দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য এ বছর ২৪ জন বিশিষ্ট নাগরিক পাচ্ছেন একুশে পদক। গত বৃহস্পতিবার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে একুশে পদকের জন্য মনোনীতদের তালিকা প্রকাশ করে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়। সংস্কৃতি অঙ্গনে অবদান রাখায় এবার শিল্পকলা বিভাগে একুশে পদক পেতে যাচ্ছেন ৭ জন। সংগীতের জন্য পদক পাচ্ছেন নজরুল ইসলাম বাবু (মরণোত্তর), ইকবাল আহমেদ ও মাহমুদুর রহমান বেণু। অভিনয়ের জন্য পদক পাচ্ছেন খালেদ খান (মরণোত্তর), মাসুম আজিজ ও আফজাল হোসেন। নৃত্যে অবদান রাখায় পদক পাচ্ছেন জিনাত বরকতউল্লাহ।
এবারের একুশে পদকপ্রাপ্তের তালিকায় উচ্ছ্বসিত সংস্কৃতি অঙ্গন। সব মহলে পাচ্ছে প্রশংসা। সন্তুষ্টি প্রকাশ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পদকপ্রাপ্তদের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন শোবিজ অঙ্গনের অনেক তারকা। বিশেষ করে গীতিকার নজরুল ইসলাম বাবু ও অভিনেতা খালেদ খান একুশে পদক পাওয়ায় আনন্দিত সংগীতাঙ্গন ও অভিনয় শিল্পীরা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাদের ছবি শেয়ার করে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন তারকাদের অনেকে। এ ছাড়া জীবন্ত কিংবদন্তিদের মধ্যে ইকবাল আহমেদ, মাহমুদুর রহমান বেণু, মাসুম আজিজ, আফজাল হোসেন ও জিনাত বরকতউল্লাহ পাচ্ছেন একুশে পদক। তারাও ভক্তদের শুভেচ্ছা বার্তায় সিক্ত হচ্ছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চিত্রনায়ক শাকিব খান লিখেছেন, ‘আমাদের অগ্রজ, গুণী অভিনয়শিল্পী আফজাল হোসেন এ বছর একুশে পদক পাচ্ছেন। অভিনয়কলায় তার এই প্রাপ্তি নিঃসন্দেহে দেশের প্রতিটি অভিনেতার জন্য বিশেষ উদ্যাপনের। ব্যক্তিগতভাবে চাইবো, প্রিয় ব্যক্তিত্ব ও পরম শ্রদ্ধেয় আফজাল হোসেন আমাদের মাঝে আরো দীর্ঘদিন কাজ করুন। আগামী দিনে তার দুর্দান্ত কাজ দেখতে মুখিয়ে থাকব। তিনি সুস্থ থাকুন, তার দীর্ঘায়ু কামনা করি। একুশে পদক প্রাপ্তিতে তাকেসহ অভিনন্দন জানাই বাকি ২৩ গুণী মানুষকেও।’
সংস্কৃতি অঙ্গনে এবারের একুশে পদকপ্রাপ্তদের কার কী অবদান, সে বিষয়ে সংক্ষেপে জেনে নেয়া—
১৯৭১ সালে ২৫ মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কর্তৃক গণহত্যা শুরু হওয়ার পর থেকেই পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধ হয়ে ওঠে অনিবার্য। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ ক্যাম্প, মুক্তাঞ্চল ও শরণার্থী শিবিরে মুক্তিবাহিনীর মনোবল জোগাতে যেসব শিল্পী সংগ্রাম ও স্বাধীনতার গান গেয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রেরণা ও শরণার্থী শিবিরের জন্য অর্থ সংগ্রহ করতেন মাহমুদুর রহমান বেণু তাদের অন্যতম। কলকাতার লেনিন রোডের ১৪৪ নম্বর বাড়িতে একদল শিল্পী মিলে গড়ে তুলেছিলেন ‘বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রামী শিল্পী সংস্থা’ নামে সাংস্কৃতিক সংগঠন। বেণু ছিলেন সেই সাংস্কৃতিক সংগঠনের সেক্রেটারি। ১৯৭১ সালে বাঙালিদের ওপর পাকিস্তানিদের নির্যাতনের চিত্র ধারণ করে প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণের জন্য মার্কিন চলচ্চিত্রকার লিয়ার লেভিন বাংলাদেশে এসে যুক্ত হয়েছিলেন বেণু ও তার সঙ্গীদের সঙ্গে। প্রয়াত চলচ্চিত্র নির্মাতা তারেক মাসুদ সম্পর্কে বেণুর চাচাতো ভাই, ১৯৯০ সালে বেণুর মাধ্যমে তারেক মাসুদ জানতে পারেন লিয়ার লেভিন সম্পর্কে এবং লেভিনের সেই ভিডিওচিত্রগুলো কিনে নেন। পরে লিয়ার লেভিনের ভিডিও ও বিভিন্ন দেশ থেকে সংগৃহীত ভিডিও চিত্রের ওপর ভিত্তি করে তারেক মাসুদ ও ক্যাথরিন মাসুদ তৈরি করেছিলেন ‘মুক্তির গান’ চলচ্চিত্রটি।
১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান গণসংগীতে নতুন প্রাণ সঞ্চার করে, দেখা মেলে নতুন গানের, নতুন শিল্পীর; এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন ইকবাল আহমেদ। যিনি স্বাধীনতার জন্য গান গেয়ে পাকিস্তানিদের রোষাণলে পড়েছিলেন। পাকিস্তানিদের অমানবিক নির্যাতনের মুখেও পড়তে হয়েছিল তাকে। ওয়াহিদুল হক, সন্জীদা খাতুন, জাহিদুর রহিমের কাছে রবীন্দ্রসংগীত ও শেখ লুৎফর রহমানের কাছে গণসংগীতের দীক্ষা নিয়েছেন ইকবাল। ১৯৭০ সালে এইচএমভির ব্যানারে প্রকাশিত ইকবাল আহমেদের গাওয়া রবীন্দ্রসংগীত ‘জানি জানি গো’ টপচার্টে উঠে এসেছিল। তিনি দুই মেয়েসহ সপরিবারে সুইজারল্যান্ডে বসবাস করছেন, বছর তিনেক আগে একবার ঢাকায় এসে জাতীয় জাদুঘরে গান পরিবেশন করেছিলেন।
১৯৭৫ সালে নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের সদস্য হিসেবে মঞ্চনাটকে যাত্রা শুরু করেন খালেদ খান। মঞ্চে তার অভিনীত নাটকের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘দেওয়ান গাজীর কিসসা’, ‘অচলায়তন’, ‘নূরলদীনের সারাজীবন’, ‘ঈর্ষা’, ‘দর্পণ’, ‘গ্যালিলিও’ ও ‘রক্তকরবী’। ‘ঈর্ষা’ নাটকে অভিনয়ের জন্য কলকাতায়ও তিনি জনপ্রিয়তা লাভ করেন। খালেদ খান নির্দেশিত নাটকের মধ্যে ‘মুক্তধারা’, ‘পুতুল খেলা’, ‘কালসন্ধ্যা’, ‘স্বপ্নবাজ রূপবতী’, ‘মাস্টার বিল্ডার’ ও ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ উল্লেখযোগ্য। ১৯৮১ সালে বিটিভির ‘সিঁড়িঘর’ নাটক দিয়ে টিভিতে অভিষেক তার। এর পর অসংখ্য টিভি নাটকে অভিনয় করেন। টিভি নাটকের মধ্যে ‘এই সব দিনরাত্রি’, ‘কোন কাননের ফুল’, ‘রূপনগর’, ‘মফস্বল সংবাদ’, ‘ওথেলো এবং ওথেলো’, ‘দমন’, ‘লোহার চুড়ি’ ও ‘সকাল সন্ধ্যা’ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। আকর্ষণীয় বাচনভঙ্গি নিয়ে খালেদ খান ছিলেন বিরল অভিনেতা। তাকে অভিনয়শিল্পেরও যুবরাজ বলা হতো। দীর্ঘদিন ধরে মোটর নিউরন সমস্যায় ভুগে মাত্র ৫৭ বছর বয়সে ২০১৩ সালের ২০ ডিসেম্বর মারা যান তিনি।
মঞ্চ, টিভি নাটক ও চলচ্চিত্রের জ্যেষ্ঠ অভিনেতা মাসুম আজিজ। চিত্রনাট্যকার ও নাট্য নির্মাতা হিসেবেও পরিচিতি আছে তার। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে তিনি থিয়েটারে কাজ শুরু করেন। এর পর ১৯৮৫ সালে অভিনয় করেন প্রথম টিভি নাটকে। মাসুম আজিজের রচনা ও নির্দেশনায় কিছুদিন আগেই মঞ্চে এসেছে নাটক ‘ট্রায়াল অব সূর্যসেন’। দীর্ঘ কর্মজীবনে তিনি ৪০০-এর অধিক নাটকে অভিনয় করেছেন। প্রশংসা পেয়েছেন বেশ কিছু চলচ্চিত্রে অভিনয় করেও। একুশে পদকপ্রাপ্তিতে মাসুম আজিজ বলেন, ‘খবরটি শোনার পর থেকে শুধু কান্না আসছে। আমার স্ট্রাগল তো কারো অজানা নয়। জীবনের সব সুখ আর আনন্দ বাদ দিয়ে থিয়েটার করেছি, নাটক করেছি। অভিনয়ে বিরতি দেইনি। এ প্রাপ্তি বোধহয় তারই ফল। সরকারকে অসংখ্য ধন্যবাদ।’
‘সব কটা জানালা খুলে দাও না’, ‘একটি বাংলাদেশ তুমি জাগ্রত জনতার’, ‘আমায় গেঁথে দাও না মাগো, একটা পলাশ ফুলের মালা’ কিংবা ‘পৃথিবীতে প্রেম বলে কিছু নেই’- অসাধারণ গানগুলোর শিল্পীর নাম অনেকেই জানলেও এ প্রজন্মের বেশির ভাগ মানুষ জানেন না এর স্রষ্টার নাম। তিনি নজরুল ইসলাম বাবু। বছরের পর বছর ধরে তার লেখা দেশের গান গাওয়া হয়। আধুনিক, চলচ্চিত্রের গানগুলোও মানুষের মুখে মুখে। এ মানুষটিকে রাষ্ট্রীয় মূল্যায়নের জন্য অনেক আগেই দাবি ছিল। অবশেষে এবার পেলেন। প্রয়াত এ গীতিকারের স্ত্রী শাহীন আক্তার বলেন, ‘ভাবতে ভালো লাগছে যে, অনেক বছর পর হলেও অবশেষে তিনি স্বীকৃতি পেলেন। দিনটি আমাদের জন্য বিশেষ স্মরণীয়। তিনি থাকলে হয়তো আরো বেশি খুশি হতেন।’
স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ধারায় নৃত্য চর্চার বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন জিনাত বরকতউল্লাহ। তার নৃত্যযাত্রা শুরু হয় সত্তরের দশক থেকে। নৃত্যগুরু জি এ মান্নানের কাছে প্রথম শিক্ষা নেন। ঢাকায় তিনি বুলবুল ললিতকলা কেন্দ্র ও বাফায় নাচ শিখেছেন। ভরতনাট্যম, কত্থক, মণিপুরী— উপমহাদেশের শাস্ত্রীয় নৃত্যের তিন ধারায় তালিম নিলেও জিনাত বরকতউল্লাহ পরে লোকনৃত্যকেই জীবনের পাথেয় করে নেন। ১৯৮০ সালে তিনি বিটিভির নাটক ‘মারিয়া আমার মারিয়া’ দিয়ে অভিনয় জীবন শুরু করেন। পরে আলোচিত ধারাবাহিক ‘ঘরে বাইরে’, ‘অস্থায়ী নিবাস’, ‘বড় বাড়ি’ ও ‘কথা বলা ময়না’সহ বেশ কয়েকটি টিভি নাটকে অভিনয় করেন।
অভিনেতা, নির্মাতা, লেখক ও চিত্রশিল্পী— নানা গুণে উজ্জ্বল আফজাল হোসেন। বৈচিত্র্যপূর্ণ অভিনয় দিয়ে দর্শকহূদয় জয় করেছেন। সত্তর দশকের মাঝামাঝিতে তিনি থিয়েটারে অভিনয় শুরু করেন। পরবর্তীকালে বাংলাদেশ টেলিভিশনে তালিকাভুক্ত হন। অসংখ্য জনপ্রিয় নাটকে অভিনয় করেছেন। আশির দশকে বাংলাদেশের নাটকে সুবর্ণা-আফজাল জুটি বিশেষ দর্শকপ্রিয়তা লাভ করে। ‘দুই জীবন’, ‘নতুন বউ’ ও ‘পালাবি কোথায়’র মতো সিনেমায় আফজাল হোসেনকে দেখা গেছে। ১৯৮৪ সালে তিনি বিজ্ঞাপন নির্মাণে যুক্ত হন। এ ছাড়া দেখা গেছে নাটক পরিচালনায়ও। লেখালেখিতেও তিনি সিদ্ধহস্ত। প্রকাশিত হয়েছে তার বেশ কিছু বইও।
নয়া শতাব্দী/এস
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ