ঢাকা, শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১, ১৬ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

ওল্ড হোম

প্রকাশনার সময়: ২৩ ডিসেম্বর ২০২১, ১৯:১০

রাতের বেলা একটুও ঘুম হয়নি মিসেস শাফিনা আহমেদের। মাথার যন্ত্রণায় তিনি কাতর, এছাড়া মনটাও বিষন্ন। তার জানালার বাইরে দৃষ্টি, কি চমৎকার মিষ্টি রোদ উঠেছে, ওক গাছে কাঠবিড়ালী দৌড়ে বেড়াচ্ছে, ব্যাক ইয়ার্ডটা ফুলে ফুলে ভরে উঠেছে। চারিদিকে বসন্তের আমেজ। লং আইল্যান্ডের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য চোখে পড়ার মতোই। সাজানো গোছানো পরিপাটি এলাকা, গাছ-পালা, সবুজ বন বনানী, সমুদ্র সৈকত সব মিলিয়ে দৃষ্টিনন্দন তো বটেই। তাছাড়া শীতের দেশে এ ধরনের দৃশ্য দেখা ভাগ্যের ব্যাপার। ভাগ্যই তো! নইলে তার কপালেও যে এত দুর্ভোগ আছে তা কেউ জানতো!

‘দাদু! ও দাদু আমার সঙ্গে একটু হাইড এন্ড সিক খেলো না, ভাঙা বাংলায় বললো রায়ান।’ পাঁচ বছর বয়সী নাতির ডাকে চমক ভাঙলো তার। ‘না, দাদু তুমি পড়তে বসো, পরে খেলবো। মা কিন্তু রাগ করবে।’ ‘নো! নো! আমি খেলতে চাই।’ ছোট্ট রায়ান নাছোড়বান্দা। কি আর করার নাতির হাত ধরে লিভিং রুমের কার্পেটে কষ্ট করে তিনি বসলেন। বাতের ব্যথায় নিচে বসতে কষ্ট হয় উনার।

রাজ্যের খেলনা দিয়ে চারপাশটা ভরা। কার্টুন দেখে লুকোচুরি খেলা শিখেছে রায়ান। খেলনার পেছনে লুকিয়ে বলে, পি কা বু! দাদু পি কা বু!’ হঠাৎ কর্কশ আওয়াজে কে যেন বলে উঠলো, ‘আপনার আক্কেল কি মা? এখন খেলার সময়? বাচ্চাটা এখন জুস খেয়ে একটু অন লাইনে ক্লাশ করবে, তা আপনি জানেন না? ওহ্! জানবেন কেমনে আপনার কোনো আক্কেল আছে? বাচ্চাটার মাথা নষ্ট করেন না প্লিজ! সারাবেলা কেবল খেলা। আপনাকে তো বলেছি সব কিছুর একটা সময় আছে।’ রায়ান ঘাবড়ে কেঁদে ফেলে। ছোট্ট ছেলেটা বুঝতে পারে না, মা দাদুকে সবসময় বকে কেন?

আবারো বলা শুরু করে সামিরা,’ ভালো না লাগলে বাইরে হাঁটেন। ওই যে পাশের বাড়ির মিসেস লরেন্স, ব্যাংকে চাকরি করতো। এখন রিটায়ার করে ওল্ড হোমে থাকতে যাবে। ছেলে মেয়েরা কেউ কাছে থাকে না। উনি তো দিব্যি ভালো আছে। কই? মন খারাপ তো দেখি না। এখানকার ওল্ড হোম কত সুন্দর! কত সুযোগ সুবিধা। আপনাদের যত বাঙালি সেন্টিমেন্ট। আমার মা এসে তো এক বছরের বেশি এই দেশে থাকলো না। ভাইয়েরা আমার মাকে মাথায় তুলে রাখে। আমার মায়ের তো রাজ কপাল! অবাক হয়ে মিসেস শাফিনা বৌমার বিভিন্ন সময়ের কটূক্তি শোনেন। ধৈর্য ধরে চুপ করে থাকেন। ছেলেটার অশান্তি তিনি চান না। আর নাতিটা তার যেন জান প্রাণ। মাঝে মাঝে এতো অসহায় লাগে যে বলে বোঝানো যাবে না। কাকে বলবেন এ কষ্টের কথা। এ তো তারই পুত্রবধূ সামিরা। আর যাই হোক নিজের বাড়ির কথা বাইরে বলা যায় না।

গলার ভেতরে দলা পাকিয়ে আছে কষ্ট। কান্নার পাহাড় যেন জোর করে বের হয়ে আসতে চাইছে, কিন্তু অধিক মানসিক চাপে মুখ দিয়ে আওয়াজ বের হচ্ছে না। করোনাকাল না কী চলছে ? তাই এতো অনাসৃষ্টি। কত বছর যেন তিনি পুত্রের সংসারে আছেন! প্রায় দিনই বৌমা সামিরার কাছে কোনো একটা কিছু নিয়ে কথা শুনতে হয়। কেন, তিনি কি দুই ছেলে মেয়ে মানুষ করেন নি? এই ভেবে নিজেকেই প্রশ্ন করেন তিনি, ‘ওরা লেখাপড়া শিখেছে আসলে মানুষ হয়েছে কী?’ এর উত্তর জানা নেই তার।

নয় মাস ধরে তিনি আটকে আছেন মার্কিন মুলুকে। কয়েক মাস ক্যালগিরিতে ছোট মেয়ের বাসায় থাকার পর লং আইল্যান্ডে একমাত্র ছেলের বাসায় এসেছেন। এখানে আসার পরই করোনার সর্বগ্রাসী থাবায় পুরোপৃথিবী পর্যদুস্ত। নিউইয়র্কের অবস্থা ছিলো ভয়াবহ। তিনি ভাবতেই পারেননি এই মৃতপ্রায় শহরটি আবার জেগে উঠবে। মাঝে মাঝে নির্জীব এই শহরটিকে নিজের মতোই মনে হতো তার। এখন যদিও ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হচ্ছে এই শহরের জনগোষ্ঠী। মিসেস শাফিনার জীবন তো এমন ছিলো না। সরকারি কর্মকর্তা স্বামী আর দু ছেলে মেয়ে নিয়ে শান্তিতেই ছিলেন। হার্ট অ্যাটাকে দুই যুগ হলো স্বামীকে হারিয়েছেন। মেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করেছে তখন। আর ছেলেটি ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছিলো। বাবা বেঁচে থাকতেই একমাত্র কন্যা নাফিসাকে বিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন। সে তার ব্যাংকার স্বামীর আর তিন ছেলে মেয়ের সঙ্গে ক্যালগিরিতে থাকে। নাফিসা একটি স্কুলে কাজ করে। আর ছেলে নাভিদ সে সময়ে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলো। এক যুগ হলো সেও ডিভি পেয়ে স্ত্রী সামিয়া আর একমাত্র কন্যা অরনীকে নিয়ে মার্কিন মুলুকে পাড়ি জমায়। এখানেই কয়েক বছর পর জন্ম নেয় নাতি রায়ান। সে দাদুর চোখের মনি। কত স্বপ্ন কত আশা ছিলো নাতিকে নিয়ে তার দাদু মনির।

ঢাকায় জুবায়ের আহমেদ তিনতলা বাড়ি করে গিয়েছিলেন। বাড়িটা খুব একটা চাকচিক্যময় হয়নি। সৎ কর্তব্যনিষ্ঠ মানুষ ছিলেন আহমেদ সাহেব। কেবল একটা মাথা গোঁজার ঠাঁই তৈরি করে দিতে পেরেছিলেন। বাসা ভাড়ার টাকা আর পেনশন দিয়ে ভালভাবেই দিন কেটে যায় তাদের। গ্রামের বাড়িতে জমি জমা আছে। এ ছাড়াও মিসেস শাফিনা কিছু পৈতৃক সম্পত্তিও পেয়েছিলেন। ছেলেটা প্রবাসী হওয়ার পরই কষ্ট বেড়ে গেল মায়ের। নানা রকম শারীরিক সমস্যা তার, সবসময় ডাক্তার দেখাতে হয়। একা তিনি কীভাবে থাকবেন, খালি ফ্ল্যাটে। যদিও উনার ভাই বোনরা দেখাশোনা করতেন, খোঁজ খবরও রাখতেন। তারপরও নিজের সংসার ফেলে যানজটের শহরে দৌড় ঝাঁপ করা এত সহজ নয়। মেয়ের কাছে যেতে চান না তিনি, আমাদের মন মানসিকতা এমনই। ছেলে থাকতে মেয়ে জামাইয়ের কাছে কোনো মা থাকতে চান না। আত্মীয় স্বজনরা মিলে বৈঠক করলো, সমাধানটা হলো এই মা তার ছেলে আর মেয়ের কাছে সময় ভাগ করে থাকবেন।

মিসেস শাফিনা খুব অসহায় বোধ করেছিলেন, তার ইচ্ছের যেন কোনো মূল্যই নেই। আজ যদি জুবায়ের সাহেব বেঁচে থাকতেন, তবে এই দিন তার ভাগ্যে আসতো না। অসম্ভব সাংসারিক সুনিপুণ মহিলা ছিলেন তিনি। কত সুন্দর করে স্বামী আর সন্তানদের নিয়ে সংসার গুছিয়েছিলেন। কিন্তু ভাগ্য বলে একটা কথা আছে না? চোখের কোনে জমে থাকা পানি মুছলেন তিনি। কিছুদিন মেয়ের কাছে থাকার পর নাতি রায়ানের জন্য প্রাণ কাঁদছিলো তার। মেয়ের বাড়িতে কেউ থাকে না, মহা ফাঁপর লাগে। মাঝে মাঝে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখতে যান তিনি নাফিসার সঙ্গে। তারপরও আজ মনে হয় মেয়েটার সঙ্গে বিস্তর ফারাক তার। সময়ের সঙ্গে নিজের পেটের মেয়ের মন বদলে যাবে? মেয়ের বাড়িতে যেন তিনি অতিথি। অনেক বিষয়েই নাফিসা মায়ের ওপর বিরক্ত হয়। ‘মা তোমার বয়স বাড়ছে দেখে শুনে কাজ করতে পারো না, আমাকে বললেই তো হয়। জিনিসপত্র এদিক ওদিক রেখ না, কিছু খুঁজে পাওয়া যায় না। আর বাথরুম ভেজা রেখ না ? বাথটাব থেকে নিচে পানি পরে কীভাবে? বাথরুমও ভালোভাবে ইয়ুজ করতে পার না?’ এর উত্তর কি দিবে একজন মা।

নিজের হাতে একটু কিছু রাঁধবেন, তাও সম্ভব নয়, সব যেন ওর অনুমতি নিয়ে করতে হয়। একটুও ভালো লাগে না। কেবল নাতনি রাইমা তার নানুকে বেশ বোঝে।

নাফিসার ছেলে দুটো পড়াশোনার ব্যস্ততায় বাইরেই থাকে বেশি। পরবাসী জীবন ভালো লাগে না আর। ক্যালগেরীতে মানুষের বসতি তুলনামূলক কম। তার মধ্যে শহরের বেশ বাইরে তার কন্যার বাড়ি, এয়ার ড্রিতে বাড়িঘর আরো কম। আহা! নিজ দেশে কতই না শান্তি ছিল। ভাড়াটিয়াদের বাচ্চারা দাদু, দাদু বলে অস্থির। পাড়ায় কারো খালাম্মা কারো চাচিমা কোথায় পাবে এই ঊষ্ণ ভালোবাসা? একটু হলুদ মরিচের জন্যও পাশের ফ্ল্যাটের প্রতিবেশীরা এসে হাজির হতো। এমন অন্তরঙ্গতা এখানে কোথায়! রাতে খাবার টেবিলে হঠাৎ মা কে কেন্দ্র করে সামিরা আর নাভিদদের মধ্যে কথা কাটাকাটি শুরু হয়। ‘তুমি মা কে আমাদের প্রাইভেসির কথা বুঝিয়ে বলতে পারো না, নাভিদ! উনি অরনীর ঘরে নক না করে ঢুকেন কেন? ও একদম পছন্দ করে না এটা। ওর ঘরে যাওয়ার দরকারটা কী? এই সব দেশে জানই তো ছেলে মেয়েরা এগুলো পছন্দ করে না। আর আরিয়ানের পড়াশোনাই হবে না উনার অতিরিক্ত আহ্লাদের জন্য। টেলিভিশনে উনার সঙ্গে বসে বাচ্চাটা বাংলা সিরিয়াল দেখে। কুইচা মুরগির মতো ঘরে বসে থাকা, অসহ্য হয়ে গেলাম।’ আর কত আসা অবধি এমনই চলছে ছেলের বাসায়।

অবশেষে সকালে নাস্তার টেবিলে মুখ খুললেন মিসেস শাফিনা, কারণ আজ রোববার বন্ধের দিন। নাভিদ আর সামিরাও ছিল নাস্তার টেবিলে।’ তোমাদের গলগ্রহ হয়ে থাকতে চাই না, এখানে। ভালোবাসার কাঙ্গাল তাই ছেলে মেয়ে ফেলে থাকতে পারি না। তোমরা তো জানোই রায়ান আমার কলিজার টুকরা। কাঁদছেন আর বলেই চলেছেন তিনি, দেশে আমার মাথা গোঁজার জায়গা আছে। ওল্ড হোমে আমার থাকতে হবে না। আমি কোথায় থাকবো সেটা সম্পূর্ণই আমার সিদ্ধান্ত। আত্মীয় পরিজনেরও চিন্তা করতে হবে না। ওল্ড হোমে প্রয়োজন হলে আমি নিজেই যেতে পারবো। আল্লাহ না করুন, তোমাদের যেন ওল্ড হোমে একদিন জায়গা না লাগে। আমি দেশে ফিরে যাব। আমার দেশে ফেরার টিকিট কাটো নাভিদ।

তোমাকে আজই একটা কথা বলতে চাই শোন, তোমার বাবার বাড়িটা তোমাদের দুই ভাই বোনেরই থাকবে। আর শহরের বাইরে আমার বাবার দেয়া যে জমিটা আছে, সেখানে একটা ওল্ড হোম করার চেষ্টা করবো। আমার কয়েকজন বান্ধবী আছে যারা সমাজ সেবায় নিয়োজিত। ওদের মধ্যে বিত্তশালী বান্ধবীও আছে আমার। ওরা কথা দিয়েছে আমাকে সাহায্য করবে।’ ‘প্লিজ মা, রাগ করো না তুমি সামিরার ওপর। বললো নাভিদ। ‘এসব কথা কেন আসছে, জানোই তো সামিরা একটু মেজাজী। কিন্তু ওর মনটা কিন্তু খারাপ নয়।’ তোমাকে কিছু বলতে হবে না, নাভিদ। আমি অনেক আগেই এরকম একটা চিন্তা মাথায় রেখেছিলাম। কিন্তু বুঝতে পারিনি সহসাই সেই পরিকল্পনা চলে আসবে আমার সামনে। বাস্তবতা ভালোই বুঝেছি আমি। আমার মতো অনেক মা বাবাই আছেন যারা একাকীত্বে ভোগেন। সন্তানদের সময় নেই তাদের জন্য। তারাই থাকবেন অল্প কিছু অর্থের বিনিময়ে শাফিনা নিবাসে। আর যারা অসহায় সুবিধা বঞ্চিত তাদের থাকারও ব্যবস্থা হবে। তোমরা মনে করেছিলে আমি অসহায়, আমাক ভাগাড়ে নিক্ষেপ করবে। আমি কোনোদিন তোমাদের কাছে কিছু চাইনি। তারপরও তোমাদের এখানে দুদন্ড শান্তি নেই আমার, তোমাদেরও স্বস্তি নেই। তিক্ততা আর বাড়াতে চাই না। বাকী জীবন একটু শান্তি চাই। তোমাদের বোঝা হহতে চাই না।

আর কোনো কথা না বলে উঠে দাঁড়ালেন মিসেস শাফিনা আহমেদ। বুকের ভেতর যে ভার বহন করেছিলেন, তা এখন অনেকটাই কম। অনেকখানি হালকা অনুভব করছিলেন তিনি। ব্যাক ইয়ার্ডে গিয়ে দাঁড়ালেন মিসেস শাফিনা, এক ফালি রূপালি চাঁদ আকাশে আলো ছড়াচ্ছিলো। মিষ্টি বাতাস আর ফুলের ঘ্রাণ ছুঁয়ে গেল তার কপালে। তিনি অনুভব করলেন তার এক কালের সুখ দু:খের সাথীকে। নতুন করে বাঁচার প্রত্যাশা নিয়ে পথ চলবেন তিনি। সেখানে শাফিনা নিবাসের কাজে হাত দিতে তাকে যে সুস্থ থাকতে হবে।

নয়া শতাব্দী/জেআই

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ