এক দশক আগে ২০ দলীয় জোট গঠন করে মাঠের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি। দলটির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার হাতে গড়া জোটটি অনানুষ্ঠানিকভাবে ভেঙে দেয়া হয় গত ৯ ডিসেম্বর। যদিও চার বছর ধরেও নিষ্ক্রিয় ছিল জোটের কার্যক্রম। এই সময়ে সক্রিয় করারও কোনো উদ্যোগ নেয়নি জোটের প্রধান মুরব্বি বিএনপি। দীর্ঘ এই এক দশকে সরকারের রোষানলে পড়ে হামলা-মামলা ও কারাগারে যান জোট নেতারা। মামলার খড়গও ঝুলছে জোট নেতাদের। তবে হঠাৎ করে ২০ দলীয় জোট ভেঙে দেয়ায় মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে জোট শরিকদের মধ্যে।
জোট নেতারা বলছেন, এক দশক পর হঠাৎ এভাবে জোট ভেঙে দেয়ায় মনোকষ্ট পেয়েছেন। তাদের অন্তরেও কষ্ট আছে। দীর্ঘদিন পর তবে ভাঙার প্রকৃত কারণ জানানো হয়নি। সরকার পতনে যুগপৎ আন্দোলনে বিএনপির সঙ্গে রাজপথে যোগ দিবেন তারা।
যদিও বিএনপি বলছে, কৌশলগত কারণে ২০ দলীয় জোট ভেঙে দেয়া হয়েছে। সরকার পতনে যুগপৎ আন্দোলনের গতি ও ব্যাপ্তি বাড়াতে এই কৌশল নেয়া হয়েছে।
জোট নেতারা বলছেন, ছোট দলগুলো আলাদা আলাদা জোট গঠন করলে বিএনপির জন্য সমন্বয়ে সহজ হবে। সরকার পতনে যুগপৎ আন্দোলনে সমমনা জোটগুলোকে একত্রিত করতে লিয়াজোঁ কমিটি গঠন করবে বিএনপি। তবে লিয়াজোঁ কমিটিতে প্রতি জোট থেকে দুইজনকে নেয়ার দাবি তুলছেন জোট নেতারা। যদিও বিএনপির পক্ষ থেকেও এখনও কোনো প্রস্তাব পাঠানো হয়নি।
সূত্রমতে, ২০১২ সালে ১৮ এপ্রিল প্রথমে জোট গঠন হয় ১৮ দল নিয়ে। পরবর্তীতে আরও দুইটি দল যোগ দেয়। দলের পরিধি বেড়ে দাঁড়ায় ২০ দলীয় জোট। ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ‘জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট’ নামে আরেকটি জোট গঠন করে বিএনপি। ড. কামালের নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন করার সময়ে নেয়া হয়নি ২০ দলীয় জোট শরিকদের কোনো মতামত ও পরামর্শ। তখন থেকেই দুর্বল হতে থাকে ২০ দলীয় জোটটি। এরপর নির্বাচনে ভরাডুবির পর অনেকটাই একলা চলো নীতিতে এগোতে থাকে জোটের প্রধান শক্তি বিএনপি। এরই মাঝে ২০ দলীয় জোট থেকে ২০২১ সালে বেরিয়ে যায় খেলাফত মজলিশ, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, ২০১৯ সালে আন্দালিব রহমান পার্থের দল (বিজেপি), খেলাফত মজলিশ আরেকটি অংশ। তারও আগে ২০১৮ সালে লেবার পার্টি এবং ২০১৬ সালে মুফতি ফজলুল হক আমিনীর ইসলামী ঐক্যজোট জোট থেকে বেরিয়ে যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সরকারবিরোধী যুগপৎ আন্দোলনের গতি ও ব্যাপ্তি বাড়াতে গত ১০ ডিসেম্বর ঢাকার বিভাগীয় গণসমাবেশের আগের দিন এক অনানুষ্ঠানিক সভায় শরিকদের ডেকে বলে দেয়া হয়, এখন থেকে কেউ যেন ২০ দলীয় জোটের নাম ব্যবহার না করে। এর উদ্দেশ্য, দলগুলো যাতে যার যার অবস্থান থেকে যুগপৎ আন্দোলনে যুক্ত হয়। দীর্ঘদিন এই জোটকে নিষ্ক্রিয় রেখে হঠাৎ করে অনানুষ্ঠানিকভাবে ভেঙে দেয়ার ঘোষণায় শরিক দলগুলোর অনেকে হতাশা প্রকাশ করে। আবার কেউ কেউ নেতিবাচক প্রতিক্রিয়াও জানান। তবে বিএনপির মুরব্বি মেনে ও সমর্থনে জোটের ছোট ছোট দল নিজেদের মধ্যে দুইটি জোট করছে। এরইমধ্যে ২০ দলীয় শরিকদের নিয়ে গড়া ১২ দলীয় জোটের আত্মপ্রকাশ হয়েছে। আগামী ৩০ ডিসেম্বরে আগে আরেকটি ‘জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট’ আসছে।
জানতে চাইলে কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীরপ্রতীক নয়া শতাব্দীকে বলেন, বিএনপি কী কারণে জোট ভেঙে দিয়েছে তা এখনও আমাদের কাছে পরিষ্কার করেনি। আর আমাদের কাছেও সঠিক কারণ জানা নেই।
তিনি বলেন, আমাদের মনে কোনো ক্ষোভ নেই, হাসিমুখেই মেনে নিয়েছি। এবং আমরা নিজেদের মধ্যে ১২ দল জোটবদ্ধ হয়েছি। আমরা যে ১২টি দল জোটবদ্ধ হয়েছি প্রত্যেকে প্রত্যেকের সুপরিচিত গত এক দশক ধরে। ফলে আমাদের জন্য একত্রিত হওয়ার জন্য সহজ হয়েছে।
এক প্রশ্নের জবাবে সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম আরও বলেন, আমরা আশা করি, যুগপৎ আন্দোলনে অংশ নেয়া দলগুলোকে সমন্বয়ে জন্য একটা লিয়াজোঁ কমিটি গঠন করবে বিএনপি। সেই কমিটির সভায় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে, প্রচারের জন্য কেন্দ্রীয়ভাবে কাজ করবে। প্রতিটি জোট থেকে দুইজনকে লিয়ার্জো কমিটিতে রাখার জন্য প্রস্তাব করব।
জানতে চাইলে লেবার পার্টির চেয়ারম্যান ডা. মোস্তাফিজুর রহমান ইরান নয়া শতাব্দীকে বলেন, ২০০৬ সাল থেকে বিএনপির সঙ্গে আছি। সমমনা ৮ থেকে ১৮ দলীয় জোট, এরপর ১৯ দলীয় জোট ও সর্বশেষ ২০ দলীয় জোট। জোটের সবচেয়ে পুরোনো নেতা আমি। পাঁচবার গ্রেফতার ও যুবলীগের হামলার শিকার হয়েছি। তারপরও মনে কষ্ট নেই। বিএনপি বর্তমান প্রেক্ষাপটে মনে করছে, ২০ দলীয় জোট নিয়ে তারা আর কাজ করবে না। এরপর আমরা আমাদের মতো করে জোট গঠন করেছি। বিএনপির সঙ্গে আগেও যেমন সুসম্পর্ক ছিল, আগামীতেও থাকবে। বিএনপি সরকার পতনের জন্য যে আন্দোলন করছে তাতে আমরা আছি।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আগে বিএনপির ২০ দলকে সমন্বয় করত, এখন একটা জোটকে সমন্বয় করবে। এটাও আরও বিএনপির জন্য সহজ হয়েছে। সমমনা জোটগুলোকে সমন্বয় করতে লিয়াজোঁ কমিটির বিষয়ে এখন পর্যন্ত আমার কাছে কোনো খবর নেই। আগামী ৩০ তারিখের আগে লিয়াজোঁ কমিটি হবে বলেও মনে করছি না। এটা বিএনপির একান্ত বিষয়। তবে সমন্বয়ে কোনো সমস্যা হবে না বলেও মনে করছি।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ জাতীয় দলের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট সৈয়দ এহসানুল হুদা নয়া শতাব্দীকে বলেন, ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর থেকেই বৃহত্তর বা যুগপৎ আন্দোলনের লক্ষ্যে জোটটি কিছুটা অকার্যকর হয়ে যাচ্ছিল। আন্দোলনের প্রশ্ন আসায় কৌশলগত কারণে জোটের কিছু সঙ্গী বুদ্ধি-পরামর্শে ‘একলা চলো’ নীতি এগোয় বিএনপি। সর্বশেষ যুগপৎ আন্দোলনের ঘোষণা দিয়েছে বিএনপি। সেখানে আমরা যার যার অবস্থান থেকে যুগপৎ আন্দোলন, বিএনপির ১০ দফা ও ২৭ দফার সঙ্গে সম্পূর্ণ একাত্ম ঘোষণা করেছি।
তিনি বলেন, জোট শরিকদের সবার সক্ষমতা ও সামর্থ্য একই না। কারও কারও সীমিত সামর্থ্যও থাকতে পারে। ফলে আমরা দীর্ঘদিন একসঙ্গে পথ চলার কারণে সখ্য ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে। যার ফলে ১২টি দল নতুনভাবে জোট গঠন করেছে। সরকারবিরোধী যুগপৎ আন্দোলনে বিএনপির সঙ্গে আমরা যোগ দেবো। বিএনপির কর্মসূচিকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাব।
২০ দলীয় জোটে কেন আলাদা দুইটি জোট হলো- প্রশ্নের জবাবে সৈয়দ এহসানুল হুদা আরও বলেন, আমি মনে করি, দীর্ঘ ১০ বছর যেহেতু একসঙ্গে ছিল, তাদের আমাদের সঙ্গে যোগ দেয়া উচিত ছিল। তবে তারা আলাদা হয়ে মেসেজটা ভালো দেয়নি। আমরা মনেপ্রাণে চেয়েছিলাম, ২০ দলীয় শরিকরা সবাই একাত্ম হয়ে যুগপৎ আন্দোলনে শামিল হই।
তিনি আরও বলেন, আগামী ৩০ ডিসেম্বর পরিষ্কার হবে যুগপৎ আন্দোলনের প্রথম কর্মসূচিতে কয়টি দল যোগ দিল। এর আগে লিয়াজোঁ কমিটি গঠন হবে না। এখনও বিএনপির পক্ষ থেকে লিয়াজোঁ কমিটির কোনো প্রস্তাব দেয়া হয়নি। প্রস্তাব পেলে আমরা ১২ দলীয় জোটে মিটিংয়ে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেব।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির একাধিক নীতিনির্ধারক জানান, কৌশলগত কারণে ২০ দলীয় জোট ভেঙে দেয়া হয়েছে; যা শরিকদের অবহিত করা হয়। তবে তারা যে যার অবস্থান থেকে যুগপৎ আন্দোলনে মাঠে থাকবে। মূলত সাংগঠনিক শক্তির দিক থেকে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, এলডিপির অবস্থান রয়েছে। এজন্য অন্য শরিকদের বলা হয়েছে তারাও যুগপৎ আন্দোলনে যেন অংশ নেয়। সেক্ষেত্রে কয়েকটি দল মিলেও পৃথকভাবে মোর্চা গঠন করে একসঙ্গে মাঠে থাকতে পারবে- সেই পথেই যাচ্ছে। এতে সরকারের পদত্যাগসহ ১০ দফা দাবি আদায়ে সব দলকেই পাশে পাওয়া যাবে।
জানা গেছে, ২০ দলীয় জোটের শরিক দলগুলোর ভাগাভাগি হয়ে আলাদা জোটভুক্ত হওয়ার বিষয়ে বিএনপির সায় আছে। এর কারণ, যেহেতু বিএনপি কৌশলগত কারণে ২০ দলীয় জোট এবং জাতীয় ঐক্যফ্রন্টকে আর কার্যকর রাখছে না, তাতে ছোট দলগুলো একা হয়ে যাচ্ছে। ফলে সমমনা এতগুলো ছোট দলের সঙ্গে বিএনপির পক্ষে আলাদা বৈঠক করা বা যুগপৎ আন্দোলন কর্মসূচির বিষয়ে সমন্বয় করাও কঠিন হবে। বরং দলগুলো পৃথক জোটভুক্ত হলে তাদের সঙ্গে বিএনপির সমন্বয় করা সহজ হবে। মোট ৩৬টি দল নিয়ে চার বা পাঁচটি প্ল্যাটফর্মে আন্দোলনে লক্ষ্য বিএনপির। এরইমধ্যে, ৭ দলীয় গণতন্ত্র মঞ্চ, ১২ দলীয় জোট, ৬ দলীয় জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট গঠন হয়েছে। এছাড়াও ইসলামী দলগুলোর জোটও গঠনের আলোচনা চলছে। তবে বিএনপি, জামায়েতে ইসলামী ও অলি আহমেদের নেতৃত্বাধীন (এলডিপি) এককভাবে কার্যক্রম পরিচালনা করবে বলেও জানা গেছে।
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও ২০ দলের সমন্বয়ক নজরুল ইসলাম খান বলেন, আমরা এখন জোটগতভাবে না, যুগপৎ আন্দোলন করব। যার যার অবস্থান থেকে এই আন্দোলন এগিয়ে নেব। ২০ দলীয় জোটের শরিকদের সঙ্গে আলোচনা করেই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এই সরকরের বিরুদ্ধে, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার আন্দোলেন যারা শেষ পর্যন্ত রাজপথে থাকবে তাদের নিয়ে জাতীয় সরকার গঠন করা হবে।
নয়াশতাব্দী/এফআই
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ