ছদ্মনাম (নাফিসা বেগম)। স্বামীসহ দুই সন্তান নিয়ে বাস করেন রাজধানীর মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধ বস্তিতে। এখানে বেশিরভাগ সময়ই পানির সংকট। সমস্যা সমাধানে কারও কোনো ভ্রুক্ষেপ না থাকায় সমস্যা নিয়েই তাদের বসবাস। পানি ব্যবস্থাপনায় কাজ করা ঢাকা ওয়াসার অবহেলার বলি হতে হচ্ছে বস্তিবাসীকে। বস্তির অধিকাংশ নারীকেই পানি সংগ্রহ করতে গিয়ে যৌন হয়রানির শিকার হতে হয়। নাফিসা বেগম নয়া শতাব্দীকে বলেন, আমাদের এখানে গভীর নলকূপের মাধ্যমে ব্যক্তি উদ্যোগে জেনারেটর দিয়ে তোলা পানি দিনে দু’বার সরবরাহ করা হয়। অনেক সময় আবার নলকূপেও পানি কম আসে। যতটুকু পানি আসে সেটা লম্বা লাইন ধরে সংগ্রহ করতে হয়। পানির পূর্ণ চাহিদা না মেটায় রাতে বেলার অন্য জায়গায় থেকে বালতি করে পানি আনতে হয়। অনেক সময় পানি টানতে গিয়ে আমাদের যৌন হয়রানির শিকার হতে হয়। একই অবস্থা রাজধানীর অধিকাংশ বস্তির। নগরের অর্ধেকের মতো বস্তিতে ঢাকা ওয়াসা পানি সরবরাহ করলেও তা অপ্রতুল। পানি সংগ্রহে যৌন হয়রানির অভিযোগ নাফিসা বেগমের একার নয়। রাজধানীর বস্তিবাসী নারীদের এমন শত অভিযোগ রয়েছে। দরিদ্র, নিম্নবিত্ত, যারা প্রতিবাদ করতে পারে না, তাদের মুখ বুঝে সহ্য করতে হয়। সামাজিকভাবে দোষারোপ করার ভয়ে এ নিয়ে অনেকেই কথা বলতে চান না।
সম্প্রতি রাজধানীর দুই বস্তিতে সমীক্ষা চালিয়ে গ্রামীণ উন্নয়ন সংস্থা (ডরপ) এক গবেষণা বলছে, পানি সংগ্রহ করতে গিয়ে বস্তির পাঁচ শতাংশ নারী যৌন হয়রানির শিকার হন। সাধারণত যেসব নারী দরিদ্র, নিরক্ষর বা যাদের বাড়িতে নিরাপদ পানির ব্যবস্থা নেই, হয়রানির শিকার হওয়ার ঝুঁকি তাদেরই বেশি। সমীক্ষায় অংশ নেয়া ৪ দশমিক ৪ শতাংশ উত্তরদাতা যৌন হয়রানির প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার কথা জানান।
ডরপের গবেষণা পরিচালক মোহাম্মদ যোবায়ের হাসান বলেন, পানির সুবিধা, গোসল ও টয়লেট সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে ভোগান্তির শিকার বস্তির নারীরা। ভুক্তভোগীরা লজ্জা, ট্রমা, অবাঞ্ছিত গর্ভধারণসহ নানা সামাজিক সংকটে পড়েন। কম দামে বড়লোক ওয়াসার পানি পাবে, আর গরিবরা হাহাকার করবে, এটা তো ঠিক না। পানির প্রাপ্যতা, গুণগতমান ও ক্রয়ক্ষমতা নিশ্চিত করা গেলে বস্তিবাসী পানির অধিকার পাবে বলে আমি মনে করি।
রাজধানীর বস্তি এলাকায় ২০১৬ সালের মধ্যে শতভাগ পানি সরবরাহের প্রতিশ্রুতির কথা ঢাকা ওয়াসা জানালেও এখন বলা হচ্ছে ২০২৩ সালের মধ্যে ঢাকার সব বস্তি ওয়াসার সুপেয় পানির আওতায় আসবে।
ঢাকা ওয়াসার দাবি, ৬০ শতাংশ বস্তি এলাকায় তারা পানি সরবরাহ করছে। ২০২৩ সালের মধ্যে ঢাকার নিম্নআয়ের বসতি এলাকায় শতভাগ পানি সরবরাহ নিশ্চিত করার লক্ষ্যমাত্রা সংস্থাটির। ঢাকা ওয়াসার উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ) এ কে এম শহীদ উদ্দিন অবশ্য সব বস্তিতে পানির লাইন না দেয়ার জন্য দুষলেন ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনকে। তিনি বলেন, সিটি করপোরেশন রাস্তা কাটার অনুমতি দিলে এ বছরই সব বস্তিতে পানির লাইন দেব। রাস্তা কাটতে না দিলে ওপরওয়ালা জানেন, কবে শেষ হবে বস্তিতে পানি সরবরাহের কাজ।
রাজধানীর কড়াইল বস্তির নাম প্রকাশে এক অনিচ্ছুক নারী জানান, ওয়াসার বৈধ লাইনে আমরা পানি পাই না। রাতে অবৈধ লাইনের খুবই সামান্য পানি সংগ্রহ করি। ওই সময় আমাদের মেয়েদের নানা রকম হয়রানি-সহিংসতার শিকার হতে হয়। এসব বললে ভুক্তভোগীকেই সামাজিকভাবে দোষারোপ করা হয়। তাই এ নিয়ে কিছু বলি না।
মিরপুর বস্তিতে বসবাসরত মোনালিছা নামের একজন বলেন, প্রায় সময়ই রান্না-বান্নার কাজে যে পানির প্রয়োজন পড়ে সেটা কূপের পানি দিয়ে চাহিদা মেটানো যায় না। এখানে গোসল করতেও জমানো পানি খরচ করতে হয়। আমরা না পারি ভালোভাবে গোসল করতে, না পারি ঠিকমতো রান্না করতে। পানির সমস্যা সমাধান নিয়ে আমরা অনেককেই অনেক কথা বলেছি, কোনো কাজ হয়নি। কি করব গরিব মানুষ আমরা, তাই সমস্যা নিয়েই বেঁচে থাকতে হয়।
জানতে চাইলে কোয়ালিশন ফর দ্য আরবান পুওর (কাপ)-এর নির্বাহী পরিচালক খোন্দকার রেবেকা সান ইয়াত বলেন, ঢাকার ৫০ শতাংশ বস্তিতে বৈধ পানি নেই। কিছু বস্তিতে পানির লাইন আছে, যা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। ওয়াসার পুরোনো লাইনের কারণে পানির অবস্থা খুবই খারাপ। অনেকে মসজিদ-মাদ্রাসা বা অন্য জায়গা থেকে পানি কিনে ব্যবহার করে। বস্তিবাসীকে চড়া দামে পানি কিনতে হয়।
নয়া শতাব্দী/আরআর
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ