ঢাকা, রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

বিষাক্ত বর্জ্যে পশুখাদ্য!

প্রকাশনার সময়: ২৩ ডিসেম্বর ২০২২, ০৯:০১

ট্যানারির বর্জ্য গোপনে পাচার করছে সাভার ট্যানারি ইন্ডাস্ট্রিয়াল এস্টেটকে ঘিরে গড়ে ওঠা একটি চক্র। আর এই ট্যানারির বর্জ্যে রয়েছে উচ্চমাত্রার ক্রোমিয়াম। যা দিয়ে তৈরি করা হচ্ছে পশুখাদ্য। ফলে মাছ ও মুরগির মাধ্যমে ট্যানারির ক্রোমিয়ামযুক্ত বিষাক্ত বর্জ্য মানবদেহে প্রবেশের মাধ্যমে ক্যান্সারসহ জটিল রোগের আশঙ্কা তৈরি করছে। ট্যানারির বর্জ্যে পশুখাদ্য তৈরি করা মাছ ও মুরগির খামার বন্ধ করতে হাইকোর্ট নির্দেশনা দিলেও তা মানা হচ্ছে না।

জানা গেছে, ট্যানারি-ঘিরে গড়েওঠা চক্র ক্রোমিয়ামযুক্ত কঠিন বর্জ্য সংগ্রহ করে সাভার, কেরানীগঞ্জ, কুমিল্লা, নরসিংদী, সিরাজগঞ্জসহ বিভিন্ন এলাকায় সরবরাহ করছে। এসব বর্জ্য গলিয়ে পাঠানো হচ্ছে পশুখাদ্য তৈরি ও মশার কয়েল তৈরির কারখানায়।

সূত্র জানায়, সাধারণত চুক্তি ভিত্তিতে ট্যানারির কঠিন বর্জ্য (শেভিং ক্রাস্ট ও কাটিং) পরিবহন করে নির্ধারিত ডাম্পিং স্টেশনে অপসারণ করে গাড়ির মালিকরা। এক থেকে দেড় টনের একেকটি গাড়িপ্রতি বর্জ্য অপসারণে ব্যয় ১৫০০ টাকা। যা ট্যানারি মালিককে ব্যয় বহন করতে হয়। আর এসব বর্জ্য চক্রটি বিনা খরচেই কারখানা থেকে সংগ্রহ করছে।

বিষয়টিকে উদ্বেগজনক উল্লেখ করে বাংলাদেশ ট্যানার্স এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ও সালমা ট্যানারির মালিক শাখাওয়াত উল্লাহ বলেন, ‘সবাইকে সতর্ক করে এক কেজি বর্জ্যও যেন ট্যানারি থেকে বের হতে না পারে, সেই নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এসোসিয়েশনের কারও বিরুদ্ধে বর্জ্য বাইরে পাঠানোর অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

অভিযোগ রয়েছে, চামড়া শিল্প নগরীর হাতেগোনা কয়েকটি ট্যানারি ব্যতীত অধিকাংশ ট্যানারিই ব্যয় কমাতে কঠিন বর্জ্য চক্রটির হাতে তুলে দিচ্ছে। এসব ট্যানারির মধ্যে অন্যতম প্রগতি লেদার, আর কে লেদার, শাহজালাল ট্যানারি, ইন্টারন্যাশনাল লেদার, রিলায়েন্স ট্যানারি, সমতা ট্যানারি, সমতা-২, হেমকো লেদার, স্বাধীন ট্যানারি, জুলিয়েট ট্যানারি, মার্চারি ট্যানারি ও নিউ কাজল ট্যানারিসহ বেশ কিছু কারখানা।

জানা গেছে, প্রগতি লেদার থেকে সংগ্রহকৃত প্রায় ৮ টন বর্জ্য পরিবহনকালে গত ২২ সেপ্টেম্বর দুটি গাড়ি আটক করে বিসিক। গাড়িগুলো আটক করে স্থানীয় পুলিশ ফাঁড়িতে হস্তান্তরের পাশাপাশি একটি মামলা দায়ের করা হয় (মামলা নং-৯৮)।

মূলত, ট্যানারির বর্জ্য ডাম্পিং ইয়ার্ডে ফেলার নিয়ম থাকলেও নিরাপত্তা কর্মী ও কর্মকর্তাদের যোগসাজশে শিল্পনগরীর বাইরে চলে যাচ্ছে। ঢাকা ট্যানারি ইন্ডাস্ট্রিয়াল এস্টেট ওয়েস্টেজ ট্রিটমেন্ট প্লান্ট কোম্পানির সুপারভাইজার, শিল্প নগরীর নিরাপত্তাকর্মী, বর্জ্য পরিবহনকারী পিকআপ মালিক, গাড়ির চালক, শিল্প নগরী সংলগ্ন এলাকা ও হাজারীবাগের বেশ কয়েকজন ব্যক্তি এসব কঠিন বর্জ্য পাচার করছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ক্রোমিয়ামযুক্ত শেভিং ক্রাস্ট, চামড়ার বিভিন্ন কাটিং অংশ সংগ্রহের পর তা একটি চুলায় গলানো হয়। এসব গলিত বর্জ্য রোদে শুকিয়ে মেশিনের সাহায্যে অনেকটা গুঁড়ো করে পাঠানো হয় বিভিন্ন মাছ-মুরগির খাদ্য তৈরির কারখানায়। পরবর্তীতে অন্যান্য প্রয়োজনীয় কাঁচামাল মিশিয়ে তৈরি হয় পশুখাদ্য পোলট্রি ও ফিশ ফিড।

এ বিষয়ে ওয়েস্টেজ ট্রিটমেন্ট প্লান্ট কোম্পানির প্রধান প্রকৌশলী সত্যেন্দ্র নাথ পাল বলেন, আর্থিক সুবিধা নিয়ে এসব বর্জ্য পাচারে সহযোগিতা করাসহ বিভিন্ন অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে গত ১১ সেপ্টেম্বর সিকিউরিটি ইনচার্জ মো. কামাল হোসেনকে চাকরিচ্যুত করা হলেও চক্রটির দৌরাত্ম্য বন্ধ করা যায়নি।’

চামড়া শিল্পনগরী বিসিকের নির্বাহী প্রকৌশলী মাহফুজুর রহমান রিজওয়ান বলেন, ‘বর্জ্য পাচার বন্ধে ডাম্পিং স্টেশনে যেন বড় ট্রাক প্রবেশ করতে না পারে সেই ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে সিইটিপি পরিচালনা কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করেছি। প্রতিটি গেট নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বন্ধ করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করছি।’

বর্জ্য পরিবহনে জড়িত গাড়িচালক মো. নয়ন বলেন, ২০১৯ সালে র‍্যাবের ধারাবাহিক অভিযানের পর কিছু দিন বন্ধ ছিল বর্জ্য পাচার। তবে সম্প্রতি আবারও একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেটের হাত ধরে এই কার্যক্রম শুরু হয়েছে।

সরেজমিন অনুসরণ: গত ১৪ অক্টোবর চামড়া শিল্পনগরী থেকে ক্রোমিয়াম যুক্ত বর্জ্য (শেভিং ক্রাস্ট) বোঝাইকৃত একটি পিকআপ অনুসরণ করে দেখা গেছে, ধলেশ্বরী নদীর তীরে কেরানীগঞ্জের কলাতিয়া মধুরচর এলাকার একটি কারখানায় যেখানে ২৫ জন শ্রমিক কাজ করছে সেখানে একটি পিকআপ প্রবেশ করে। এই কারখানাটির মালিক নাহিদ বলেন, ‘বর্জ্য গলিয়ে প্রতি মাসে ৪০ থেকে ৫০ টন পরিমাণ আঠা উৎপাদিত হয়, যা চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড ও সিরাজগঞ্জ এলাকায় পাঠানো হয়।’ তিনি বলেন, ‘ট্যানারি থেকে শেভিং ক্রাস্ট ও হাজারীবাগ থেকে চামড়ার কাটিং অংশ সংগ্রহ করে গলিয়ে পশুখাদ্য ও মশার কয়েল তৈরির কারখানায় পাঠানো হয়।’

হেমকো, আর কে ও প্রগতিসহ কয়েকটি ট্যানারির বর্জ্য পরিবহনের কন্ট্রাক্টর রিপন জানান, এই কাজে তার মোট ৩টি পিকআপ ব্যবহূত হয়।

কামাল নামে এক গাড়িচালক বলেন, ‘হেমায়েতপুরের ঝাউচর এলাকার উজ্জল, পারভেজ, মান্নান ও হাজারীবাগ এলাকার আরেক ব্যক্তি রয়েছে এই সিন্ডিকেটে। ইন্টারন্যাশনাল ট্যানারির গাড়িচালক কামাল ও নূর আলম নামে এক কন্ট্রাক্টরসহ আরও বেশ কয়েকজন রয়েছেন এই সিন্ডিকেটে।’

কামাল জানান, হেমায়েতপুরের সিন্ডিকেটের কাজ শুধু কারখানার বর্জ্য বের করতে সংশ্লিষ্টদের ‘ম্যানেজ’ করা। গাড়ি বের করতে সিইটিপি কোম্পানির সুপারভাইজার হিমেল, আল আমীন, বিভিন্ন গেটের দায়িত্বে থাকা সিকিউরিটি গার্ড ও পুলিশকে ম্যানেজ করতে হয়।

সাভারের মধুমতি মডেল টাউন ও কেরানীগঞ্জের হাসনাবাদ বালুর চর ও কোনাখোলা এলাকায় ক্ষতিকারক বর্জ্য গলানোর একাধিক স্পটের সন্ধান পাওয়া গেছে। যেখান থেকে প্রতিমাসে শত শত টন বর্জ্য গলিয়ে দেশের বিভিন্ন এলাকায় সরবরাহ করা হয়। সাভারের মধুমতি মডেল টাউনের ভিতরে গড়ে তোলা বর্জ্য গলানোর স্পটটিতে দেখা যায়, ভাকুর্তা মোগড়াকান্দা এলাকার আবুল নামে এক ব্যক্তি এর দেখভাল করেন। তিনি দাবি করেন, মূলত জমিটিসহ এই স্পটের মালিক সাভারের ভাকুর্তা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হাজী আবদুল বাতেন।

এ বিষয়ে মুঠোফোনে আবদুল বাতেনের কাছে জানতে চাইলে তিনি এই বর্জ্য গলানোর সঙ্গে জড়িত না দাবি করে মুঠোফোনের সংযোগটি কেটে দেন। এই চক্রের সঙ্গে জড়িত থাকা, গাড়িপ্রতি টাকা নেয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন ঢাকা ট্যানারি ইন্ডাস্ট্রিয়াল এস্টেট ওয়েস্ট ট্রিটমেন্ট প্লান্ট কোম্পানি লিমিটেডের সুপারভাইজার (কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা) হিমেল ও সুপারভাইজার (ইলেকট্রিক) আল আমীন।

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ