জনঘনত্ব বাড়ার ফলে ঢাকার পরিবেশ হুমকির মুখে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অপরিকল্পিত নগরায়ণের কারণেই বিশ্বের বাসযোগ্য শহরগুলোর তলানিতে অবস্থান করছে ঢাকা। পরিবেশ উন্নয়নে তৃণমূল পর্যন্ত শক্তিশালী তত্ত্বাবধায়ক নিয়োগ ও বাজেটে বরাদ্দ বাড়ানোর পরামর্শ তাদের।
ঢাকার ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গাছ কেটে এভাবে বানানো হয়েছে কংক্রিটের জঞ্জাল। উদ্যানে নির্মাণ কাজ করা যাবে না— এমন আইন থাকলেও গত কয়েক বছরে রাজধানীর বেশির ভাগ উদ্যানেই শোভা বাড়ানো ও উন্নয়নের নামে কাটা হয়েছে শত শত গাছ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একটি আদর্শ শহরে ২৫ শতাংশ গাছ থাকে। ঢাকায় আছে ১১ শতাংশের কম। ঢাকার বাসিন্দারা বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত বায়ু সেবন করছে এবং দিনদিন তাপমাত্রা বাড়ার হার ঊর্ধ্বমুখী। সেখানে এভাবে প্রতিনিয়ত গাছ কাটা হলে পরিবেশ বিপর্যয় আরও বাড়বে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন-বাপা সাধারণ সম্পাদক আলমগীর কবির বলেন, ‘উদ্যোনে কীভাবে কপি হাউজের শপ করে এবং উদ্যোনগুলোতে উন্নয়নের নামে অনেক কনস্ট্রাকশন হচ্ছে?— এটা খুবই দুঃখজনক।’
আন্তর্জাতিক গবেষণাগুলো বলছে, কোনো শহরের জনসংখ্যা ৭০ লাখের ওপর চলে গেলে সেখানে বিনিয়োগ করলেও তার কাঙ্ক্ষিত ফল আসে না, ঢাকা এখন এমন পরিস্থিতির মুখে। বিশ্বের বাসযোগ্য শহরগুলো নিয়ে প্রকাশিত তালিকায় ঢাকার অবস্থান তলানিতে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সমস্যা চিহ্নিত হলেও ঢাকার এমন বাড়তি জনসংখ্যার চাপে পরিস্থিতি বদলানো কঠিন হয়ে পড়েছে। এমন অবস্থায় পরিবেশের এবং উন্নয়নের সার্বিক সুফল পেতে ঢাকাকে পরিকল্পিত উপায়ে বিকেন্দ্রিকরণ করার পরামর্শ দিচ্ছেন তারা।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ঢাকাকে বসবাসের আদর্শ শহর করার আর কোনো উপায় নেই। তবে কিছুটা স্বস্তি ফিরিয়ে আনা সম্ভব। সেটা করতে হলে পরিকল্পনা মাফিক নগর উন্নয়ন করা দরকার। দরকার সুশাসন। ঢাকা এখন জনসংখ্যার আধিক্যে ধুঁকছে। তারপরও ঢাকার জনসংখ্যা প্রতিদিনই বাড়ছে। সবশেষ জনশুমারি অনুযায়ী দেশের মোট জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৯৮ লাখ ২৮ হাজার ৯১১ জন। এর মধ্যে ঢাকা বিভাগে রয়েছে চার কোটি ৫৬ লাখ ৪৩ হাজার ৯৯৫ জন। যা মোট জনসংখ্যার ২৬.৮৮ শতাংশ। আর ঢাকা শহরের জনসংখ্যা দুই কোটির বেশি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গত এক দশকে প্রকৃতিকে গুরুত্ব না দিয়ে উন্নয়ন কাজ করায় এ বিনিয়োগ ঢাকাকে টেকসই করতে পারেনি। প্রশাসনিক বা অর্থনৈতিক বিকেন্দ্রীকরণ না হওয়ায় মানুষ প্রতিনিয়ত ঢাকামুখী হচ্ছে। ফলে পরিবেশের মান দিন দিন আরও নিম্নমুখী।
বাপা সাধারণ সম্পাদক আলমগীর কবির বলেন, ‘চাকরি বাজার সম্পূর্ণটাই হচ্ছে ঢাকার শহরে। বিসিএস কোচিং করবে সেটাও ঢাকাতে এসে করতে হয়, ভালো লেখাপড়ার স্কুল সেগুলোও ঢাকাতে। ফলে ঢাকাতে বড় চাপ। এখানে প্রায় ৬৫ হাজার মানুষ প্রতি বর্গকিলোমিটারে বসবাস করছে।’
পরিবেশ উন্নয়নে রাজনৈতিক সদিচ্ছা, সেবা সংস্থার মধ্যে সমন্বয় জোরদার এবং মাঠ পর্যায়ে পরিবেশ উন্নয়নে স্বয়ংসম্পূর্ণ তত্ত্বাবধায়ক নিয়োগের পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের।
স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের প্রধান অধ্যাপক আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার বলেন, ‘সংশ্লিষ্টদের মধ্যেই সমন্বয়ের অভাব রয়েছে। এ সমন্বয় থাকলে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি সারা বছর এভাবে বিশৃঙ্খলভাবে হবে না তখন যানজটও কমে আসবে। সেই সঙ্গে বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ কমে আসবে।’
পরিবেশ বিষয়ে শিক্ষা ও গবেষণা বাড়াতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পরিবেশ বিজ্ঞানকে একাডেমিক বিষয় হিসেবে গুরুত্ব দিয়ে স্থান দেয়ারও পরামর্শ তার।
বিআইপির সভাপতি অধ্যাপক ড. আদিল মোহাম্মদ খান বলেন, এই শহরে শিশুদের জন্য খেলার মাঠ নেই। তারা খোলা আকাশ দেখে না। তাদের বিনোদনের কোনো জায়গা নেই। এ একটি মাত্র বিষয় থেকেই বোঝা যায় ঢাকার পরিবেশ কতটা বসবাসের যোগ্য আছে। দিন দিন ঢাকা বসবাসের একটি অযোগ্য শহরে পরিণত হচ্ছে। এ শহর এখন জনআধিক্যে ভুগছে। আর প্রতিদিনই জনসংখ্যা বাড়ছে। তাই এর খুব বেশি উন্নতি সম্ভব নয়। তারপরও সঠিক পরিকল্পনা নিলে স্বস্তি ফিরিয়ে আনা সম্ভব।
এককালে সবুজের আচ্ছাদনে মোড়ানো ঢাকা ক্রমেই হারিয়ে ফেলছে তার শ্যামলিমা। সবুজ কমতে থাকায় মহানগর ঢাকায় একদিকে যেমন বাড়ছে বায়ুদূষণ, তেমনি পাল্লা দিয়ে বাড়ছে তাপমাত্রা। ২০২৩ সালের ১৬ এপ্রিল ঢাকায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৪০.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এটি ছিল তখন পর্যন্ত দীর্ঘ ৫৮ বছরের মধ্যে রাজধানীর সর্বোচ্চ তাপমাত্রা। এর আগে ১৯৬৫ সালে ঢাকার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা উঠেছিল ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। প্রসঙ্গত, এখন পর্যন্ত ঢাকার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ১৯৬০ সালের ৩০ এপ্রিল, ৪২.৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। দেশব্যাপী চলমান দাবদাহ নাভিশ্বাস তুলেছে জনজীবনে। ব্যারোমিটারের পারদে চলতি গরমে ঢাকা এখনো শীর্ষস্থানে না গেলেও তাপের অনুভূতি মোটেই কম নয়।
তাপমাত্রা বৃদ্ধির জন্য জলবায়ু পরিবর্তন যতটা দায়ী, তার চেয়ে অনেক বেশি দায়ী অপরিকল্পিত নগরায়ণ, নগর পরিচালনা ও সেবাদানে যুক্ত বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে সমন্বয়ের অভাব ও পরিবেশ ব্যবস্থাপনার ত্রুটি বা ঘাটতি। বৈশ্বিক, আঞ্চলিক ও স্থানীয় এ তিনটি কারণে ঢাকা শহরের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বৈশ্বিক কারণের মধ্যে রয়েছে জীবাশ্ম জ্বালানির দহন থেকে কার্বন নিঃসরণ এবং আমাজানসহ বনভূমি ধ্বংস হওয়া।
দেশের পাঁচটি বড় নগরে গত ৩০ বছরে প্রতিবেশ ব্যবস্থা ধ্বংসের পরিমাণ দ্রুত বেড়েছে। এসব শহরে জলাশয় ও বনভূমি কমেছে, জীববৈচিত্র্য ধ্বংস হয়েছে। এতে ১৯৯১ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে এসব শহরের বাসিন্দারা প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকার সেবা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা ও সিলেট নগরের ওপর এক গবেষণায় এমন তথ্য উঠে এসেছে। যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়, অস্ট্রেলিয়ার নিউ ক্যাসল বিশ্ববিদ্যালয়, কার্টিন বিশ্ববিদ্যালয়, কানাডার ক্যালগেরি বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের নয়জন এ গবেষণা করেন।
গবেষণায় বলা হয়, পাঁচটি নগরই নদীর তীরে গড়ে উঠেছে। এর মধ্যে ঢাকা বুড়িগঙ্গার, চট্টগ্রাম কর্ণফুলীর, রাজশাহী পদ্মার, খুলনা রূপসার ও সিলেট সুরমা নদীর তীরে গড়ে উঠেছে। এসব শহরে দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে নদী ও জলাভূমির ওপর চাপ পড়েছে। ঢাকায় বছরে ১১ দশমিক ৫ শতাংশ হারে, রাজশাহীতে ৫ শতাংশ, চট্টগ্রামে পৌনে ৪ শতাংশ হারে জনসংখ্যা বাড়ছে।
গবেষণা দলের সদস্য ও অস্ট্রেলিয়ার কার্টিন বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক আশরাফ দেওয়ান বলেন, ‘ঢাকাসহ এসব নগরে প্রতিবেশ ব্যবস্থার জন্য গুরুত্বপূর্ণ জলাশয় ও সবুজ এলাকা ধ্বংস করা হচ্ছে। অথচ প্রকৃতির এসব উপাদান থেকে আমরা তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ, খাদ্যের জোগান ও স্বাস্থ্যকর আবহাওয়া পেয়ে থাকি। এসব ধ্বংস করে কংক্রিটের ভবন, সড়ক ও নানা অবকাঠামো গড়ে তোলায় আমরা সেবা পাচ্ছি না। এতে শহরগুলোতে দ্রুত তাপমাত্রা বাড়ছে ও বসবাসের অনুপযোগী হয়ে উঠছে।’
নয়া শতাব্দী/এসআর
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ