তারেক মাসুদের জন্ম ১৯৫৬ সালের ৬ ডিসেম্বর। ফরিদপুর জেলার ভাঙ্গা উপজেলার নুরপুর গ্রামে। তার বাবার নাম মশিউর রহমান মাসুদ এবং মায়ের নাম নুরুন নাহার মাসুদ।পড়াশোনার হাতেখড়ি মাদরাসায়। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের পর থেকে শুরু হয় সাধারণ শিক্ষা। আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজে কিছুদিন ঘুরাঘুরি করে থিতু হন নটরডেম কলেজের মানবিক বিভাগে। সেখান থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিষয়ে অনার্স এবং মাস্টার্স সমাপ্ত করেন।
ছাত্রজীবন থেকেই নানা রকম সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েন তারেক মাসুদ। ছড়া লেখেন, আবৃত্তি করেন, কাজ করেন লেখক শিবিরে। ১৯৭৫ সালে যুক্ত হন চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনের সঙ্গে। তিনি বেশ কিছু ডকুমেন্টারি, অ্যানিমেশন ও চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন।
আশির দশকের মধ্যভাগে শুরু হওয়া স্বাধীনধারা চলচ্চিত্র আন্দোলনের অগ্রগণ্য তিনি। চলচ্চিত্র আন্দোলনের মাধ্যমে তার পরিচয় ঘটে নির্মাতা মোরশেদুল ইসলাম, তানভীর মোকাম্মেল, শামীম আখতারের সঙ্গে। দেশে-বিদেশে চলচ্চিত্র বিষয়ক অসংখ্য কর্মশালা এবং কোর্সে তিনি অংশ নিয়েছিলেন।
তারেক মাসুদের প্রথম কাজ আদম সুরত (The Inner Strength) নির্মিত হয় ১৯৮৯ সালে। এটি মূলত চিত্রশিল্পী এস. এম. সুলতানের জীবনভিত্তিক প্রামাণ্যচিত্র; যার কাজ শুরু ১৯৮২ সালে। নির্মাণের উৎস হিসাবে তারেক মাসুদ প্রায় সাত বছর শিল্পীর সান্নিধ্যে কাটান। বস্তুত এই সময়েই তার সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক দর্শনের ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। যদিও বিশ্ববিদ্যালয় জীবন থেকেই রাজনীতি, শিল্প-সংস্কৃতি ও দর্শনচর্চায় তার সংযুক্তি ছিল।
তারেক মাসুদ ১৯৯৬ সালে নির্মাণ করেন ‘মুক্তির গান’। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় একটি ভ্রাম্যমাণ গানের দলকে নিয়ে তৈরি করা প্রামাণ্য চিত্রগুলো সংগ্রহ করে তৈরি হয় ছবিটি। এরপর একে একে নির্মাণ করেন ‘মুক্তির কথা’ (১৯৯৯), ‘নারীর কথা’ (২০০০), ‘মাটির ময়না’ (২০০২), ‘অন্তর্যাত্রা’ (২০০৬), ‘নরসুন্দর’ (২০০৯) ও ‘রানওয়ে’ (২০১০)। এর মধ্যে ‘মাটির ময়না’ কান চলচ্চিত্র উৎসবে ক্রিটিকস প্রাইজ অর্জন করে।
বাঙালির জাতীয় পরিচয়, লোকজ বিশ্বাস ও সংস্কৃতি তারেক মাসুদের চোখে ধরা দিয়েছে অন্যরকম বাস্তবতা নিয়ে। সারাটা জীবন তাই তার রচনায় সেই ঘ্রাণ। আজন্ম দেশের মাটি আর মানুষ এবং তাদের সমস্যা ও সম্ভাবনাকে সিনেমার পর্দায় বিম্বিত করে জনতার সামনে তুলে ধরার প্রচেষ্টা। সে ক্ষেত্রে তাকে সঙ্গ দিয়েছেন স্ত্রী ক্যাথরিন মাসুদ। লেখক আহমদ ছফার মাধ্যমেই ক্যাথরিনের সঙ্গে তারেকের পরিচয়। দুজনের সন্তান নিষাদ মাসুদ। ব্যক্তিগত জীবনেও অসাধারণ মানুষটি লিখেছেন গানও; যেগুলো নিয়ে পরবর্তীতে ক্যাথরিন প্রকাশ করেছে এলবাম। স্বল্পদৈর্ঘ্য, পূর্ণদৈর্ঘ্য, প্রামাণ্যচিত্র ও অ্যানিমেশন মিলিয়ে তারেক মাসুদের মোট চলচ্চিত্র ১৬টি।
২০১১ সালের ১৩ আগস্ট। মানিকগঞ্জ ‘কাগজের ফুল’ সিনেমার লোকেশেন ঠিক করা হলো। সকল পরিকল্পনা শেষ করে ঢাকার পথে রওনা হলেন তারেক মাসুদ। সঙ্গে স্ত্রী ক্যাথরিন মাসুদ এবং সাংবাদিক মিশুক মুনীর। কিন্তু বাসায় পৌঁছানোর আগেই তার যাত্রা ঘুরে গেল পরপারের দিকে।
সৃজনশীলতার জন্ম দিতেই তিনি জন্মেছিলেন। যার স্বীকৃতি স্বরূপ তারেক মাসুদ পেয়েছেন অগণিত সম্মাননা ও পুরস্কার। এর মধ্যে রয়েছে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার (১৯৯৬ ও ২০০৩), ফিল্ম সাউথ এশিয়া পুরস্কার (১৯৯৭), কান চলচ্চিত্র উৎসব পুরস্কার (২০০২), বাচসাস পুরস্কার (২০০৩), চ্যানেল আই চলচ্চিত্র পুরস্কার (২০০৩), ভারতীয় আন্তর্জাতিক ভিডিও উৎসব (২০০৩), কারা চলচ্চিত্র উৎসব (২০০৩), কেরালা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব (২০০৩), ডিরেক্টরস গিল্ড অব গ্রেট ব্রিটেন (২০০৪), ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল অব বাংলাদেশ (২০০৬), মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কার (২০১০)।
নয়া শতাব্দী/আরআর
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ