়ে দিল সংসদের উপরে। সংসদ মানে বর্তমান সরকারের ওপর। আর সরকার হলো আওয়ামী লীগ। তারা পরবর্তী পর্যায়ে দুবার আর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন করেনি। তারা চাইলে দুবার করতে পারত। সংবিধান সংশোধন করে আরও দুবার করতে পারে। এ বিষয়ে কোর্টের পর্যবেক্ষণও আছে। বিএনপি নেতার এই ব্যাখ্যা অবান্তর দাবি করে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সম্পাদক আব্দুন নূর দুলাল বলেন, উচ্চ আদালত যেহেতু এটি বাতিল করেছে, সংবিধানও সংশোধন করা হয়েছে- এ অবস্থায় পুনরায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহালের কোনো সুযোগ নেই বলে মনে করেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হকও। সমপ্রতি সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতিকে সর্বোচ্চ আদালত অবৈধ ঘোষণা করেছে। আমরা যেহেতু আইনের শাসনে বিশ্বাস করি, আমরা সেই রায় মানি। তত্ত্বাবধায়ক সরকার হওয়ার আর কোনো সম্ভাবনা নেই।
রিট আবেদন আছে, হয়নি শুনানি: নতুন আঙ্গিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশনা চেয়ে ২০১৮ সালের ২ অক্টোবর উচ্চ আদালতে রিট করেছিলেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ইউনুছ আলী আকন্দ। যদিও এই রিটের শুনানি হয়নি। রিটকারী আইনজীবী বলেন, আপিল বিভাগের রায় অনুসারে দুবার তত্ত্বাবধায়কের সুযোগ ছিল। সেই গ্রাউন্ডে রিট করেছিলাম। তবে রিটটির শুনানি হয়নি। এখন নতুন করে শুনানির জন্য উদ্যোগ নেয়ার ইচ্ছাও নেই।
প্রসঙ্গত, ১৯৯০ সালে এরশাদ সরকারের পতনের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে পরের বছরের নির্বাচনে ক্ষমতায় আসে বিএনপি। ১৯৯৪ সালে ঢাকার মিরপুর ও মাগুরায় দুটি সংসদীয় আসনে উপনির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ ওঠার পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনে নামে আওয়ামী লীগসহ সে সময়ের বিরোধী দলগুলো।
বিএনপির মেয়াদে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলনে থাকা আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্যরা ১৯৯৪ সালের ২৮ ডিসেম্বর একযোগে পদত্যাগ করার পর দেশব্যাপী আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। এর মধ্যে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি একতরফা নির্বাচন করে বিএনপি। তাতে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় জিতে এসেও বিএনপি ক্ষমতা ধরে রাখতে পারেনি। একপর্যায়ে সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যবস্থা করে আবার জাতীয় নির্বাচন দেয়।
১৯৯৬ সালের ১২ জুনের সেই ভোটে জিতে ২১ বছর পর ক্ষমতায় ফেরে আওয়ামী লীগ। দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো কোনো সরকার পাঁচ বছরের মেয়াদ শেষ করে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করে ২০০১ সালে।
ওই বছর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনে জিতে বিএনপি-জামায়াত জোট আসে ক্ষমতায়। তবে সেই সরকারের আমলে বিচারপতিদের অবসরের বয়সসীমা দুই বছর বাড়ানো নিয়ে তৈরি হয় রাজনৈতিক বিরোধ।
সরকারের এই সিদ্ধান্তের ফলে ২০০৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হওয়ার কথা হয় অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি কে এম হাসানের। তিনি এককালে বিএনপির আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক ছিলেন। ফলে তাকে মেনে নিতে রাজি ছিল না আওয়ামী লীগ।
আন্দোলনের একপর্যায়ে কে এম হাসান জানান, তিনি এই পদের জন্য আগ্রহী নন। এরপর তত্ত্বাবধায়ক সরকারপ্রধানের পদে কে আসবেন, এ নিয়ে বিরোধের মীমাংসা না হওয়ার পর বিএনপির নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিনের ওপর বর্তায় সেই দায়িত্ব।
ইয়াজউদ্দিনের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার ঘোষণা দিয়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট যায় আন্দোলনে। কিন্তু একবার পিছিয়ে ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারি নির্বাচনের তারিখ ঘোষিত হয়।
একতরফা নির্বাচনের দিকে দেশ যখন এগিয়ে যাচ্ছিল, তখন ভোটের ১১ দিন আগে হস্তক্ষেপ করে সেনাবাহিনী। ইয়াজউদ্দিন আহমেদ জরুরি অবস্থা জারি করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধানের পদ ছেড়ে দেন। দায়িত্ব নেন ফখরুদ্দীন আহমেদ। সেই সরকার প্রায় দুই বছর ক্ষমতায় থাকার পর ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর ভোট দেয়। সেই নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় জিতে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট।
বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে সংবিধানের যে সংশোধনীর মাধ্যমে এই সরকারব্যবস্থা চালু হয়েছিল, সেই ত্রয়োদশ সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে আইনজীবী এম সলিম উল্লাহসহ কয়েকজন রিট আবেদন করেন। শুনানি নিয়ে ২০০৪ সালে হাইকোর্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে বৈধ বলে ঘোষণা করে। ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে যায় রিট আবেদনকারী পক্ষ। ২০১০ সালের ১১ মে আপিল বিভাগ হাইকোর্টের রায় পাল্টে এই সরকার ব্যবস্থাকে অবৈধ ঘোষণা করে।
এরপর দুটি নির্বাচন নির্বাচিত সরকারের অধীনে হয়। এর মধ্যে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির ভোট বর্জন করলেও ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে অংশ নেয় বিএনপি। তবে এবার নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকার ছাড়া ভোটে না আসার কঠোর অবস্থান নিয়ে বসে আছে দলটি।
নয়াশতাব্দী/জেডআই
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ