ঢাকা, রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
‘ওরা ১১ জন’ ছবির ৫০ বছর

রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির আক্ষেপ

প্রকাশনার সময়: ১২ আগস্ট ২০২২, ১০:৩৮

মুক্তিযুদ্ধের অসামান্য দলিল চাষী নজরুল ইসলাম পরিচালিত চলচ্চিত্র ‘ওরা ১১ জন’। ১৯৭২ সালের ১১ আগস্ট মুক্তি পাওয়া এ চলচ্চিত্রের ৫০ বছরপূর্তি হলো গতকাল। সোহেল রানা (মাসুদ পারভেজ) প্রযোজিত এই চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা; তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন খসরু, মুরাদ, হেলাল ও নান্টু।

এ ছাড়া অভিনয় করেছেন রাজ্জাক, শাবানা, নূতন, সৈয়দ হাসান ইমাম, আলতাফ, মুরাদ, খলিলউল্লাহ খানসহ আরো অনেকে। তবে দুঃখের বিষয় হলো— যে চলচ্চিত্র বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রামাণ্য দলিল স্বরূপ, তার ভাগ্যে জোটেনি কোনো রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি। এমনকি ছবিটির প্রযোজক, পরিচালক, অভিনয় শিল্পীদের কেউ কোনো সম্মাননা পাননি এই ৫০ বছরেও।

চাষী নজরুল ইসলাম এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন, তিনি মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ছবিটি নির্মাণের পরিকল্পনা করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘তখন মুক্তিযুদ্ধ চলছে। কোনোরকমে প্রাণ বাঁচিয়ে চলি। ওই সময়ে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, যদি বেঁচে থাকতে পারি তাহলে অবশ্যই একদিন এ যুদ্ধ নিয়ে সিনেমা বানাবো।’

অভিনেতা সোহেল রানা তখন স্বাধীন বাংলাদেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হলের ছাত্র। সদ্য মুক্তিযুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছেন। সেখানে তখন আনাগোনা সব নামকরা ছাত্রনেতার। মাঝেমধ্যে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও আসতেন। বর্ষীয়ান অভিনেতা সোহেল রানা জানিয়েছেন, প্রধানমন্ত্রী তার চেয়ে পড়াশোনার দিক দিয়ে এক ক্লাস জুনিয়র। সে সময় ইকবাল হলে ছাত্রদের মধ্যে সবচেয়ে চর্চিত বিষয় মুক্তিযুদ্ধ। এক-একজন তার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতেন। সেসব আলাপচারিতায় উঠে আসে আলাদা শ্রেণি-পেশার মানুষের আলাদা-আলাদা ত্যাগের গল্প। সেই গল্পগুলোকেই এক সুতায় গাঁথার জন্য ‘ওরা ১১ জন’ নির্মাণের কথা ভাবেন সোহেল রানা।

সেই দিনগুলোর কথা স্মরণ করে সোহেল রানা বলেন, ‘১৯৭২ সালে আর কী গল্প মাথায় আসতে পারে? আমি তো সিনেমার মানুষ নই। তবে এর আগে গল্প লিখতাম, সিনেমা নিয়ে পড়াশোনা করতাম। চিত্রবাণীতে সিনেমা নিয়ে লেখালেখিও করতাম। একদিন হলের দারোয়ান বলল, ‘স্যার আপনারা তো অনেকে ফিরে এলেন। সব স্যার তো ফিরলেন না।’ কথাটা আমার মধ্যে দারুণভাবে আলোড়ন সৃষ্টি করে। তখনই ভাবি, যারা আর ফিরলেন না, যারা এত ত্যাগের বিনিময়ে দেশটি স্বাধীন করলেন তাদের এই গল্পগুলো মানুষকে জানানো উচিত। তখন শুধু একটা বিষয়ই মাথায় এসেছিল, তা হলো— মুক্তিযুদ্ধ যে হয়েছে সেটার প্রমাণ যেন থাকে। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যেন এ থেকে মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে জানতে পারে। এরপর পরিচালক অভিনয় শিল্পী ও কলাকুশলীদের সহায়তায় ছবিটি শেষ করি।’

মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক প্রথম চলচ্চিত্র ‘ওরা ১১ জন’ ছবিটির রজত জয়ন্তী পূর্ণ হলো, বিষয়টি নিয়ে কী অনুভূতি জানতে চাইলে সোহেল রানা বলেন, ‘আমার সেভাবে কোনো অনুভূতি নেই। তবে এই ছবিটির জন্য আমি কোনো ধরনের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পেয়েছি কি না সেটি যদি জিজ্ঞেস করেন তাহলে বলব না, আমি কিছুই পাইনি। এ নিয়ে আমি আগেও কয়েকবার কথা বলেছি। দেশের প্রথম মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সিনেমা এটি। সেই দিক থেকে হলেও তো চলচ্চিত্রের কেউ যদি স্বাধীনতা পদক পায় সেটি আমারই পাওয়ার কথা। কিন্তু আমি সেসব কিছু পাইনি। আমি একজন অভিনেতা হিসেবে, চলচ্চিত্রশিল্পে অবদানের জন্য আজীবন সম্মাননা পেয়েছি, এটুকুই।

আজীবন সম্মাননাপ্রাপ্ত শিল্পীদের চাওয়া-পাওয়া নিয়েও আমি কথা বলেছি। যেহেতু এটি রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি, তাই বিভিন্ন সরকারি ও সম্মানজনক আয়োজনে আমাদের অন্তত ভিআইপির মর্যাদা দেয়া হোক— তা নিয়ে কথা বলেছি। কিন্তু তেমন কোনো অগ্রগতি দেখিনি। তবে সত্যি বলতে এগুলো নিয়ে আমার ব্যক্তিগত কোনো মাথাব্যথা নেই। আমার কোনো ক্ষোভ নেই। আমি সৃষ্টিকর্তার রহমতে যা পেয়েছি তাতেই অনেক বেশি খুশি। আমাকে দেশের মানুষ যে অকৃত্রিম ভালোবাসা ও সম্মান দিয়েছে তার চেয়ে কোনো সম্মানই আমার কাছে বড় মনে হয় না।’

তবে বিশেষ একটি দিকে দৃষ্টিপাত করেছেন সোহেল রানা, সেটি এই সময়ের বাংলাদেশের সামগ্রিক অবস্থার জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, ‘যোগ্য মানুষের সম্মান করা, গুণীদের কদর করা না হলে সে দেশে ভালো কিছু হয় না। একটি দেশের সাংস্কৃতিক পরিচয় যখন প্রশ্নবিদ্ধ হয় তখন কিন্তু জাতি হিসেবে নিজস্বতা বলতে কিছু থাকে না। এ কারণেই আজ চলচ্চিত্র শিল্পের এই দশা। এখন আর সেই গান কোথায়? এক লালন সাঁইকে নিয়ে একটু চর্চা হয়, সেটিও হবে না যদি এভাবে গুণীকে তার প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করা হয়। সেই চিত্রশিল্প কই? জয়নুল আবেদিন নেই, কামরুল হাসান নেই— এখন এই শিল্পের কী অবস্থা জানি না।’

তবে সোহেল রানা নতুন প্রজন্মকে দোষারোপ করেন না। তিনি বলেন, ‘আমরা যদি মুক্তিযুদ্ধের ব্যথাই তাদের মধ্যে অনুভব করাতে না পারি তাহলে তারা কেন মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যথা বুঝবে? কেনই বা তারা গুণীদের চিনবে?’

নয়া শতাব্দী/ এডি

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ