ঢাকা, শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১, ১৭ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

গাড়ির ধোঁয়া ‘বিষ’!

প্রকাশনার সময়: ১৮ অক্টোবর ২০২২, ০৮:৩২

বায়ু দূষণে বিশ্বের দূষিত শহরগুলোর তালিকায় ঢাকার অবস্থান মাঝে মধ্যেই প্রথম স্থান পায়। প্রথম থেকে পঞ্চম তালিকায় মধ্যে উঠানামা করছে। তবে তালিকায় প্রথম থেকে পঞ্চম স্থানে উঠানামা করলেও বেশিরভাগ সময়ই দূষণের কারণে ঢাকা প্রথম স্থানে চলে আসে। বায়ুদূষণ, শব্দদূষণের পাশাপাশি রাজধানীর পরিবেশ দূষিত হওয়ার তালিকায় ফের যুক্ত হয়েছে যানবাহনের কালো ধোঁয়া। পরিবেশ দূষিত হওয়া এই যানবাহনের কালো ধোঁয়া বন্ধে প্রশাসন সোচ্চার হলেও সম্প্রতি বেড়েছে এর মাত্রা।

পরিবেশ দূষণে এসব মেয়াদোত্তীর্ণ গাড়ির কালো ধোঁয়া পরিবেশ দূষণে বেশির ভাগ দায়ী। ফলে দূষণে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি দেখা গেলেও দূষণ ঠেকাতে সরকারি উদ্যোগে ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে নানা আইন ও কিছু ক্ষেত্রে আইনের প্রয়োগ দেখা গেলেও থামছে না জীবনবিধ্বংসী এই দূষণ। সমীক্ষা বলছে, বায়ুদূষণের জন্য ১৫ শতাংশ দায়ই মূলত তরল জ্বালানি পোড়ানোর মাধ্যমে তৈরি হওয়া এই ধোঁয়ার।

যানবাহনের এই কালো ধোঁয়ার মাত্রাতিরিক্তের কারণে সামনের দিকে বায়ুদূষণ ফের বৃদ্ধি পাবে বলে শঙ্কার কথা জানিয়েছেন পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, একটি শহরে মানুষ আর গাড়ি দুই-ই থাকবে। দরকার মান নিয়ন্ত্রণ। জ্বালানি তেলের পাশাপাশি যানবাহনেরও মান নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।

দেখা যায় ১৫-২০ বছর আগেও ঢাকায় কালো ধোঁয়া নির্গতকারী গাড়ি নিয়ন্ত্রণে জরিমানা করা হতো। এখন কালো ধোঁয়া নিঃসরণ করে এমন গাড়ির সংখ্যা বেড়ে গেছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অতিরিক্ত মোটরসাইকেল। এগুলো যেহেতু ফসিল ফুয়েলে চলে তাই কার্বন নিঃসরণ করে। এগুলো জ্বালানি পুরোপুরি পোড়াতে পারে না। ফলে অর্ধপোড়া ধোঁয়া বাতাসে ছাড়ে যা বায়ুদূষণ বাড়াচ্ছে।

সরকার দূষণ নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নানা উদ্যোগের কথা বললেও কালো ধোঁয়া ‘নতুন উপদ্রুব হিসেবে ফের সামনে উঠে আসছে। তাই এসব বন্ধে দরকার যথাযথ মনিটরিং ও আইনের প্রয়োগ। বায়ুদূষণ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. কামরুজ্জামান মজুমদার নয়া শতাব্দীকে বলেন, ঢাকা শহরের বায়ুদূষণের ১২ থেকে ১৫ ভাগ পরিবহন থেকে আসে এবং এগুলো কালো ধোঁয়া, ব্ল্যাক কার্বন।

এসব কালো ধোঁয়ার মধ্যে থাকে কার্বন মনোক্সাইড, ব্ল্যাক কার্বন, সালফার ডাই অক্সাইড, নাইট্রোজেন-ডাই-অক্সাইড প্রভৃতি। ফের কালো ধোঁয়া নির্গতের সময় ধূলিকণাও চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। এসব পদার্থ বাতাসে ছড়িয়ে পড়ার কারণে বাতাসে দূষণ বেড়ে যাচ্ছে। যা মানুষের জন্য ভীষণ ক্ষতিকর।

তিনি বলেন, ‘চলতি মাসের শেষ দিক থেকে শীত মৌসুমের দেখা পাব আমরা। এ সময় আবহাওয়া এমনিতেই শুষ্ক থাকে। ফলে বাতাসের দূষণের মাত্রা এমনিতেই বেড়ে যায়। এই অবস্থায় গাড়ির এই কালো ধোঁয়া দূষণের নতুন মাত্রা যোগ করতে পারে। প্রতি বছর এই শুষ্ক মৌসুমের সময় আমরা নানা উদ্যোগের কথা সরকারকে বলে থাকি। কিন্তু বাস্তবে তার কিছুই বাস্তবায়ন হয় না। ফলে দূষণের মাত্রা কমার বদলে দিন দিন তা বেড়েই চলেছে। সরকারের উচিত বায়ুদূষণের সবকটি উৎস বন্ধে সমান উদ্যোগ নেয়া।’

সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) হিসাব অনুযায়ী, দেশে মেয়াদোত্তীর্ণ গাড়ির সংখ্যা পাঁচ লাখের মতো। যেগুলো থেকে কালো বিষাক্ত ধোঁয়া বের হয়। প্রতি বছর ২০ থেকে ৩০ শতাংশ হারে এ ধরনের যানবাহন বাড়ছে। ২০২০ সালের হিসাবে, দেশে নিবন্ধিত মোটরযান আছে ৪৫ লাখ ৫৮ হাজার ৮৭৮টি। এর মধ্যে ১৬ লাখ ৩০ হাজার ৩৬টি গাড়ি রয়েছে রাজধানীতে।

পর্যবেক্ষণ বলছে, লক্কর-ঝক্কর বাস সার্ভিসিং না করেই দাপিয়ে বেড়াচ্ছে সড়কে। প্রায় বেশিরভাগ পরিবহনেই মেয়াদোত্তীর্ণ বাস দৃশ্যমান। সম্প্রতি বেশকিছু পরিবহনের মাত্রাতিরিক্ত কালো ধোঁয়া পরিবেশে ছড়িয়ে পড়ছে। এর মধ্যে রয়েছে— শিকড়, ভিক্টর ক্লাসিক, স্বাধীন, বিকাশ, ভিআইপি, মিডলাইন, পরিস্থান পরিবহন, প্রজাপতি, মালঞ্চ পরিবহন, ৮ নম্বর পরিবহন, ৭ নম্বর পরিবহনসহ ছোট যানবাহনেও কালো ধোঁয়াও সম্প্রতি দৃশ্যমান।

পরিবহন সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, যেসব কারণে যানবাহন থেকে কালো ধোঁয়া ছড়াচ্ছে, তার মধ্যে রয়েছে—গাড়ির ইঞ্জিন পুরনো হয়ে যাওয়া, ইঞ্জিনের সক্ষমতা কমে যাওয়া, যান্ত্রিক ত্রুটি, নির্দিষ্ট সময় পর পর গাড়ির ইঞ্জিন ওয়েল পরিবর্তন না করা এবং ফিটনেসবিহীন গাড়ি চালানো।

এসবের জন্য মূলত যানবাহনের মালিক ও চালকরা দায়ী। তবে এ বিষয়ে জানতে চাইলে মালিক পক্ষ, পরিবহন চালক ও কাউন্টারে দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তারা একে অপরকে দায় চাপানোর চেষ্টা করেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিকাশ পরিবহনের একজন চালক বলেন, ‘মালিক পুরনো গাড়ি কিনে ভালো বডি বসিয়ে, রং করে রাস্তায় নামিয়েছেন। পুরনো ইঞ্জিন কালো ধোঁয়া তো ছাড়বেই। সেটা দেখার দায়িত্ব তো আমার না, গাড়ি চালানোই আমার কাজ। অতি মুনাফার লোভে অনেক মালিকপক্ষই এমন কাজ করে থাকেন। আমাদের ওপর গাড়ি ছেড়ে দিয়ে তারা রাজার হালে প্রসাদে বসে থাকেন। সড়কে গাড়ি নষ্ট হলো না কি হলো সেটার আমাদেরই দেখতে হয়।’

নাঈম নামের এক যাত্রী নয়া শতাব্দীকে বলেন, ‘ঢাকার পরিবহনগুলোর ইঞ্জিন নতুন হলেও সময়মতো ইঞ্জিন পাল্টানো হয় না। এটা মালিকপক্ষের বড় গাফিলতি। এর জন্য অবশ্য পরিবহন চালকরাও দায়ী আছে। দীর্ঘসময় ইঞ্জিন না পাল্টানোর কারণে গাড়ি থেকে কালো ধোঁয়া বের হয়। যা ছড়িয়ে পড়ে পরিবেশ। ফলে দূষিত হচ্ছে পরিবেশ। মুখে মাস্ক থাকার পরেও প্রায়শই কালো ধোঁয়া থেকে রক্ষা মিলছে না। যাদের মুখে মাস্ক নেই, তারা তো হাত বা কাপড় দিয়ে নাক চেপে রাখছেন।’

যানবাহনের কালো ধোঁয়া নিয়ে সরকারের তরফে ১৯৮৩ সালের একটি মোটরযান অধ্যাদেশ রয়েছে। তাতে স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকারক ধোঁয়া নির্গমন করাকে ‘শাস্তিযোগ্য অপরাধ’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এজন্য ২০০ টাকা জরিমানাসহ শাস্তির বিধানও আছে। কিন্তু এর প্রয়োগ করা হচ্ছে না বলে অভিযোগ করেছেন বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘শাস্তি হলে পরিস্থিতির উন্নতি হতো। তবে পরিবহন মালিক ও শ্রমিকদের এ ক্ষেত্রে সচেতন হওয়াটা বেশি জরুরি।’

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ