শহর থেকে গ্রাম- হাত বাড়ালেই মিলছে ভয়ংকর মাদক এলএসডি-আইস, কোকেন, ইয়াবা, ফেনসিডিলসহ সবধরনের মাদকদ্রব্য। কিন্তু এমন অপরাধের অপরাধীরা আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে পার পেয়ে যাচ্ছে। মাদকসহ ধরা পড়লেও অর্থের বিনিময়ে মাদক মামলা চলে যায় ডিএমপি অ্যাক্টে। আর এর সবই হচ্ছে কিছু অসাধু কর্মকর্তার সহযোগিতায়। যার ফলে দেখা যায়, কোর্টে দাঁড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে ১০০-৫০০ টাকা জরিমানায় মুচলেকায় ছাড়া পেয়ে যাচ্ছে প্রকৃত অপরাধীরা। ছাড়া পেয়েই আবার শুরু করছে পুরোনো কারবার।
এমনই একজন ভুক্তভোগীর বড় ভাই শামসাদ মোস্তফা চুন। বসবাস পল্লবীর বিহারী ক্যাম্প এলাকায়। সম্প্রতি ডিএমপি কমিশনার বরাবর একটি অভিযোগে তিনি উল্লেখ করেন, এসআই মোর্শেদ ও এএসআই সোহেলের দাবি করা ঘুষের পুরো অর্থ দিতে না পারায় তার ভাইকে মাদক মামলায় ফাঁসানো হয়।
অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, অভিযোগকারীর ভাইকে পল্লবী থানার এসআই মোর্শেদ ও এএসআই সোহেল মিলে প্রকাশ্যে মারধর করে। মারধরের ভিডিও অন্য ভাইয়েরা ধারণ করতে গেলে অভিযোগকারীর অন্য ভাইকেও আটক করে নিয়ে যায় তারা। পুলিশের কর্তব্যে বাধা দেয়ার অভিযোগ তুলে আটক করা হয় এক প্রতিবেশীকেও। পরবর্তীতে পুলিশ ‘ধৃত’ আসামিদের ছোট মামলা দেয়ার ‘টোপ’ দিয়ে ৫ লাখ টাকা দাবি করে।
পুলিশ জানায়, ১ লাখ টাকা দিলে ডিএমপি অ্যাক্টে আদালতে প্রেরণ করা হবে। তবে পরে ২০ হাজার টাকার বেশি জোগাড় করতে না পারার কারণে ১ ভাই ও প্রতিবেশীকে ডিএমপি অ্যাক্টে চালান দিলেও অভিযোগকারীর ভাই মুনকে ২০ পিস ইয়াবা ও ৫০ গ্রাম হেরোইন মামলা দিয়ে আদালতে প্রেরণ করা হয়।
অভিযোগকারী শামসাদ বলেন, যদি সত্যি মাদক উদ্ধার হতো তাহলে যেখানে উদ্ধার হয়েছে সেখানে প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষ্য না নিয়ে সাক্ষী করা হয় পুলিশের এক সোর্সকে। সেদিনের ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী স্বাক্ষর করা ১৫ জনই এটিকে ‘পরিকল্পিত মিথ্যা মামলা’ দাবি করে পরে লিখিত দিয়েছে।
জানতে চাইলে পল্লবী থানার এসআই মোর্শেদ জানান, বিষয়টি এমন নয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভাষ্যমতে, মাদক চক্রের সদস্যরা কখনও সাংবাদিক, কখনও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য আবার কখনও চালকের আড়ালে কারবার পরিচালনা করে আসছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রাজধানীর ৫০টি থানা এলাকাতে প্রকাশ্যে চলে মাদক কেনা-বেচা। আর এই মাদকের অধিকাংশ ক্রেতা কিশোর ও যুবক। একটি জরিপের তথ্য তুলে ধরে মাদকাসক্তি চিকিৎসক এস এইচ আহাম্মেদ সুমন দাবি করেন, দেশে কমপক্ষে ৭০ লাখ মাদকাসক্ত ব্যক্তি রয়েছেন। অবশ্য এ জরিপ কতটুকু সঠিক তা নিয়ে মতভেদ রয়েছে।
সরেজমিন রাজধানীর মিরপুরের কাফরুল, পল্লবী, মডেল থানা এলাকা, কাফরুল, ভাসানটেক, রূপনগর, শাহআলী, তুরাগ, উত্তরা, দক্ষিণখান, উত্তরখান, বাড্ডা, হাতিরঝিল, মগবাজার, পল্টন, যাত্রাবাড়ী, শনির আখড়া, শাহবাগ, গুলিস্তান, পুরানঢাকাসহ শতাধিক পয়েন্টে চলছে মাদক বিক্রি ও সেবন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সব এলাকায় মাদকের রমরমা ব্যবসা চলছে। মাঝে মধ্যে র্যাব, পুলিশ ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর (ডিএনসি)-র হাতে ধরা পড়লেও নিরাপদেই চালিয়ে যাচ্ছে কারবার।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে পুলিশের উপ-পরিদর্শক পদমর্যাদার কয়েক কর্মকর্তা জানান, আমরা চাইলেও মাদক নির্মূল বা বন্ধ করা সম্ভব হচ্ছে না। মাদক কারবারিদের গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠানোর কয়েক দিন বা মাস পরে জামিনে বের হয়ে একই কাজে লিপ্ত হয়। আবার আমাদের কিছু অসাধু কর্মকর্তা কারবারিদের কাছ থেকে মাসোহারা নিয়ে শেল্টার দেয়। সব মিলিয়ে এই অবস্থা। কিছু অসাধু পুলিশ কর্তকর্তা টাকার বিনিময়ে মাদক মামলার আসামিদের ডিএমপি অ্যাক্টে চালান করে দিচ্ছে। এতে সাহস পাচ্ছে কারবারিরা।
কয়েক মাদক কারবারি নয়া শতাব্দীকে জানান, আমরা যারা মাদক কারবারের সঙ্গে জড়িত তারা স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কিছু সদস্যকে ম্যানেজ করে চলি। এরপরও মাঝে মধ্যে ধরা পড়লে টাকা দিয়ে মিটমাট করি। অনেক সময় মালসহ ধরা পড়লে পুলিশকে বেশি টাকা দিতে হয়। টাকা খরচ করলে পুলিশ আমাদের ডিএমপি অ্যাক্টে চালান করে দেয়। এতে কোর্টে দাঁড়ালেই জামিন হয়ে যায়। আবার টাকার বিনিময়ে পুলিশ আমাদের ধরা পড়া মাদকের পরিমাণ কম দেখিয়ে জব্দ তালিকা করে দেয়। এতেও আমাদের সহজে জামিন হয়।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের তথ্যানুযায়ী, বন্ধুদের মাধ্যমে প্রভাবিত হয়ে ৫৯ দশমিক ২৭ শতাংশ তরুণ-তরুণী, যুবক-যুবতি মাদকাসক্ত হয়ে পড়ছেন। আর মাত্র ৩৬ দশমিক ৩৬ শতাংশ যুব সমাজ কৌতূহলবশত মাদক সেবনে ঝুঁকছে। সমাজের ১৫-৩০ বছর বয়সিদের মাদকাসক্ত হওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি।
অধিদফতরের ২০২১ সালের একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের জনসংখ্যার ১৬-৪০ বছর বয়সিদের প্রায় ৮৪ দশমিক ২৭ শতাংশ মাদকাসক্ত। এই বয়স সীমার মধ্যে ২১-২৫ বছর বয়সি যুবকরা রয়েছেন ‘সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে’। ১৬-২০ ও ২৬-৩০ বছর বয়সিরা ‘মধ্য ঝুঁকি’, ৩১-৩৫ বছর বয়সিরা রয়েছেন ‘স্বল্প ঝুঁকিতে’।
একটি বেসরকারি হিসাব অনুসারে, বর্তমানে বাংলাদেশের মাদকাসক্ত রয়েছে ৭৫ লাখেরও বেশি। এদের মধ্যে ৮০ শতাংশ যুবক-যুবতি। ৪৩ শতাংশ বেকার, ৬০ শতাংশ বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে জড়িত। ৪০ শতাংশ অশিক্ষিত, ৪৮ শতাংশ মাধ্যমিক শিক্ষায় শিক্ষিত এবং ৫৭ শতাংশ যৌন অপরাধী। মাদকাসক্তদের মধ্যে ৯৮ শতাংশ ধূমপায়ী।
জানা গেছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে ইয়াবার খুচরা কারবারিরা মাঝে মধ্যে ধরা পড়ে। কিন্তু মূল হোতারা থেকে যায় ধরাছোঁয়ার বাইরে। আর যারা গ্রেফতার হয়, তারাও আইনের ফাঁকফোকর গলিয়ে দ্রুতই জামিনে মুক্তি পেয়ে যায়। কারাগার থেকে বেরিয়ে আবার জড়িয়ে যায় মাদক কারবারে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর (ডিএনসি) ঢাকা মেট্রো. কার্যালয় (দক্ষিণ) এর সহকারী পরিচালক সুব্রত সরকার শুভ নয়া শতাব্দীকে বলেন, যারা মাদক কারবারির সঙ্গে জড়িত তারা খুব ধ্রুত। বিভিন্ন পেশার আড়ালে মাদকের কারবার পরিচালনা করে আসছে।
তিনি বলেন, সম্প্রতি কয়েকটি অভিযানে রাজধানী থেকে চট্টগ্রামভিত্তিক ও রাজধানীর কারবারিদের অর্ধ শতাধিক বড় চালান ধরা হয়েছে। বিপুল পরিমাণ মাদক জব্দ করাসহ কারবারিদের গ্রেফতার করেছি। আমাদের অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
নয়াশতাব্দী/এফআই
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ