ঢাকা, রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শব্দ ‘ভয়ংকর’!

প্রকাশনার সময়: ০২ সেপ্টেম্বর ২০২২, ০৮:২২

রাজধানীতে শব্দদূষণের মাত্রা তীব্র হচ্ছে। ছোট-বড় যানবাহনের হর্নের পাশাপাশি প্রকোপ বাড়ছে হাইড্রোলিক হর্নের। ফলে এর প্রভাবে খেসারত টানতে হচ্ছে নগরবাসীসহ সড়কে দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যদের। শব্দদূষণের প্রভাবে মেজাজ খিটখিটে ভাব, চোখে সমস্যা, অস্বস্তি অনুভব, হার্টের সমস্যাসহ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন তারা। সম্প্রতি শব্দের মানমাত্রা বৃদ্ধি হওয়ায় এর বেশি চাপ পড়ছে শ্রবণশক্তিতে। বছরের পর বছর সড়কে থাকার কারণে শ্রবণশক্তি হারাতে বসেছে তারা।

বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) এক গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকায় ট্রাফিক বিভাগের কর্মরতদের ৫৬.৪% ভাগ পুলিশ কানে কম শোনেন। এর মধ্যে শ্রবণশক্তি স্থায়ীভাবে হারানোর পথে ৯.৫%। প্রায় আট ভাগ পুলিশ কয়েক ঘণ্টা দায়িত্ব পালনের পর উচ্চ রক্তচাপ, মেজাজ খিটখিটে, মানসিক চাপ, স্মৃতিশক্তি লোপ পাওয়াসহ ক্লান্তি সমস্যায় ভোগেন। কয়েকজন ট্রাফিক পুলিশ সদস্য জানান, দায়িত্ব পালনের কারণেই নির্ধারিত সময় থাকতে হয় সড়কে। সড়কে দায়িত্ব পালনকালে পরিবহনের চারদিকে হর্নের মাত্রাতিরিক্ত শব্দ সহ্য করতে হয়। অকারণে হর্ন বাজানোর নিয়ম না থাকলেও পরিবহন চালকরা সেটি মানছে না। ফলে শব্দদূষণের প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সড়কে অবস্থানরত ট্রাফিক পুলিশ সদস্যরা।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক ট্রাফিক পুলিশ সদস্য নয়া শতাব্দীকে বলেন, সড়কে শব্দদূষণের মাত্রা আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। প্রধান সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় রাতে ঘুমাতে পারি না। কথা ভুলে যাই। দেখা যায় আপনি স্বাভাবিকভাবে একটা কথা বললেন, দ্বিতীয়বার শুধু নয় তৃতীয়বারও জিজ্ঞেস করতে হয়। দীর্ঘদিন রাস্তায় থাকার পর এখন মনে হয়, জোরে বলা ছাড়া শুনতে পাই না। এখন তো দেখছি চোখেও কম দেখছি। শব্দদূষণের প্রভাব শুধু পুলিশ সদস্যদের ওপরেই নয়, বিশেষ করে এর বেশি প্রভাব পড়ছে শিশুদের ওপরে। শব্দদূষণের কারণে শ্রবণশক্তি হ্রাস, বধিরতা, হূদরোগ, খিটখিটে মেজাজ, শিক্ষার্থীদের পড়ালেখা বিঘ্নিত হওয়া, ঘুমের ব্যাঘাতসহ নানা রকম সমস্যা দেখা দিচ্ছে। আইনের যথাযথ প্রয়োগ করে বিষয়টি নিয়ে গুরুত্ব দেয়া উচিত বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

তারা বলছেন, শব্দ দূষণের মানমাত্রা বৃদ্ধি হওয়ায় এটা সরাসরি আঘাত করছে। দীর্ঘদিন থেকে এর প্রভাব শরীরে পড়লেও বর্তমানে এটা তীব্র হচ্ছে। রাজধানীতে শব্দদূষণের প্রধান কারণগুলো হলো— যানবাহনের জোরালো হর্ন ও ইঞ্জিনের শব্দ, যানবাহন চলাচলের শব্দ, বিভিন্ন নির্মাণ কাজের শব্দ, মেশিনে ইট ও পাথর ভাঙার শব্দ, ভবন ভাঙার শব্দ, কলকারখানা থেকে নির্গত শব্দ, গ্রিলের দোকানে হাতুড়ি পেটানোর শব্দ, জেনারেটরের শব্দ, নির্বিচারে লাউড স্পিকারের শব্দ, দোকানে উচ্চ আওয়াজে গান বাজানোর শব্দ, উড়োজাহাজের শব্দ ইত্যাদি। চারদিকে শব্দ হওয়ার কারণে কোনোদিক দিয়েই মুক্তি পাচ্ছে না নগরে বসবাসরত নাগরিকরা। ফলে সর্বোপরি ক্ষতিগ্রস্ত হতে হচ্ছে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক গবেষণা বলছে, দেশের মোট জনসংখ্যার ২০ শতাংশ মানুষের শ্রবণশক্তি লোপ পেয়েছে, যার মধ্যে ২৬ শতাংশই হচ্ছে শিশু। শব্দদূষণের কারণে শিশুরা কানে কম শোনা, শ্রবণশক্তি হারিয়ে ফেলা, হূদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, স্থায়ী মাথাব্যথা, ক্ষুধামন্দা, অবসাদ, নিদ্রাহীনতাসহ নানাবিধ জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।

মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা নাজমা আক্তার। পেশায় তিনি একজন গৃহিণী। পরিবারের ছোট দুই সন্তানকে লেখাপড়া করায় মোহাম্মদপুরের একটি স্কুলে। সম্প্রতি পড়াশোনায় অমনোযোগী হওয়া, রাতে ঘুমের ভেতরে চিৎকার দেয়া, খিটখিটে মেজাজসহ নানা সমস্যা দেখা দিয়েছে। সন্তান নিয়ে ডাক্তারের কাছে গেলে ডাক্তার অতিমাত্রা শব্দদূষণের কারণে এ সমস্যা কথা বলে। তার সঙ্গে ‘নয়া শতাব্দী’ প্রতিবেদকের কথা হলে তিনি বলেন, ‘আমার ছোট দুইটি সন্তান জোরে কোনো শব্দ শুনলেই ঝাঁকি দিয়ে ওঠে। গত কয়েকদিন হলো ঘুমের ভেতরে চিৎকার ঝাঁকি দেয়াসহ অস্বাভাবিক আচরণ লক্ষ করছি। ডাক্তার বলল উচ্চশব্দের প্রভাবে সমস্যা তৈরি।’

তিনি আরো বলেন, ‘যান্ত্রিক এই ঢাকা শহরে শব্দ ছাড়া আর কিছুই নেই। যেদিকে যাব সেদিকেই উচ্চমাত্রায় শব্দদূষণ চলছেই। শব্দের কারণে মাঝে মধ্যেই আমরা অসুস্থ হয়ে যাই। নানা প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় আমাদের। আর এই শব্দদূষণ সন্তানরা কীভাবে সহ্য করবে।’

আরেক অভিভাবক নয়া শতাব্দীকে বলেন, ‘ঘনবসতি এই ঢাকা শহরে শব্দ ছাড়া নীরবে বসবাস করার মতো পরিবেশ নেই। যেদিকে যাই সেদিকেই শুধু শব্দ আর শব্দ। সড়কে বের হলে তো গাড়ির হর্নের শব্দে পাগল হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা তৈরি হয়ে যায়। আমরা বড় মানুষ হয়েই শব্দের কারণে অসুস্থ হয়ে যাই, আর সন্তানরা তো আরো কাহিল! শব্দ নেই এমন এলাকা ঢাকা শহরে খুঁজে পাওয়া খুবই কঠিন। শব্দদূষণ রোধে সরকার কঠোর না হলে এর পরিণতি ভয়াবহ হতে পারে। কেননা, মানুষের মস্তিষ্ক ড্যামেজ করতে দীর্ঘমেয়াদি উচ্চমাত্রার শব্দদূষণই যথেষ্ট।’

শুধু ব্যস্ত সড়কেই শব্দদূষণ হচ্ছে এমন নয়। মেগাসিটির এই শহরে এমন কোনো এলাকা নেই যেখানে শব্দদূষণ রেকর্ড হয়নি।

সম্প্রতি বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস) একটি গবেষণার প্রতিবেদন প্রকাশ করে। রাজধানীর ১০টি স্থানের শব্দের তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরা হয়। ২০২১ সালের এপ্রিল থেকে ২০২২ সালের মার্চ পর্যন্ত গবেষণাটি পরিচালনা করে তারা। সংস্থাটির জরিপ বলছে, রাজধানীর ১০টি স্থানের নীরব এলাকায় ৯৬.৭% সময় আদর্শ মান (৫০ ডেসিবল) অতিক্রম করেছে, আবাসিক এলাকায় ৯১.২% সময় আদর্শ মান (৫৫ ডেসিবল) অতিক্রম করেছে, মিশ্র এলাকায় ৮৩.২% সময় আদর্শ মান (৬০ ডেসিবল) অতিক্রম করেছে, বাণিজ্যিক এলাকায় ৬১% সময় আদর্শ মান (৭০ ডেসিবল) অতিক্রম করেছে এবং শিল্প এলাকায় ১৮.২% সময় আদর্শ মান (৭৫ ডেসিবল) অতিক্রম করেছে। সমগ্র ঢাকা শহরের ১০টি স্থানেই ৮২% সময় ৬০ ডেসিবলের ওপরে শব্দ পাওয়া গিয়েছে।

জানতে চাইলে বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্রের (ক্যাপস) প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার নয়া শতাব্দীকে বলেন, শব্দদূষণ গত ১০ বছরেও যেমন ছিল এখনো ঠিক তেমনিই আছে। খুব যে বেশি একটা বেড়েছে এমন নয়। তবে আমরা আবাসিক এলাকায় ৬০ ডেসিবেল শব্দের মানমাত্রাকে স্বাভাবিক মনে করি। কিন্তু, বর্তমানে দেখা যাচ্ছে রাজধানীর শতভাগ এলাকায় শব্দের মানমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি হচ্ছে। সচিবালয়ে আশপাশেও শব্দের মানমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি পরিলক্ষিত করা গেছে। শব্দদূষণ থেকে পরিত্রাণের উপায় আমরা সবসময় সব বিভাগকে অবগত করে থাকি। শব্দদূষণ নিয়ে বন পরিবেশ ও জলবায়ু মন্ত্রণালয় কাজ করছে। তবে এর উল্লেখযোগ্য কাজ করা দরকার। পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করলে শব্দের মানমাত্রা ফের স্বাভাবিক হবে বলে আমি আশাবাদী।

তিনি বলেন, ট্রাফিক বিভাগের পুলিশ সদস্যদের কানে কম শোনার তথ্যটি তুলে ধরে যদি আমি বলি, এটা উদ্বেগের। কেননা, পরীক্ষা করলে দেখা যাবে শব্দদূষণের প্রভাবে আমরা রাজধানীর বেশিরভাগ মানুষ কানে কম শুনছি। কারণ সময়ের সঙ্গে বেড়েছে শব্দদূষণের তীব্রতা। এর সঙ্গে শারীরিক জটিলতা তো বাড়ছেই।

শ্রবণ ব্যাধি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. নাসিমা খাতুন বলেন, মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর শব্দদূষণের বিশেষ প্রভাবটি হলো শ্রবণশক্তি হ্রাস। স্কুলগামী শিশুদের ওপর শব্দদূষণের প্রভাব বেশি, অনলাইন প্লাটফর্মগুলোতে ক্লাস করার জন্য তারা ইয়ারফোন ব্যবহার করে, পাশাপাশি অতিরিক্ত গান-বাজনা ইত্যাদি শোনার ফলে পড়াশোনায় অমনোযোগিতা দেখা দিচ্ছে এবং তাদের খাবারে অরুচি সমস্যা দেখা দিচ্ছে।

নয়া শতাব্দী/জেআই

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ