মিসরের শার্ম এল-শেখে শুরু হলো কপ২৭ জলবায়ু সম্মেলন। আজ রোববার থেকে শুরু হওয়া ১৩ দিনের এই সম্মেলন চলবে আগামী ১৮ নভেম্বর পর্যন্ত। বিশ্বের শীর্ষনেতারা সম্মেলনে নতুন কী কী সিদ্ধান্ত নেন সেটার ওপর নজর থাকে জলবায়ুর প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত উন্নয়নশীল দেশগুলোর। উন্নত দেশগুলো জলবায়ু ইস্যুতে পুরনো সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে কতটুকু কার্যকর ভূমিকা রাখার প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করে তাতেও নজর থাকে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর। এবারের জলবায়ু সম্মেলনে জরুরিভাবে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন হ্রাস করা, স্থিতিস্থাপকতা তৈরি করা ও জলবায়ু পরিবর্তনের অনিবার্য প্রভাবগুলোর সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়া এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোতে জলবায়ুসংক্রান্ত কাজে অর্থায়নের প্রতিশ্রুতি প্রদান করা বিষয়গুলোকে আমলে নেয়ার কথা রয়েছে। কেননা, বিগত জলবায়ু সম্মেলনগুলোতে বিশ্বনেতারা নানা প্রতিশ্রুতি দিলেও তা অনেকটাই বাস্তবায়ন হয়নি।
প্রধানত, শিল্পোন্নত দেশগুলো দীর্ঘদিন ধরে তেল-গ্যাস-কয়লা পোড়ানোয় যে বিপুল পরিমাণ ক্ষতিকারক কার্বন পরিবেশে ছড়িয়ে পড়ছে, এর ফলে পৃথিবীর তাপমাত্রা বেড়ে আবহাওয়া চরমভাবাপন্ন হচ্ছে। এতে বনে আগুন লাগছে, ঝড়-বন্যা হচ্ছে, অতি শীত-গরম হচ্ছে, বরফ গলে নিম্নাঞ্চল হুমকির মুখে ফেলছে, প্রাকৃতিক বিপর্যয় বাড়ছে প্রভৃতি। জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কপ২৬ এ বিশ্বনেতারা যে প্রতিশ্রুতগুলো দিয়েছিলেন তারা সেগুলো পূরণ করেননি। গ্রিনহাউস গ্যাস যেভাবে ধ্বংস করার কথা, কেউই সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করেননি। এবারের জলবায়ু সম্মেলন অন্যবারের মতো গুরুত্বপূর্ণ। সম্মেলনের সফলতা কিছুটা হলেও আয়োজন রাষ্ট্রের শক্তিশালী ভূমিকার ওপরও নির্ভর করবে। অনেক সময় দেখা যায়, শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলোর এজেন্ডার সঙ্গে যদি মিলে যায় দুর্বল রাষ্ট্রে সম্মেলন হলেও সেটি থেকে ভালো কিছু আশা করা যায়। জলবায়ু পরিবর্তনে যাদের দায় আছে অর্থাৎ শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলো কী ধরনের ভূমিকা পালন করে সেটার ওপর নির্ভর করছে সফলতা।
স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটির পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এবং স্ট্যামফোর্ড বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, ‘সুদীর্ঘ সময়ে কপ২৬ পর্যন্ত যদি হিসাব করা হয় তাহলে কোনো একটি সম্মেলনে যেসব আলোচনা উঠেছে সবগুলো যে বাস্তবায়ন হয়ে গেছে বিষয়টা এমন নয়। বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের যে সমস্যা সেটার সমাধানের পথটাকে জিইয়ে রাখার একটা প্রসেস হলো জলবায়ু সম্মেলন। বিশ্বের সব রাষ্ট্রপ্রধান এই একটি সম্মেলনে একত্রিত হয়। বৈশ্বিক অন্য কোনো সমস্যা নিয়ে কিন্তু বিশ্বনেতারা এভাবে বসেন না।’
তিনি বলেন, ‘কপের একটা সফলতা হচ্ছে, যারা দায়িত্বশীল তারা কোথাও আলোচনায় বসতে চান না। কিন্তু এখানে যারা দায়িত্বশীল অর্থাৎ কার্বন নিঃসরণ বেশি করছে আবার ক্ষতিগ্রস্ত রাষ্ট্রগুলো তাদের বক্তব্য তুলে ধরার সুযোগ পায়। উভয়পক্ষের বসার সুযোগটাকে আমরা প্রথম সাফল্য হিসেবে দেখতে চাই। দ্বিতীয়ত, আলোচনার টেবিলে যখন কোনো বিষয় থাকে সেটি সমাধানের একটা সম্ভাবনা থাকে। আলোচনা না করলে সমস্যা সমাধান হবে না, সেটা নিশ্চিত। কিন্তু আলোচনা করলে সমস্যা সমাধানের পথগুলো বের হয়ে আসে বা পাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।’
জানা গেছে, কপ২৭ জলবায়ু সম্মেলনের এবারের আয়োজনে ১৯৮টি দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধান বা তাদের প্রতিনিধিরা অংশ নেবেন। তবে গতবার গ্লাসগোতে কপ২৬ এ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অংশগ্রহণ করলেও এবারের কপ সম্মেলনে মিসরে অংশ নিচ্ছেন না। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শার্ম এল-শেখে বাংলাদেশের এজেন্ডা নিয়ে হাজির হবেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী শাহাব উদ্দিন। সম্মেলনে যোগ দেয়ার কথা রয়েছে তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেনসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের।
তথ্য বলছে, বিশ্বের সবচেয়ে বড় এ সম্মেলনে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম বাংলাদেশ নিজেদের এজেন্ডা নিয়ে হাজির হবে। মোটা দাগে ঢাকার পক্ষ থেকে সম্মেলনে ২০২৫ সাল পর্যন্ত উন্নত দেশগুলো প্যারিস চুক্তির আওতায় প্রতি বছর ১০০ বিলিয়ন ডলার দেয়ার অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেছে, তা নিশ্চিত করার দাবি জানান হবে। পাশাপাশি বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে ২০২৫ সালের পর এ বিষয়ে উন্নত দেশগুলোর অবস্থান কী হবে, সেটি আলোচনায় রাখতে চায় ঢাকা। এর বাইরে লস অ্যান্ড ডেমেজ ইস্যু নিয়ে কথা বলবে ঢাকা। ঢাকার চাওয়া হচ্ছে, ১০০ বিলিয়ন ডলারের বাইরে লস অ্যান্ড ডেমেজের জন্য আলাদা অর্থায়ন করতে হবে। এ ইস্যুর সঙ্গে সম্পৃক্ত তথা জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, খরা এবং বন্যাসহ নানাবিধ কারণে যেসব মানুষ বাস্তুচ্যুত হচ্ছে তাদের পুনর্বাসনের দায়িত্ব আন্তর্জাতিকভাবে দেখতে হবে।
অভিযোজন ও প্রশমন, সবুজ প্রযুক্তি হস্তান্তরে উন্নত দেশগুলোকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান হবে। জানতে চাইলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, জলবায়ু ইস্যুতে কোনো বিষয় কিন্তু সুরাহা হয়নি। ২০২৫ পর্যন্ত ১০০ বিলিয়ন ডলারের যে প্রতিশ্রুতি আছে উন্নত দেশগুলোর, সেটা এখনো পূর্ণ হচ্ছে না। সেটার জন্য একটা কনক্রিট আলোচনা দরকার। কীভাবে টাকাটা আসবে সেটার আলোচনা হওয়া দরকার। গতবারও এটা তোলা হয়েছে, সে কথাগুলো আবারও আসবে। তবে এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত আসবে কী না সেটা বলা যাচ্ছে না। ২০২৫-এর পর কী হবে সে আলোচনা হওয়াটা খুবই জরুরি। কারণ ২৫ কিন্তু এসে গেছে। উন্নত দেশগুলো আগের অর্থায়ন কীভাবে পূরণ করবে, পরবর্তী সময়ে তারা টাকাটা কীভাবে দেবে বা তাদের এ বিষয়ে চিন্তাধারা কী, এটি খুব বড় করে আলোচনার বিষয়।
নয়া শতাব্দী/আরআর
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ