অনিয়ম-দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতা এখন নিয়মে পরিণত হয়েছে ট্রাফিক বিভাগে। ‘বডি অন ক্যামেরা’ও রুখতে পারছে না অনিয়ম। সাপ্তাহিক ও মাসিক চুক্তির ভিত্তিতে অবৈধ পন্থায় বড় অঙ্কের অর্থ পকেটে ঠোকায় দায়িত্বপ্রাপ্তরা। দিয়াবাড়ি থেকে পোস্তগোলা রুটের রাইদা পরিবহনের এক চালক বলেন, রুটটিতে রাইদা পরিবহনের ৩০০ থেকে ৩৫০টি গাড়ি চলাচল করে। প্রতিটি গাড়ির বিপরীতে মাসে সর্বনিম্ন ৫ হাজার টাকা করে নেয়া হয়। এর বাইরে সাপ্তাহিক হিসেবে নেয়া হয় ৩ হাজার টাকা।
চালকদের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে ট্রাফিক পুলিশের রাইদা পরিবহন কোম্পানি থেকে মাসোহারার একটি সমীকরণে দেখা যায়- রাইদা পরিবহনের প্রতিটি বাস থেকে মাসে ৫ হাজার টাকা হারে চাঁদা উঠানো হলে ৩০০টি গাড়ি ধরে মাস শেষে দাঁড়ায় ১৫ লাখ টাকা। বছর শেষে ১ কোটি ৮০ লাখ টাকা। এর বাইরে রয়েছে সপ্তাহের হিসাব। এছাড়া অন্য পরিবহনেও একই চিত্র। চালকদের প্রশ্ন এত টাকা মালিক পক্ষ দেয়ার পরও রাস্তায় গাড়ি থামিয়ে নানা অজুহাতে আমাদের কাছ থেকে টাকা নেয়া হয় কেন? ট্রাফিক পুলিশের অর্থ লেনদেনসহ নানা অনিয়মের ভিডিও চিত্র সংরক্ষিত আছে নয়া শতাব্দীর হাতে।
গত বৃহস্পতিবারের ঘটনা। ঘড়ির কাঁটায় রাত সাড়ে ৯টা। রাইদা পরিবহনের একটি বাস জমজম টাওয়ারের সামনে আসা মাত্র চৌরাস্তার সিগন্যালে থামতে বলেন একজন সার্জেন্ট। চালকের ধারণা সাধারণ সিগন্যাল। কিন্তু চালককে বলা হয় গাড়ির কাগজ নিয়ে নিচে নামতে। তখনই চেঁচামেচি শুরু করেন চালক ও হেলপার। মাসে ও সপ্তাহে টাকা দেয়ার পরও কেন এমন হেনস্তা! গাড়ির কাগজ নিয়ে নেমে যান হেলপার। চালকের কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি নয়া শতাব্দীকে বলেন, পুলিশের আইনের কি শেষ আছে? মাসিক ও সাপ্তাহিক দিয়ে রাস্তায় গাড়ি নামিয়েছি। তারপরও বিভিন্ন পয়েন্টে প্রতিদিন গাড়ি থামিয়ে ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা বের করে নেয়। আজই ১৪০০ টাকা দিয়েছি। এ টাকা যায় চালক ও হেলপারের পকেট থেকে। বোঝেন কী অবস্থা আমাদের! তিনি আরও বলেন, তাদের (সার্জেন্টদের) বুঝমতো না হলেই দেয়া হয় মামলা। কয়েক দিন আগেই ১০ হাজার টাকার মামলা খেয়েছি। ১০ হাজার টাকার কী মামলা জানতে চাইলে চালক বলেন, কী যে মামলা দেয়- একমাত্র তারাই জানেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন সার্জেন্ট নয়া শতাব্দীকে বলেন, মাসে গাড়ি প্রতি ৫ হাজারের নিচে নেয়া হয় না। এর বেশিই নেয়া হয়। এ টাকা একদম সিনিয়র অফিসার পর্যন্ত চলে যায়।
সরেজমিন, বিভিন্ন পয়েন্টে হয়রানির শিকার চালকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, চালকের অপরাধ থাকার পরও মামলা না দিয়ে অবৈধ উপায়ে টাকা নেয়ার সময় কনস্টেবল ও আনসার কর্মীদের ব্যবহার করে। কোনো কোনো সময় সার্জেন্ট সামনে এলেও থাকে না নেমপ্লেট। টাকা হাতিয়ে নিতে আইনের শেষ নেই তাদের।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, সার্জেন্টরা অপকর্মের সময় ইচ্ছে করেই ‘বডি অন ক্যামেরা’ বন্ধ রাখে। আবার কাজ শেষে ‘অন’ করেন। দরকষাকষি করেন কনস্টেবল। আবার গাড়ির সব কাগজপত্র ঠিক থাকলেও ছোটখাট ইস্যু সামনে এনে নেয়া হয় টাকা। যার পরিমাণ ১০০-২০০ টাকা। ব্যাটারিচালিত রিকশা থেকে অপরাধের ধরন বুঝে নেয়া হয় ১০০-৫০০ টাকা।
এমনই একজন ভুক্তভোগী মোটরসাইকেল (পাঠাও) চালক আল আমিন নয়া শতাব্দীকে বলেন, মহাখালী যক্ষ্মা হাসপাতালের সামনে ফুটওভার ব্রিজের নিচে অপেক্ষা করছিলেন। হঠাৎ ট্রাফিক পুলিশের এক কনস্টেবল এসে তার গাড়ি থেকে চাবি নিয়ে যায়। যদিও ওই ট্রাফিক সদস্যের নেমপ্লেট ছিল না। সব কাগজ থাকার পরও রাস্তার পাশে দাঁড়ানোর জন্য ১০০ টাকা জরিমানা করেন। সরেজমিন, রাজধানীর বেশ কয়েকটি ট্রাফিক পয়েন্ট ঘুরে দেখা মেলে ট্রাফিক পুলিশের চাঁদাবাজির নানা চিত্র। যার বেশ কয়েকটি ভিডিও চিত্র রয়েছে নয়া শতাব্দীর হাতে।
রাজধানীর বিজয় সরণি, সাতরাস্তা, ফার্মগেইট, মহাখালী, বিমানবন্দর, আজমপুর, ধউর চেকপোস্ট, কামারপাড়া, খিলক্ষেত, র্যাডিসনের সামনে, মাটিকাটা ইসিবি মোড়, মিরপুর-১২ এমন কয়েকটি পয়েন্টে ট্রাফিক পুলিশের নানা অনিয়মের দেখা মেলে। এসবের মধ্যে কিছু পয়েন্টে রাত হলে চলে মহা চাঁদাবাজি। কিছু অসাধু সদস্যের এমন কাণ্ডে প্রশ্নের মুখে ট্রাফিক বিভাগের কর্মকর্তারা। ট্রাফিক পুলিশের অবৈধ কর্মকাণ্ডে ট্রাফিক বিভাগের আয় বাড়লেও বাড়ে না রাজস্ব। অন্যদিকে, নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে চলছে মোটরসাইকেলে জরিমানার নামে হয়রানি। যা একেবারে জুলুমের পর্যায়ে ঠেকেছে সাধারণ মানুষের কাছে। বেশির ভাগ চালক সপ্তাহে ১ দিন জরিমানা গুনছেন বলে জানান।
রাজধানীর বৃহত্তর উত্তরা এলাকার সব চেকপোস্টে ট্রাফিক পুলিশের বেপরোয়া চাঁদাবাজি চোখে পড়ার মতো। প্রতিদিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত প্রতিটি পয়েন্টে সার্জেন্ট এবং ট্রাফিক পুলিশ হাত বাড়িয়ে নিচ্ছে টাকা।
ধারণ করা চিত্রগুলো বলছে, ব্যাটারিচালিত ও পায়ের রিকশাচালকরাও রেহাই পাচ্ছে না তাদের হাত থেকে। প্রধান সড়কের আসা ও যেখানে-সেখানে দাঁড়ানোর অপরাধে খুলে নেয়া হচ্ছে রিকশার ছিট। চালককে এক ঘণ্টা দাঁড় করিয়ে রেখে ৫০-১০০ টাকার বিনিময়ে ছেড়ে দেয়া হচ্ছে। এই চিত্র নিত্যদিনের। অনেকটা প্রকাশ্যে ও গোপনে চলছে অবৈধ লেনদেন। ঢাকা-টাঙ্গাইল এবং ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক দিয়ে প্রতিদিন হাজার হাজার যানবাহন চলাচল করে। এসব যানবাহনের কোনোটিই চাঁদাবাজির বাইরে নয় বলে জানা যায়।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গাজীপুর থেকে ঢাকা ৩ নম্বর ও ২৭ নম্বর বাস ও অনাবিল পরিবহন, বলাকা, বনশ্রী প্রভাতী, স্কাইলাইন, আজমেরি এবং আবদুল্লাহপুর থেকে গুলিস্তান, মতিঝিল, আজিমপুর ও মিরপুর রোডের গাড়ি থেকে প্রতিদিন হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে টাকা। উত্তরা আজমপুর ও আব্দুল্লাহপুরে রয়েছে ১০-১২ টি দূরপাল্লার বাস কাউন্টার এসব কাউন্টার সার্ভিসগুলো থেকে প্রতিদিন প্রত্যেক সার্জেন্টের নামে টাকা উঠানো হয়। আর এসব টাকা কালেকশন করেন একজন সার্জেন্ট। আব্দুল্লাহপুর রাজশাহীগামী এক বাসের যাত্রীর সঙ্গে কথা বললে তিনি জানান, ন্যায্য ভাড়ার থেকে ৫০ টাকা হারে বেশি ভাড়া দিতে হয় কাউন্টার কর্মকর্তাদের। কারণ তারা প্রতিদিন এখানে কাউন্টার বসানোর জন্য ট্রাফিক পুলিশকে এবং ফাঁড়ি পুলিশকে টাকা দিতে হয়। এ ব্যাপারে আব্দুল্লাহপুর থেকে গুলিস্তান যাতায়াতকারী ৩ নম্বর বাসের এক মালিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, উত্তরা এলাকার ওপর দিয়ে যেসব গাড়ি চলে, তার সব গাড়ি থেকে পুলিশকে দৈনিক, সপ্তাহ কিংবা মাসোহারা ভিত্তিতে টাকা দিতে হয়। গাজীপুর থেকে আজিমপুর যাতায়াতকারী ২৭ নম্বর গাড়ির একজন চালক আল-মাসুদ বলেন, উত্তরা বিভাগের ট্রাফিক পুলিশের প্রত্যেক সার্জেন্টকে সপ্তাহে প্রায় এক হাজার এবং টিআইকে মাসে ৫ হাজার টাকা দিতে হয়। এই টাকা প্রতিটি বাস কোম্পানির লোক চাঁদা হিসেবে পৌঁছে দেয়। যেন রাস্তায় তাদের গাড়ির বিরুদ্ধে কোনো মামলা করা না হয়। তার পরেও মামলা দেয়া হয়। একাধিক বাস কোম্পানির লোকজন জানান, বর্তমান ট্রাফিকের ডিসি অনেক ভালো। তিনি এসব অবৈধ লেনদেন প্রশ্রয় দেন না বলে আমরা জানি।
অনুসন্ধানে জানা যায়, রাজধানীতে নিয়মিত যাতায়াতকারী বালির ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান, ট্রেনিং কার, মুরগি পরিবহনের বিশেষ গাড়ি, মালবাহী পিকআপ ও প্রাইভেট সিএনজি থেকে পুলিশের নামে চাঁদা তোলা হচ্ছে মাসোহারা ভিত্তিতে। অভিযোগ আছে, ট্রাফিক পুলিশ ৪০টি ট্রেনিং কার থেকে মাসে ৪০ হাজার, ৫০টি কাভার্ড ভ্যান থেকে মাসে দেড় লাখ, ৪০টি ইট-বালু বহনকারী ট্রাক থেকে ৪০ হাজার টাকা প্রতিমাসে মাসোহারা আদায় করে থাকেন। চাঁদার অভিযোগ সম্পর্কে নাম প্রকাশ না করার শর্তে ট্রাফিক পুলিশের এক র্সাজেন্ট বলেন, আমাদের রাস্তায় দায়িত্ব পালন করতে হয়। অনেক সময় বিভিন্ন গাড়ির বিরুদ্ধে মামলাও করতে হয়, যে কারণে কেউ কেউ অভিযোগ করতেই পারে। আমরা মামলা দিলেও দোষ না দিলেও দোষ। আপনারাই বলেন কী করা উচিত? তিনি আরও বলেন, মানবতা দেখিয়ে মামলা না দিলে সবাই মনে করে টাকা নিয়ে ছেড়ে দিলাম। আর মামলা করলে বলে টাকা দেয়নি বলে মামলা দিল। মামলার ভয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি বেসরকারি স্টাফবাসের চালক অভিযোগ করে বলেন, গাজীপুর ও সাভারের রুটপারমিটধারী প্রায় ১০০টি প্রাইভেট সিএনজি চলাচল করে থাকে। নিয়ম অনুযায়ী এ সব ঢাকা মেট্রো এলাকায় চলাচল করা বেআইনি। কিন্তু ট্রাফিক পুলিশের কোনো কোনো সার্জেন্ট গাড়িপিছু ২-৩ হাজার টাকা হারে মাসোহারা চুক্তিতে সেসব গাড়ির সব দায়িত্ব নিচ্ছেন। এর সুবাদে অন্য কোনো ট্রাফিক পুলিশ এসব গাড়ি আটক করলে তারা ছাড়িয়ে আনার ব্যবস্থা করেন।
গাজীপুরের রুট পারমিটধারী একাধিক চালক সত্যতা স্বীকার করে বলেন, পুলিশকে ম্যানেজ করতে না পারলে এক দিনও ডিএমপি এলাকায় গাড়ি চালানো যাবে না। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ট্রাফিকের একজন অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার নয়া শতাব্দীকে বলেন, আসলে আমরা এই দায় এড়িয়ে যেতে পারি না। কিন্তু এটাও মানতে হবে আগের থেকে অনেক কমে গেছে এভাবে টাকা নেয়া। তিনি আরও বলেন, আমাদের সিনিয়র স্যাররা এসব বিষয় নিয়ে কঠোর অবস্থানে রয়েছেন। এমন অপরাধে অনেকের চাকরি গেছে। আবার পানিসমেন্টও হচ্ছে। সবশেষে ম্যাসেজ দিতে চাই- অন্যায় করে কেউ পার পাবেন না।
নয়া শতাব্দী/জেআই
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ