ঢাকা, রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মাইক্রোপ্লাস্টিকে বিষাক্ত বুড়িগঙ্গা-তুরাগ

প্রকাশনার সময়: ২২ ডিসেম্বর ২০২২, ০৮:৫১

স্বচ্ছ পানির বুড়িগঙ্গা ও তুরাগ নদের পানিতে মাইক্রোপ্লাস্টিকের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। আর এ ভারী ধাতুর মাত্রাতিরিক্ত উপস্থিতির কারণে বিষাক্ত হয়ে গেছে নদীর মাটি ও পানি। একই সঙ্গে পানিতে পাওয়া মাছেও মিলেছে বিষাক্ত এ ভারী ধাতুর উপস্থিতি।

যদিও গত মার্চ মাসে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন জানিয়েছিল, ‘আগামী মার্চের মধ্যে স্বচ্ছ টলমলে হয়ে উঠবে বুড়িগঙ্গাসহ ঢাকা ঘিরে থাকা চার নদীর পানি। নদীতে আর পড়বে না শিল্পের বিষাক্ত রঙিন বর্জ্য। দূষিত কালচে পানির উৎকট গন্ধে নাকে রুমাল চাপতে হবে না কারও। পাল তুলে চলা নৌকার পাশাপাশি টলমলে পানিতে ঝাঁকে ঝাঁকে ছুটে চলবে নানা প্রজাতির মাছ।’

কিন্তু, ঢাকার প্রাণ বুড়িগঙ্গা ও তুরাগ নদের পানির বর্তমান পরিস্থিতিতে যেন ভুল প্রমাণিত হয়েছে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের সেই আশার বাণী। আগামী মার্চ মাস আসতে তিন মাস সময় বাকি থাকলেও নদীগুলোর দূষণ কমানো সম্ভব হয়নি। বরং গরমকালে নদীর পানি কিছুটা স্বচ্ছ থাকলেও শীত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে নদীর পানি দূষণ ও র্দুগন্ধ ।

নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মনজুর আহমেদ চৌধুরী বলেন, ১৭ মার্চের মধ্যে ঢাকার চার নদী দূষণমুক্তের ঘোষণা দিয়েছিলাম। এখনও তিন মাসের বেশি আছে। কাজ চলছে। তবে যেভাবে হওয়ার কথা, সেভাবে হয়নি। তহবিলের সংকট আছে। এছাড়া অন্য নদীগুলোর সমস্যাও দেখছি।

মাঠ পর্যায়ের জরিপ, জিপিএস মানচিত্র ও স্যাটেলাইট ইমেজ বিশ্লেষণ করে ২০১৯ সালের নভেম্বর-ডিসেম্বরে বুড়িগঙ্গায় ২৩৭টি বর্জ্যের ভাগাড় ও ২৫১টি স্যুয়ারেজ লাইন এবং তুরাগ নদে (টঙ্গী খালসহ) ১৩১টি বর্জ্যের ভাগাড় ও ৯৯টি স্যুয়ারেজ লাইন পায় জরিপকারী সংস্থা রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্স সেন্টার (আরডিআরসি)।

সংস্থাটির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এজাজ বলেন, আমরা নিয়মিত নদীগুলো পর্যবেক্ষণ করছি। একটি স্যুয়ারেজ লাইনও বন্ধ হয়নি। এগুলো থেকে মানববর্জ্যসহ কলকারখানার অপরিশোধিত রঙিন পানি বের হওয়াও বন্ধ হয়নি। ডাস্টবিন না থাকায় নদীপাড়ের বাসিন্দারা নদীতেই আবর্জনা ফেলছে।

তিনি বলেন, বুড়িগঙ্গা নদীর পানি নিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় একটা গবেষণা চালিয়েছে। সেখানে মাইক্রোপ্লাস্টিকের অস্তিত্বের খবর আমার শুনেছি। তবে শীতের তীব্রতা রাজধানীতে বাড়লেও বুড়িগঙ্গা নদীর পানি এখনও ওইভাবে কালো হয়নি। তবে সামনের সপ্তাহে আসতে আসতে পানি কালো হয়ে যাবে, গন্ধও বাড়বে।

বুড়িগঙ্গা নদী দখল-দূষণমুক্ত করার জন্য সরকার বিভিন্ন সময় নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও দখল-দূষণের পূর্ণতা আসেনি। মাঝে মধ্যে নদীর দু’পাড়ে অবৈধ দখলদারদের বিরুদ্ধে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করলেও কিছুদিন পর আবারও সরব হন ‘নদী খেকো’রা। যে নদীর তীরে গড়ে উঠেছিল ঢাকা, এখন সেই ঢাকার উন্নয়ন আর অবৈধ দখলদারদের পেটে বুড়িগঙ্গার বেশিরভাগ অংশ। বুড়িগঙ্গাকে ছোট করতে করতে এখন এতটা ছোট করে ফেলেছে যে, দু’পাড়ে দূরত্বে এখন আরও বেশি ফারাক নয়।

সম্প্রতি আন্তর্জাতিক জার্নাল সায়েন্স অব দ্য টোটাল এনভায়রনমেন্টের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বুড়িগঙ্গা নদীর মাটি, পানি, মাছ, শামুক এবং কাঁকড়াতে বিপজ্জনক মাত্রায় ক্ষতিকর মাইক্রোপ্লাস্টিক ও ভারী ধাতুর উপস্থিতি রয়েছে। এগুলোতে মাইক্রোপ্লাস্টিকের পরিমাণ যথাক্রমে পানিতে ০.১২-০.২৫টি/মিলিলিটার, মাটিতে ৩.৫-৮.১৭টি/গ্রাম, মাছে ০.৬৫-৩.৮২টি/গ্রাম, শামুকে ৩.৭৫-৪.২৮টি/গ্রাম এবং কাঁকড়াতে ০.৮৪-১.১২টি/গ্রাম। এছাড়া প্রতি কেজি মাটিতে আর্সেনিক ৩৭.৬৮ মিলিগ্রাম, ক্রোমিয়াম ১৫৩ মিলিগ্রাম, ক্যাডমিয়াম ৮.৩২ মিলিগ্রাম ও লেড পাওয়া গেছে ৮৭.১২ মিলিগ্রাম।

একইভাবে প্রতি লিটার পানিতে আর্সেনিক, ক্রোমিয়াম, কেডমিয়াম ও লেডের উপস্থিতি ছিল যথাক্রমে— ৩৬.৬২ মাইক্রোগ্রাম, ১৪৬.৬৬ মাইক্রোগ্রাম, ৮.১৬ মাইক্রোগ্রাম ও ৮১.৭২ মাইক্রোগ্রাম।

গবেষকরা বলছেন, গবেষণায় মাইক্রোপ্লাস্টিকের যে পরিমাণ ধরা পড়েছে তা বাংলাদেশ ও অন্যান্য দেশের গবেষণা থেকে অনেক বেশি ছিল। নদীর পানি ও মাটিতে আর্সেনিক, ক্রোমিয়াম, ক্যাডমিয়াম এবং লেডের পরিমাণ ও পরিমাপ করেছেন তারা। সেখানে সব ভারী ধাতুর পরিমাণ পূর্বের গবেষণা থেকে তুলনামূলক অনেক বেশি ছিল। মাইক্রোপ্লাস্টিক বা প্লাস্টিকের এই ক্ষুদ্র কণা আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকির কারণ হয়ে উঠতে পারে। এখনই এর লাগাম টানা না গেলে ভবিষ্যতে অনেক জটিলতার মুখোমুখি হতে হবে।

জানতে চাইলে গবেষক দলের প্রধান পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, মাইক্রোপ্লাস্টিক আমাদের খাদ্য জালে প্রবেশের ফলে খাদ্য জালের প্রতিটি উপাদান এবং মানব প্রজাতি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। মাইক্রোপ্লাস্টিক সাধারণত কোষ ক্ষতিগ্রস্ত, ইমিউনোলজিক্যাল পরিবর্তন, জিনোটক্সিসিটি, এন্ডোক্রাইনে ব্যাঘাত, নিউরোটক্সিসিটি, প্রজনন অস্বাভাবিকতা, আচরণগত পরিবর্তন সাধন করে। মাইক্রোপ্লাস্টিক হচ্ছে প্লাস্টিকের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণা। আকারে এটি সর্বোচ্চ পাঁচ মিলিমিটার পর্যন্ত বড় হতে পারে।

তিনি বলেন, আমরা বিভিন্ন ধরনের ভোগ্যপণ্য ব্যবহার করি, যেমন টুথপেস্ট, ফেসওয়াশ, যেগুলোতে ছোট ছোট বীজ থাকে। এগুলো আসলে মাইক্রোপ্লাস্টিক বা প্লাস্টিকের বীজ। এগুলো পানিতে চলে যায়, মাটিতে মিশে যায়। এই ক্ষুদ্র কণাগুলো এক সময় মানবদেহসহ প্রকৃতির আরও নানা অংশে মিশে যায়। প্লাস্টিকের এই ক্ষুদ্রকণা যেটাকে আমরা মাইক্রোপ্লাস্টিক বলছি সেটা আমাদের জন্য অনেক বেশি ক্ষতিকর। আমরা তাৎক্ষণিক এই ক্ষতির মাত্রা নির্ধারণ করতে না পারলেও তার সুদূরপ্রসারী প্রভাব রয়েছে।

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ