ঢাকা, শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১, ১৬ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

‘পরিবেশ দূষণ এখন মানবিক বিপর্যয় তৈরি করছে’

প্রকাশনার সময়: ১৫ এপ্রিল ২০২৩, ১৮:১৩

বায়ু দূষণে দীর্ঘদিন ধরে আক্রান্ত রাজধানী ঢাকা। দূষণ রোধে সরকার বিভিন্ন সময় নানা পরিকল্পনা গ্রহণ করলেও পুরোপুরি রোধ করতে সক্ষম হয়নি। তাই পরিবেশ দূষণ এখন মানবিক বিপর্যয় তৈরি করেছে বলে জানিয়েছেন পরিবেশবিদরা।

শনিবার (১৫ এপ্রিল) জাতীয় প্রেসক্লাবে বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস) এবং বারসিক এর যৌথ আয়োজনে ‘বায়ুদূষণ কমাতে দ্বৈত নীতির পরিহার জরুরী’ শীর্ষক একটি সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। উক্ত সংবাদ সম্মেলনে মূল বক্তব্য প্রদান করেন- স্টামফোর্ড বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস) এর প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার।

ক্যাপস এর গবেষক ইঞ্জি. মো. নাছির আহম্মেদ পাটোয়ারী এর সঞ্চালনায় ইন্সটিটিউট অব আর্কিটেকচার এর সহ-সভাপতি এবং স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী নকী সভাপতিত্বে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন- বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) এর সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল। উক্ত সম্মেলনে আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন- হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ (এইচআরপিবি) এর প্রেসিডেন্ট অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও আঞ্চলিক পরিকল্পনা বিভাগের শিক্ষক ও ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) এর নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ড. আদিল মোহাম্মদ খান এবং বারসিক এর সমন্বয়কারী মো. জাহাঙ্গীর আলম।

স্টামফোর্ড বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস)-এর প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদার বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বায়ু দূষণের স্বাস্থ্য ঝুঁকি উপলব্ধি করে পিএম ২.৫ এর আদর্শমান প্রতি ঘনমিটারে ১০ মাইক্রোগ্রাম থেকে কমিয়ে ৫ মাইক্রোগ্রাম করেছে। সেখানে বাংলাদেশের ‘বায়ু দূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা-২০২২’ (তফসিল-১)-এ পিএম২.৫ এর আদর্শমান প্রতি ঘনমিটারে ১৫ মাইক্রোগ্রাম থেকে বাড়িয়ে ৩৫ মাইক্রোগ্রাম করা হয়েছে। আবার বায়ু দূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা ২০২২ এর তফসিল-৫ অনুযায়ী তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের স্ট্যাক ইমিশনের জন্য সালফার ডাই অক্সাইড, নাইট্রোজেনের অক্সাইডসমূহ এবং বস্তুকণার সর্বাধিক অনুমোদিত সীমা যথাক্রমে ২০০, ২০০ এবং ৫০ মিলিগ্রাম/ন্যানো ঘনমিটার। যা যেসব দেশ তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র গড়ে তোলার সহযোগিতা করছে, তাদের চেয়েও এই মান ৪-৫ গুণ বেশি।

তিনি বলেন, বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের (বিপিসি) আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে শিল্প মন্ত্রণালয় আমদানি ব্যয় কমাতে ২০২৩ সালের ১২ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত এক সভায় ৫০০ পিপিএম বা তার বেশি মাত্রার সালফার যুক্ত ডিজেল আমদানি করতে সম্মত হয় যদিও বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড টেস্টিং ইন্সটিটিউটের (বিএসটিআই) তথ্য অনুযায়ী, ডিজেলের মধ্যে সালফারের সীমা ৩৫০ পিপিএম পর্যন্ত নির্ধারিত ছিল।

তিনি আরও বলেন, পরিবেশ অধিদপ্তর কর্তৃক প্রণীত নতুন পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা-২০২৩ এর তফসিল-১ অনুযায়ী কয়লা ও তেল ভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ প্লান্ট (৫০ মেগাওয়াট পর্যন্ত) এবং গ্যাস ভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ প্লান্ট (১০০ মেগাওয়াট পর্যন্ত) কমলা শ্রেণীর অন্তভুক্ত শিল্প প্রতিষ্ঠান। এই সকল শিল্প প্রতিষ্ঠানের জন্য পরিবেশগত প্রভাব নিরূপণ (EIA-Environmental Impact Assessment) প্রয়োজন নেই। কিন্তু, পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা-১৯৯৭ অনুযায়ী সমস্ত বিদ্যুৎ কেন্দ্রকে লাল বিভাগের অধীনে রাখা হয়েছিল, যার অর্থ এই সকল শিল্প প্রতিষ্ঠানের জন্য পরিবেশগত প্রভাব নিরূপণ (EIA) এবং একটি পরিবেশ ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা (EMP-Environmental Management Plan) প্রস্তুত করার জন্য সমস্ত বিদ্যুৎ উৎপাদনকারীদের জন্য একটি আইনি বাধ্যবাধকতা ছিল। উপরন্তু কমলা শ্রেণীর শিল্প প্রতিষ্ঠানের জন্য পরিবেশ ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনার (EMP)বাধ্যবাধকতা ছিল। কিন্তু, নতুন পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা-২০২৩ এ তার অনুপস্থিত। ফলে কমলা শ্রেণির বিদ্যুৎ প্লান্ট তাদের কার্যক্রমে দূষণ ব্যবস্থাপনার বাধ্যবাধকতা থেকে ছাড় পাওয়ার শঙ্কা রয়েছে। ঢাকাসহ সমগ্র্য বাংলাদেশে যে তাপদাহ চলছে তার জন্য বায়ুদূষণও দ্বায়ী বলে তিনি মনে করেন।

তিনি সম্মেলনে এই সমস্যা সমাধানের জন্য নিম্মোক্ত সুপারিশ প্রস্তাবনা করেন

১। ভবিষ্যতে বায়ু দূষণের মারাত্মক প্রভাব হ্রাস করার জন্য, কমপক্ষে পূর্ববর্তী মান প্রতিঘনমিটারে ১৫ মাইক্রোগ্রাম বজায় রাখার পরামর্শ দেন। এটি বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্য এবং পরিবেশের উপর বায়ু দূষণের নেতিবাচক প্রভাবগুলি হ্রাস করতে সহায়তা করবে। বায়ু দূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা ২০২২ এ নির্গমন মানমাত্রাগুলোকে আরও শক্তিশালী করা এবং আগত IEPMP তে স্ট্যাক ইমিশনের মানমাত্রাগুলোকে পুনঃবিবেচনা করা এবং অন্তভুক্ত করা।

২। বায়ুর মানমাত্রা কিংবা শিল্প প্রতিষ্ঠান কর্তৃক স্ট্যাক ইমিশনের মানমাত্রা বিধিমালায় যে সংশোধন হবে তা যেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর মানমাত্রার সাথে তুলনামূলক বিশ্লেষণ করে করা হয় এবং আমাদের দেশে যেসকল উন্নয়ন সাহায্য প্রদানকারী দেশ, সংস্থা বা পরামর্শক ফার্ম কাজ করেন তাদের নিজ দেশের মানমাত্রা সাথে যেন সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়।

৩। দেশের উন্নয়নের জন্য বিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং ডিজেল মত গুরুত্বপূর্ণ জ্বালানীর প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য তবে এগুলোর মান নির্ধারণের পূর্বে অবশ্যই পরিবেশকে গুরুত্ব দিতে হবে। ডিজেলে সালফারের উপস্থিতির সর্বোচ্চ সীমা ৫০ পিপিএম নির্ধারণের জন্য পরিবেশ অধিদপ্তরের রোড ম্যাপ বাস্তবায়নের পরামর্শ দিয়েছেন।

৪। পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা করে ছোট বা বড় যেসকল শিল্প হতে পরিবেশ দূষিত হবে তাদের সঠিক শ্রেণী বিন্যাস করতে হবে এবং নির্গত দূষণের মাত্রা স্বচ্ছভাবে নির্ধারণ করে দিতে হবে। প্রয়োজনে Real Time Monitoring প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে। যেকোন ধরন এবং আকারের পাওয়ার প্লান্টকে বিধিমালায় লাল শ্রেনীভুক্ত করতে হবে।

ইন্সটিটিউট অব আর্কিটেকচারের সহ-সভাপতি এবং স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ’র সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী নকী বলেন, বায়ুদূষণ কমানোর জন্য আমরা আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। কিন্তু, বিভিন্ন নীতিমালায় তার বিপরীতমূখী আইন পাশ হয়ে যাচ্ছে যা খুবই উদ্বেগজনক। এই বিষয়ে জনগণের সচেতনতা অতন্ত্য জরুরী তার জন্য পুরো ব্যাপারটি সহজ সরল ভাষায় ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে। সেই সাথে সাংবাদিক/মিডিয়ার ভাইদের সচেষ্ট হতে হবে।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) এর সাধারণ সম্পাদক শরীফ জামিল বলেন, পৃথিবীর সকল দেশের নীতি, আইন ও বিধিমালা প্রণয়ন করা হয় জনস্বার্থে। কিন্তু, বাংলাদেশের নীতি প্রণয়নে দুর্নীতির মাধ্যমে জনস্বার্থ উপেক্ষা করে নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষার সাম্প্রতিক একটি ঘৃণ্য উদাহরণ হচ্ছে সমন্বিত নির্মল বায়ু আইন প্রণয়ন না করে একটি অগ্রহণযোগ্য বায়ু দূষণ বিধিমালা প্রণয়ন। এই ঘনবসতির বাংলাদেশে পরিবেশ দূষণ দিনে দিনে এখন মানবিক বিপর্যয় তৈরি করছে। তাই পরিবেশ রক্ষার সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন আজ অপরিহার্য।

হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ (এইচআরপিবি) এর প্রেসিডেন্ট অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে আইন প্রণয়নের যে উদ্যোগ আসে, সেটি জনগণের হবে কিনা তা নির্ভর করে আইন প্রণয়নে কারা জড়িত তার উপর। আমাদের সংসদ নেতৃত্ব দেন ব্যবসায়ীরা এবং পলিসি নির্ধারিত হয় তাদের স্বার্থে পরিবেশ দূষণ এর জন্য প্রধানত দায়ী ব্যবসায়ীরা। সুতরাং আইন প্রণয়ন তাদের স্বার্থেই হবে এটাই স্বাভাবিক। এক্ষেত্রে একমাত্র উপায় হল জনগণকে জেগে উঠা এবং আওয়াজ তোলা যে, পরিবেশ নিয়ে ছিনিমিনি খেলা চলবেনা।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও আঞ্চলিক পরিকল্পনা বিভাগের শিক্ষক ও ইন্সটিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) এর নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ড. আদিল মোহাম্মদ খান বলেন, বায়ু দূষণ সংক্রান্ত বিভিন্ন আইন ও নীতিমালায় দ্বৈত নীতির মধ্যমে দূষণের মানমাত্রা বাড়ানোর সুযোগ করে দিয়ে আমাদের সামগ্রিক জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশকে মারাত্মক বিপর্যয়ের সম্ভাবনার দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। দেশের আইন মানুষকে সুরক্ষা দেওয়ার বদলে, ব্যবসায়ী ও শিল্প প্রতিষ্ঠানের গোষ্ঠী স্বার্থকে রক্ষা করছে যা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। উন্নত রাষ্ট্রগুলো তাদের নৈতিক অবস্থানকে দুর্বল করে দিয়ে বাংলাদেশে তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রে দূষণের মাধ্যমে পরিবেশ বিপর্যয় ঘটাচ্ছে। আমাদের সামগ্রিক জনসাস্থ্য ও পরিবেশগত বিপর্যয় রোধ করতে আইনসমূহের কার্যকর সংশোধন অতি জরুরি।

বারসিক এর সমন্বয়কারী মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, বাংলাদেশের যত মানুষের অকাল মৃত্যু হয় তার ২০ ভাগ মৃত্যু হয় বায়ু দূষণের কারণে। বায়ু দূষণের জন্য সরাসরি আমাদের দেশের মানুষেরা দায়ী, যার অধিকাংশই শিক্ষিত মানুষ। এই মানুষগুলোর অপরিমাণ ও লোভনীয় কর্মকাণ্ডের ফলে আমাদের দেশের বায়ু দূষণ সহনীয় মাত্রার চেয়ে ৪ ভাগ বেড়ে গেছে। তাই সমস্যার সমাধানের জন্য সরকারি যত নীতি ও আইন রয়েছে তার সমন্বয় করে সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করে নগরের পরিবেশ উন্নত করার উদ্যোগ নিতে হবে।

নয়াশতাব্দী/এমটি/জেডএম

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ