ঢাকা, শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১, ১৬ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬
সেন্সরশিপ জটিলতায় ‘শনিবার বিকেল’

প্রতিবাদে সরব তারকারা

প্রকাশনার সময়: ১৩ আগস্ট ২০২২, ১০:৫১

২০১৯ সালে সেন্সর বোর্ডে জমা পড়ে মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর সিনেমা ‘শনিবার বিকেল’। সেন্সর বোর্ড কর্তৃপক্ষ প্রথমবার ছবিটি দেখে শিগগিরই ছাড়পত্র দেয়া হবে বলে গণমাধ্যমে জানিয়েছিলেন; কিন্তু পরে ছবিটিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে বোর্ড। বিষয়টি নিয়ে সে সময় তুমুল লেখালেখি হলেও কোনো এক অজানা কারণে থমকে যায় এর ছাড়পত্র। পরর্তীতে এই পরিপ্রেক্ষিতে বোর্ডে আপিল করেছিলেন ফারুকী, কিন্তু এত দিন পরও কোনো উত্তর পাননি তিনি। সম্প্রতি এই নির্মাতা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লিখেন, ‘আজ সাড়ে তিন বছর হলো আপিলের। কোনো উত্তর নেই। আমাদেরও বুঝি কিছু বলার নেই। কারণ তারাপদ রায়ের কবিতার মতো আমাদের কখন সর্বনাশ হয়ে গেছে আমরা টেরও পাইনি।’

‘শনিবার বিকেল’ নিয়ে মুখ খোলেন নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে তুলে ধরেন ছবিটির হালহকিকত। অন্যদিকে, তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বরাবর খোলা চিঠি দিয়েছে প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান জাজ মাল্টিমিডিয়া। এরপর থেকেই সিনেমা সংশ্লিষ্টদের চর্চায় ‘শনিবার বিকেল’। বিশেষ করে ফেসবুকে প্রতিবাদে সরব হয়েছে দেশের মিডিয়া অঙ্গনের মানুষ। ছবিটি কেন মুক্তি দেয়া হচ্ছে না, এই প্রতিবাদে ফেসবুককেই হাতিয়ার হিসেবে বেছে নিয়েছেন তারা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চলছে প্রতিবাদ। চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টদের দাবি, পৃথিবীর কোথাও সেন্সরে ছবি আটকে দেয়ার মতো তেমন নজির এখন আর পাওয়া যায় না। স্বাধীন দেশে সেন্সরশিপ আরোপ করা শিল্পচর্চার সুস্পষ্ট লংঘন বলেও মনে করছেন তারা।

জনপ্রিয় অভিনেত্রী জয়া আহসানের ভাষ্য, ‘পৃথিবীর নানা দেশে যখন সেন্সর বোর্ড নামের বালাইটা উঠে যাচ্ছে, আমাদের দেশে সেটা তখন ফাঁসির রজ্জুর মতো চলচ্চিত্রের গলায় চেপে বসছে। এর সর্বশেষ শিকার এখন মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর ‘শনিবার বিকেল’। কোনো চলচ্চিত্রের কাহিনি কী হবে, তারও কি এখন প্রেসক্রিপশন নিয়ে আসতে হবে? চলচ্চিত্রের বিষয় আকাশের তলায় মাটির পৃথিবীর যেকোনো কিছু হতে পারে। চূড়ান্ত কল্পনা, নিরেট বাস্তব, বাস্তব থেকে অনুপ্রাণিত কল্পনা।’

হলি আর্টিসানের প্রসঙ্গ টেনে এই অভিনেত্রী আরো বলেন, ‘শনিবার বিকেল’ ছবিতে হলি আর্টিসানের শোচনীয় ঘটনাটির ছায়া আছে বলে? আসলেই আছে কিনা আমার জানা নেই। যদি থাকেও, তাহলেই বা ছবিটা আটকে দেয়ার যুক্তি কী? হলি আর্টিসান ঘটেনি? আমাদের মন থেকে ধুয়ে মুছে গেছে? সত্যি বলতে কী, এই ঘটনা কখনোই আমাদের মন থেকে মুছে যেতে পারে না। মুছে যেতে দেয়া যায়ও না। যে ঘটনার পুনরাবৃত্তি আমরা মোটেও চাই না, আমাদের ছেলেমেয়েদের সামনে থেকে যে পথ চিরকালের জন্য অবরুদ্ধ করে রাখতে চাই, হলি আর্টিসানের ঘটনা তার জোরালো সতর্কঘণ্টা হিসেবে মন থেকে মনে বাজিয়ে যেতে হবে। ঘণ্টা বাজিয়ে ঘুম থেকে আমাদের মনটাকে জাগিয়ে তোলা তো চলচ্চিত্রেরই একটা কাজ। আমরা চলচ্চিত্রের মুক্তি চাই, সব শিল্পের মুক্তি চাই। কারণ, আমরা মানুষের মুক্তি চাই।’

জয়ার এ পোস্টে কথা বলেছেন মিডিয়ার আরো কয়েকজন। অভিনেতা হাসান মাসুদ সেখানে মন্তব্য করেছেন এভাবে, ‘সেন্সর বোর্ড নিপাত যাক’।

ঢাকার গুলশানের হলি আটিসানে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনার ছায়া অবলম্বনে তৈরি ‘শনিবার বিকেল’। তবে একই ঘটনায় ভারতে ‘ফারাজ’ নামে সিনেমা নির্মাণ করেছেন বলিউডের খ্যাতিমান নির্মাতা হংসল মেহতা। সে বিষয়টিও উঠেছে এসেছে অনেকের প্রতিবাদে। অন্যদিকে শুধু ‘শনিবার বিকেল’ নয়, সেন্সরে আটকে থাকা সব ছবি নিয়ে কথা বলেছেন অনেকে। যার সূত্রপাতও ‘শনিবার বিকেল’।

প্রসঙ্গটি উঠে এসেছে নির্মাতা খিজির হায়াত খানের কথাতেও। তার ভাষ্য, ‘একতাই বল, নিজেদের মধ্যে বিভেদ আর না করি আমরা। সকল আটকে থাকা সিনেমা আলোর মুখ দেখুক।’

নির্মাতা মিজানুর রহমান মিজান এক ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, ‘হায়রে চলচ্চিত্রের মানুষ! ‘শনিবার বিকেল’ মুক্তির জন্য সিনেমার অনেক জ্ঞানী-গুণী মানুষ প্রতিবাদী পোস্ট দিলেও ‘রানা প্লাজা’ নিয়ে সবাই নিশ্চুপ। কেউ কোনো কথাই বলে নাই। প্রতিবাদ যদি করতেই হয় তাহলে সেন্সরে আটকে যাওয়া সকল সিনেমা নিয়ে প্রতিবাদ করা উচিত। একপক্ষীয় প্রতিবাদ হবে কেন? ‘শনিবার বিকেল’ সিনেমা, ‘রানা প্লাজা’ কি সিনেমা না? কই তখন তো কেউ প্রতিবাদ করলেন না ভাই? এই বঙ্গদেশে যদি ‘শনিবার বিকেল’ মুক্তি দেয়া হয়, তাহলে ‘রানা প্লাজা’র মতো আরো অনেক সিনেমা আছে, সেগুলোও মুক্তি দেয়া উচিত বলে আমি মনে করি।’

নির্মাতা আশফাক নিপুণ বলেন, এটা শুধুই ‘শিক্ষা’ দেয়ার জন্য করা হচ্ছে। তিনি লিখেন, ‘এই মুহূর্তে বিশ্বের চলচ্চিত্র মানচিত্রে মননে তরুণ যে ক’জন দেশি চলচ্চিত্র নির্মাতা দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন, দেশের নাম উজ্জ্বল করছেন, তাদের মধ্যে সম্ভবত অগ্রগণ্যই থাকবেন ফারুকী। ইতোপূর্বে তার নির্মিত কোনো চলচ্চিত্র দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তাকে কোনোরকম ঝুঁকিতে ফেলেছে—এই কথা তার শত্রুও বলার ধৃষ্টতা দেখাবেন না। বরং এসব ভিন্ন ন্যারেটিভের সিনেমার কারণে বিশ্ব বাংলাদেশকে চিনেছে নতুন আলোয়। বিশ্বের বড় বড় শিল্পী তার সিনেমায় যুক্ত হয়েছেন সাগ্রহে। কিন্তু তার ছবিকে প্রায় প্রতিবারই এ রকম সেন্সরের দীর্ঘসূত্রতা পার করতে হয়। কেন? বোধকরি এটা এক ধরনের শিক্ষা দেয়া। ফারুকীর ছবি আটকে বাকি সবাইকে এই শিক্ষা দেয়া, যেন কেউ অন্যভাবে ভাবতে না পারে। যেন কেউ অন্য বয়ান হাজির করতে না পারে সিনেমার মধ্য দিয়ে।’

অভিনেত্রী জ্যোতিকা জ্যোতি বলেন, ‘কোনো শিল্পই আটকে রাখার না। আমি ব্যক্তিগতভাবে চাই মোস্তফা সরওয়ার ফারুকীর ‘শনিবার বিকেল’ মুক্তি পাক। আমি হলে বসে ‘শনিবার বিকেল’ দেখতে চাই। সেন্সর বোর্ডের একজন সদস্যর সঙ্গে কথা বলে জানলাম আগের কমিটি ‘শনিবার বিকেল’ আটকে দিয়েছিল। আমি আশা করি বর্তমান কমিটি আবার সুদৃষ্টিতে সিনেমাটি বিবেচনা করুক। এবং ধন্যবাদ জাজ মাল্টিমিডিয়াকে সিনেমাটি নিয়ে মুভ করার জন্য। আশা করি ফারুকী ভাইয়ের অন্যান্য সিনেমার মতোই ‘শনিবার বিকেল’ও দারুণ কিছু হবে।’

২০১৯ সালে সেন্সর বোর্ডের অন্যতম সদস্য ছিলেন নির্মাতা ও চলচ্চিত্র নেতা মুশফিকুর রহমান গুলজার। তিনিও জানেন না কেন সাড়ে তিন বছরেও ছাড়পত্র পেল না ‘শনিবার বিকেল’! তার কাছে আটকে থাকা সিনেমাটির সর্বশেষ আপডেট জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমাদের পক্ষ থেকে সিনেমাটির ব্যাপারে কোনো আপত্তি ছিল না। কিন্তু কী হলো বুঝতে পারছি না। রাষ্ট্রের কিছু ব্যাপার থাকতে পারে। এই সিনেমাটি যে ঘটনার ওপর নির্মিত সেটা সামনে আসা নিয়ে প্রশাসনিক আপত্তি থাকতে পারে। এ বিষয়ে আমাদের কিছু বলার নেই। এটুকু বলতে পারি, সিনেমা হিসেবে আমার চোখে আপত্তিকর কিছু লাগেনি। তবে সাবজেক্ট বিষয়ে প্রশাসনিক বা আন্তর্জাতিক কোনো রেশ থাকলে আমাদের কিছু বলারও নেই।’

জাজ মাল্টিমিডিয়া, ছবিয়াল ও ট্যানডেম প্রোডাকশন প্রযোজিত ‘শনিবার বিকেল’-এর বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছেন ১২টি দেশের স্বনামধন্য অভিনেতারা। যার মধ্যে আছেন ফিলিস্তিনের ইয়াদ হুরানি, ইউরোপের এলি পুসো, সেলিনা ব্ল্যাক, বাংলাদেশের মামুনুর রশীদ, জাহিদ হাসান, নুসরাত ইমরোজ তিশা, ভারতের পরমব্রত চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ।

নয়া শতাব্দী/ এডি

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ