ঢাকা, রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

বুশরা কেন জেলে?

প্রকাশনার সময়: ১৭ ডিসেম্বর ২০২২, ০৮:৩৩ | আপডেট: ১৭ ডিসেম্বর ২০২২, ০৮:৩৯

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ছাত্র ফারদিন নূর পরশের মরাদেহ উদ্ধারের ঘটনাটি আত্মহত্যা বলে দাবি করছে মামলার তদন্তকারী সংস্থা ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। ডিবির দাবির সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেছে র‍্যাবও।

এমন পরিস্থিতিতে মামলা তদন্ত ও তথ্য প্রমাণ দেখতে গতকাল বৃহস্পতিবার গোয়েন্দা কার্যালয়ে যান বুয়েটের একদল শিক্ষার্থী। তারাও বিষয়টি গ্রহণযোগ্য বলে মনে করে বক্তব্য দিয়েছে। এমন পরিস্থিতে জনমনে নানা ধরনের প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। কোনো ধরনের তদন্ত ছাড়াই শুধু এজাহারে নাম থাকার কারণে কেন ফারদিনের বান্ধবী আমাতুল্লাহ বুশরাকে গ্রেফতার করে ৫ দিনের রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলো!

পাশাপাশি পুলিশের পক্ষ থেকে কেনইবা তাকে কারাগারে আটক রাখার জন্য আদালতে অনুরোধ করা হলো। শুধু পুলিশের ওই অনুরোধের কারণেই এখনও জেলে রয়েছেন বুশরা। এতে তার সামাজিক, পারিবারিক ও শিক্ষাজীবনে মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে বলে দাবি করেছেন তার পরিবারের সদস্যরা। যার দায় কোনোভাবেই তদন্তকারীরা এড়াতে পারে না বলে দাবি সংশ্লিষ্টদের।

নিয়মানুযায়ী, অপরাধের ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে শাস্তি নিশ্চিত করার পূর্ব শর্ত হলো সুচারুভাবে তদন্ত প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা। একই সঙ্গে নির্ভুল তথ্য সংবলিত মামলা দায়ের করাও জরুরি। তবে প্রায়ই দেখা যায়, কোনো অভিযোগ দায়েরের পর গ্রহণযোগ্য তথ্য-উপাত্ত ছাড়া সন্দেহবশত অনেককে গ্রেফতার করা হয়। এরপর জিজ্ঞাসাবাদ করতে রিমান্ডে নেয়ার আবেদন করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

মামলার তদন্ত চলাকালেও অভিযুক্তদের ছবিসহ প্রতিবেদন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। এর ব্যতিক্রম হয়নি বুশরার ক্ষেত্রেও। মামলা দায়েরর আগে তাকে দুই দিন ধরে দুই দফা জিজ্ঞাসাবাদ করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা ও রামপুরা থানা পুলিশ। সেখানে তার কাছে কোনো ধরনের তথ্য পাওয়া যায়নি বলে গণমাধ্যমকে বারবার নিশ্চিত করা হয়। তারপরও মামলা দায়েরের ২ ঘণ্টার মধ্যেই তাকে গ্রেফতার দেখানো হয়।

জানতে চাইলে সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) এ কে এম শহীদুল হক বলেন, সব আসামিকে সন্দেহভাজন হিসেবেই গ্রেফতার করা হয়। এরপর তার বিরুদ্ধে থাকা অভিযোগের প্রমাণপত্র সংগ্রহ করে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়া হয় আদালতে। আর প্রমাণ না পেলে দিতে হয় ফাইনাল রিপোর্ট। আইনের বিধান এমনই। তবে মনগড়া সন্দেহের বশে যাকে ইচ্ছা তাকে গ্রেফতার করা যাবে না। গ্রেফতারের আগে অবশ্যই অভিযোগের ভিত্তি খতিয়ে দেখতে হবে। অভিযোগের সাপেক্ষে উপযুক্ত কারণ বা প্রমাণ থাকতে হবে।

তিনি বলেন, বাদী অনেক সময় ভুল করে বা ইচ্ছে করে আসামির তালিকায় এমন নাম দেন, যিনি অপরাধে জড়িত নন। সেজন্য তদন্ত সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ যাচাই করে ব্যবস্থা নিতে হবে। এখন ফারদিনের মামলার তদন্ত অনেকটাই শেষ পর্যায়ে বলে গণমাধ্যমে দেখছি। এক্ষেত্রে দ্রুত ফাইনাল রিপোর্ট দিলে বুশরার মুক্তি ত্বরান্বিত হবে।

মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ উমর ফারুক বলেন, দেশে অপরাধের বিচার ব্যবস্থার মধ্যে তদন্ত একটি দুর্বল জায়গা। অনেক ভুক্তভোগী সঠিক বিচার পান না দুর্বল চার্জশিটের কারণে। প্রাথমিকভাবে যাদের সন্দেহভাজন মনে হয়, শুরুতেই তাদের গ্রেফতার না করে বা রিমান্ডে না নিয়ে বিজ্ঞাননির্ভর পদ্ধতিতে তথ্য-উপাত্ত যাচাই করে দেখতে হবে।

তিনি বলেন, প্রয়োজনে অভিযুক্ত ব্যক্তির বাসায় বা অন্য কোনো নিরাপদ স্থানে গোপনীয়ভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করা যেতে পারে। এমন কিছু করা যাবে না, যাতে তার মানহানি ঘটে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ ও তথ্যানুসন্ধানে সম্পৃক্ততা নিশ্চিত হলেই তাকে আদালতে নেয়া উচিত। এর আগে যদি গ্রেফতার করা হয় এবং পরে তার অপরাধ খুঁজে না পাওয়া যায়, সেক্ষেত্রে ভুক্তভোগী সামাজিক ও ব্যক্তিগতভাবে হেয় প্রতিপন্ন হন। এক ধরনের জড়তায় ভোগেন, তার জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে।

বুশরার মা মোসাম্মৎ ইয়াসমিন বলেন, চার বছরের বেশি সময় ধরে বুশরা ও ফারদিনের মধ্যে পরিচয়। বিতর্ক প্রতিযোগিতা নিয়ে কথা হতো তাদের। পরে তাদের মধ্যে ভালো বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তাদের মধ্যে ফোনে ও মেসেঞ্জারে নিয়মিত কথা হতো। তাও জানত বুশরার পরিবার। দু’জনের মধ্যে কোনো প্রেমের সম্পর্ক ছিল না। কিন্তু একটা ঘটনার পর বুশরাকে আসামি করে মামলা করা হলো। তাকে গ্রেফতার করে রিমান্ডে আনা হলো। এখন জানতে পারছি ফারদিন আত্মহত্যা করেছে। এমন পরিস্থিতিতে মেয়েটের ভবিষ্যৎ নিয়ে আমরা চিন্তিত। তার সহপাঠীরা তাকে কীভাবে গ্রহণ করবে সেটাও দেখার বিষয়। মেয়েটা হয়তো আর আগের মতো স্বাভাবিক হতে পারবে না।

জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের প্রধান হারুণ-অর-রশিদ বলেন, ফারদিন নিখোঁজ ও লাশ উদ্ধারের পর দুই দফা কথা বলা হয় বুশরার সঙ্গে। কিন্তু তেমন কিছু পাওয়া যায়নি। বিষয়টি ফারদিনের বাবার নুর উদ্দিন নুরুকে জানানো হয়। কিন্তু তিনি বুশরাকেই আসামি করে মামলা করবেন বলে গো ধরে বসেন। এক্ষেত্রে পুলিশ অনেকটা বাধ্য হয়েই বাদীর লিখে দেয়া অভিযোগ গ্রহণ করে এবং বুশরাকে গ্রেফতার করে।

তিনি বলেন, ঘটনার পর আমরা কখনোই বুশরাকে দোষী বলেনি। তার কাছে থেকে শুধু ফারদিনের হতাশার কথা জানতে পেরেছে। এ কারণে আমরা তাকে দ্বিতীয় দফা রিমান্ডের আবেদন করেনি। এখন দ্রুতই এই মামলার ফাইনাল রিপোর্ট দেয়া হবে। একই কথা বলেন রামপুরা থানার ওসি রফিকুল ইসলামও। তার দাবি বাদীর জিদের কারণেই বুশরাকে আসামি করে মামলা নিতে তারা বাধ্য হয়েছিলেন।

এদিকে, গত বুধবার দুপুরে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে ফারদিনের মরদেহ উদ্ধারের ঘটনায় দায়েরকৃত মামলার অগ্রগতি বিষয়ে জানানো হয়। ডিবির প্রধান হারুণ-অর-রশিদ বলেন, প্রাথমিক তদন্তে ফারদিনের আত্মহত্যার বিষয়টি উঠে এসেছে। ঘটনার রাতে ফারদিন কেরানীগঞ্জ, জনসন রোড ও এরপর ডেমরা ছিলেন। এরপর তাকে লেগুনায় উঠতে দেখা যায়। পুলিশ ওই লেগুনা চালকসহ যাত্রীদের জিজ্ঞাসাবাদ করে। একপর্যায়ে জানা ফারদিনকে সুলতানা কামাল ব্রিজের মুখে নামিয়ে দেন বলে জানান। ঘটনার সত্যতা পাওয়ার পর আমরা ব্রিজের আশপাশের কিছু ফুটেজ সংগ্রহ করি। সেখানে দেখা যায়, ব্রিজের মাঝামাঝি থেকে কাউকে পানিতে লাফিয়ে পড়তে।

এরপর সময় এবং প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্যমতে, ওই যুবক ফারদিন ছিল বলে আমরা নিশ্চিত হয়েছি। এ ঘটনার পর বুধবার রাতেই সংবাদ সম্মেলন করে র‍্যাব। তারাও ফারদিন আত্মহত্যা করে বলে দাবি করেন। সংশ্লিষ্ট একটি সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সরবরাহ করেন। সেই ফুটেজে পানিতে কিছু পড়ার দৃশ্য দেখা যায়। কিন্তু সেটি ফারদিন ছিল কিনা তা গণমাধ্যমের পক্ষ থেকে নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে ব্রিজের মাঝ থেকে ফারদিন পানিতে লাফিয়ে পড়েন এবং তার মৃত্যু হয়।

ডিবির সঙ্গে একমত বুয়েট শিক্ষার্থীরা: এদিকে বুয়েট শিক্ষার্থী ফারদিনের উদ্ধার আলামতগুলো দেখে মনে হয়েছে প্রায় সবকিছু ঠিক আছে। তবে কিছু জায়গায় গ্যাপ রয়েছে মনে হয়েছে। প্রাইমারি গ্যাপ হলো যে ব্রিজে ফারদিনকে নামিয়ে দেয়া হয়েছে সেই ব্রিজে তিনি (ফারদিন) কীভাবে গেল, কার সঙ্গে গেল। গতকাল বৃহস্পতিবার ডিবি অফিস থেকে বেরিয়ে বুয়েট শিক্ষার্থীরা এসব কথা বলেন।

বুয়েটের এক শিক্ষার্থী বলেন, ডিবি কর্মকর্তারা আমাদের আলামতগুলো দেখিয়েছেন। সবকিছু দেখে আমাদের কাছে প্রাসঙ্গিক মনে হয়েছে। আমাদের মনে হয়েছে, তদন্তে ডিবি তাদের বেস্ট এফোর্ট দিয়েছে। তবে তাদের কিছু গ্যাপ আছে, যেগুলো হয়তো আগামীতে সমাধান করবে তারা।

গ্যাপ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আরেক শিক্ষার্থী বলেন, তাদের এভিডেন্স সবকিছুই প্রাসঙ্গিক মনে হয়েছে। তবে ফারদিনকে ব্রিজের পাড়ে নামিয়ে দেয়ার পর হেঁটে সে ব্রিজের মাঝখানে গিয়েছে। তার সঙ্গে আর কেউ ছিল কিনা, তা স্পষ্ট নয়। তবে আমরা ডিবির কার্যকলাপ ও সহযোগিতায় আশ্বস্ত।

তিনি বলেন, তারা (ডিবি) এখনও মামলার রিপোর্ট জমা দেয়নি, সেখানে হয়তো কিছু না কিছু বাদ আছে। এজন্যই তারা এখনও রিপোর্ট জমা দেয়নি। ডিবি প্রথম দিন থেকে যে কাজ করছে, তা আমাদের দেখিয়েছে। তাদের অগ্রগতির ধরন দেখে আমরা সন্তুষ্ট। তাদের ধন্যবাদ।

আরেক শিক্ষার্থী বলেন, ফারদিনের আত্মহত্যার হানড্রেড পার্সেন্ট মোটিভ নেই। যেসব এভিডেন্স আছে, তাতে সারকামস্ট্যান্সেস (স্থান বা অবস্থা) এভিডেন্স নেই। এ জায়গায় আরেকটু কাজ করা যেতে পারে। তারা বলেছে কাজ করবে। পরবর্তী কর্মসূচির বিষয়ে জানতে চাইলে শিক্ষার্থীরা জানান, বুয়েটে গিয়ে সবার সঙ্গে আলোচনা করে জানানো হবে।

নারাজি দেব— ফারদিনের বাবা: ওদিকে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থী ফারদিন নূর পরশের মৃত্যুর ঘটনায় দুই তদন্তকারী সংস্থা ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি) ও র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‍্যাব) যে তদন্ত প্রতিবেদন উপস্থাপন করেছে, তা মানতে নারাজ ফারদিনের বাবা নুর উদ্দিন। তিনি বলেছেন, আমার ছেলে আত্মহত্যা করতে পারে না। এজন্য আমি নারাজি দেব। গতকাল বৃহস্পতিবার ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারের সামনে উপস্থিত সাংবাদিকদের তিনি এসব কথা বলেন।

তিনি বলেন, ফারদিনের আত্মহত্যার বিষয়ে তদন্তকারী সংস্থা যে তথ্যপ্রমাণ দেখিয়েছে সেটি বিশ্বাসযোগ্য নয়। তদন্তকারী সংস্থা পরিবারের দেয়া কোনো তথ্যপ্রমাণ আমলে নেয়নি। ফারদিনের বাবা বলেন, আমি ফারদিনের মায়ের তরফ থেকে হাতজোড় করে বলছি; আমার ছেলে আত্মহত্যা করতে পারে না। কীভাবে সেখান থেকে পড়ে আত্মহত্যা করা যায়, আমি করে দেখাব।

কান্নাজড়িত কণ্ঠে নূর উদ্দিন বলেন, মদ ও গাঁজা খেয়েছে মানা যায়; কিন্তু আত্মহত্যা করেছে সেটা মানা যায় না। সৎভাবে টাকা আয় করেছেন জানিয়ে ফারদিনের বাবা বলেন, আমার সন্তানরা অমানুষের মতো মানুষ হয়নি। তারা মানুষের মতো মানুষ হয়েছে। তাই ফারদিন আত্মহত্যা করতে পারে না।

প্রসঙ্গত, গত ৪ নভেম্বর রাতে রাজধানীর রামপুরা এলাকায় বান্ধবী বুশরাকে বাসায় যাওয়ার জন্য এগিয়ে দেন বুয়েট শিক্ষার্থী ফারদিন। এরপর থেকেই নিখোঁজ ছিলেন। এরপর গত ৭ নভেম্বর সন্ধ্যায় নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদী থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনায় পরে ৯ নভেম্বর রাতে ডিএমপির রামপুরা থানায় ফারদিনের বাবা নূর উদ্দিন রানা বাদী হয়ে ছেলে হত্যার অভিযোগ এনে বান্ধবী বুশরাসহ অজ্ঞাত বেশ কয়েকজনের নামে একটি মামলা (নম্বর-৯) দায়ের করেন। মামলাটি তদন্ত করছিল ডিবি পুলিশ। ফারদিনকে হত্যা করা হয়েছে এমন নানা তথ্যের মধ্যেই তদন্তে তার আত্মহত্যার তথ্য জানায় ডিবি ও র‍্যাব।

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ