চলচ্চিত্রাঙ্গনে তাদের যাত্রা শুরু হয়েছিল শিশুশিল্পী হিসেবে। পরবর্তীতে নায়িকা হিসেবে অভিষেক করেন। শিশুশিল্পী হিসেবে যেমন তাদের জনপ্রিয়তা ছিল নায়িকা হওয়ার পরও সেই ধারাবাহিকতা বজায় রাখেন তারা। এমন অভিনয়শিল্পীর সংখ্যা এ দেশের রুপালি পর্দার জগতে কম নয়। এ তালিকায় রয়েছেন শাবানা, সুচরিতা, অন্তরা, নাহিদা আশরাফ আন্না, তারিন জাহান, রুমানা রশীদ ঈশিতা, মেহের আফরোজ শাওন, নুসরাত ইমরোজ তিশা, পূজা চেরী, প্রার্থনা ফারদিন দীঘিসহ অনেকেই। তাদের থেকে পাঁচজনকে নিয়ে আজকের আয়োজন। লিখেছেন সিহাব হাসান
সুচরিতা
১৯৫৮ সালে জন্মগ্রহণ করেন ঢাকার সিনেমার গুণী অভিনেত্রী সুচরিতা। তার প্রকৃত নাম বেবী হেলেন। সিনেমায় এসে তার নাম সুচরিতা প্রচার পায়। অসংখ্য জনপ্রিয় ব্যবসাসফল ছবির এই সু-অভিনেত্রীর শুরুটা হয়েছিল একজন শিশুশিল্পী হিসেবে। ১৯৬৯ সালে শিশুশিল্পী হিসেবে ‘বাবুল’ ছবি দিয়ে চলচ্চিত্রে যাত্রা শুরু হয়। এরপর তিনি একে একে শিশুশিল্পী হিসেবে কাজ করছেন ‘নিমাই সন্ন্যাসী’, ‘অবাঞ্ছিত’, ‘রং বেরং’, ‘টাকা আনা পাই’, ‘কত যে মিনতি’, ‘রাজ মুকুট’ ছবিতে। ১৯৭২ সালে আজিজুর রহমান পরিচালিত ‘স্বীকৃতি’ ছবি দিয়ে প্রথমবার নায়িকা হিসেবে অভিষেক ঘটে। অভিনয় জীবনে তিনি প্রায় ১৫০ সিনেমায় অভিনয় করেছেন। রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি স্বরূপ তিনি ১৯৯৭ সালে চাষী নজরুল ইসলাম পরিচালিত ‘হাঙ্গর নদীর গ্রেনেড’ ছবির জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন।
তারিন জাহান
১৯৮৫ সালে জাতীয় সাংস্কৃতিক প্রতিভা অন্বেষণ ‘নতুন কুঁড়ি’তে অভিনয়, নাচ এবং গল্প বলাতে প্রথম হন। তখন থেকেই তিনি শিশুশিল্পী হিসেবে ছোট পর্দায় কাজ শুরু করেন। ১৯৮৮ সালে শহীদুল্লাহ কায়সারের উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত ধারাবাহিক নাটক সংশপ্তকে শিশু চরিত্রে অভিনয় করেন। প্রথম অভিনয়শিল্পী হিসেবে অভিনয় করেন তৗকীর আহমেদের সঙ্গে ‘কাঁঠাল বুড়ি’ নাটকে। এটি ছিল বাংলাদেশের প্রথম স্যাটেলাইট চ্যানেল এটিএন বাংলায় প্রচারিত প্রথম নাটক। এরপর থেকে এখন পর্যন্ত অসংখ্য নাটকে অভিনয় করেছেন এবং করছেন। ‘পিরীত রতন পিরীত যতন’ ও ‘কাজলের দিনরত্রি’ নামে দুটি সিনেমায় অভিনয় করেছেন। এ ছাড়া ভয়েস আর্টিস্ট হিসেবেও কাজ করেছেন তারিন। বাংলা চলচ্চিত্রে অভিনেত্রী শাবনুরের একটি সিনেমায়
কণ্ঠ দিয়েছেন তিনি। ভারতীয় বাংলা চলচ্চিত্রে প্রিয়াঙ্কা ত্রিবেদী এবং প্রিয়াঙ্কা ব্যানার্জীর হয়ে কণ্ঠ দিয়েছেন এই অভিনেত্রী।
মেহের আফরোজ শাওন
বিটিভির ‘এসো গান শিখি’ অনুষ্ঠানটি দিয়ে তার পথচলা শুরু। ছোটবেলা থেকে নাচ, গান দুটোতেই পারদর্শী। ১৯৮৯ সালে শিশুশিল্পী হিসেবে তুরস্কে গিয়ে রেডিওতে গান করেন তিনি। নব্বই দশকে ক্যারিয়ার শুরু করা অন্য তারকাদের মতো তিনিও নতুন কুঁড়ি বিজয়ী। তার প্রথম টিভি নাটক ‘জননী’। এরপর একে একে অভিনয় করেন নক্ষত্রের রাত, পুষ্পহার, সবুজ সাথী, আজ রবিবার, উড়ে যায় বকপক্ষী, কালা কইতর, সমুদ্র বিলাস প্রাইভেট লিমিটেড, হাবলঙ্গের বাজারে, রূপালী রাত্রি, সেদিন চৈত্রমাস, চৈত্র দিনের গান, বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল ইত্যাদিসহ অসংখ্য দর্শকনন্দিত নাটকে। শাওন প্রথম সিনেমায় অভিনয় করেন ‘শ্রাবণ মেঘের দিনে’। তার অভিনীত ‘দুই দুয়ারী’, ‘চন্দ্রকথা’, ‘শ্যামল ছায়া’ ও ‘আমার আছে জল’ ছবিগুলো বেশ দর্শক নন্দিত। হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুর পর তিনি তার উপন্যাস অবলম্বনে নির্মাণ করেন ‘কৃষ্ণপক্ষ’। তার ‘নক্ষত্রের রাত’ অবলম্বনে সিনেমা নির্মাণের ঘোষণা দিলেও তার শুটিং এখনো শুরু করতে পারেননি। বর্তমানে অভিনয় কমিয়ে দিলেও নিয়মিতই হুমায়ূন আহমেদের গল্পে নাটক নির্মাণ করছেন।
নুসরাত ইমরোজ তিশা
জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার বিজয়ী এ অভিনেত্রীর শুরুটা বিটিভির ‘নতুন কুঁড়ি’ প্রতিযোগিতা দিয়ে। ১৯৯৫ সালে তিনি প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন। চার বন্ধু মিলে গঠন করেছিলেন গানের দল ‘অ্যাঞ্জেলফার’। যদিও একটা সময় গিয়েসটি বন্ধ হয়ে যায়। শিশুশিল্পী হিসেবে ‘সাত প্রহরের কাব্য’ নাটকে অভিনয় করেন ১৯৯৮ সালে। তখন বয়স ছিল মাত্র ১১ বছর। নাটকটি রচনা করেন অনন্ত হীরা এবং পরিচালনা করেন আহসান হাবীব। তার ক্যারিয়ারের টার্নিং পয়েন্ট ২০০৩ সালে প্রচারিত আরসি কোলার বিজ্ঞাপন। মোস্তফা সরোয়ার ফারুকীর ক্যারাম ১ম পত্র, ৬৯ নাটকগুলো দিয়ে আলোচনায় আসেন। শেষ প্রান্তে, ক্যারাম ২য় পত্র, প্রভাতী সবুজ সংঘ, ওয়েটিং রুম, কাননে কুসুম কলি, ইট খাটের খাঁচা, ঊনমানুষ, লাটাই, গ্র্যাজুয়েট, মুনিরা মফস্বলে, ৪২০সহ অসংখ্য জনপ্রিয় নাটকে অভিনয় করে এক সময় নিজেকে টেলিভিশন ইন্ডাস্ট্রির এক নম্বর নায়িকা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। তিনি প্রথম সিনেমায় অভিনয় করেন ‘থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার’-এ। ‘হালদা’, ‘টেলিভিশন’, ‘অস্তিত্ব’, ‘ডুব’ সিনেমাগুলোতে তার অভিনয় প্রশংসিত হয়। ২০১৬ সালে ‘অস্তিত্ব’ সিনেমার জন্য ‘সেরা অভিনেত্রী’ হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার জিতেন। সংসারে সময় বেশি দিলেও এর মাঝেও নাটক ও চলচ্চিত্রে অভিনয় ঠিকই চালিয়ে যাচ্ছেন।
পূজা চেরী
মা ঝর্ণা রায়ের ইচ্ছে ছিল মেয়েকে আইনজীবী বানাবেন। একটি ঘটনায় তিনি সিদ্ধান্ত বদলে ফেলেন। ঘটনাটা প্রথম শ্রেণিতে পড়াকালীন। পাশের বাসার এক আন্টির মাধ্যমে বুটিক হাউসের মডেল হন পূজা। ওই বিজ্ঞাপন চিত্রের শুটিংয়ের সময় তার মায়ের সঙ্গে পরিচালক শাহ আলম ম-লের পরিচয় হয়। তার মাধ্যমে জাকির হোসেন রাজুর ‘মনের ঘরে বসত করে’তে শাকিব খানের ছোট বোনের চরিত্রে অভিনয়ের প্রস্তাব পান। চার-পাঁচ দিন শুটিংও করেন। কিন্তু মুক্তির পর পুরো ছবির কোথাও মেয়ের কোনও অস্তিত্ব পাননি মা। রাজধানীর বিডিআর সিনেমা হলে ২০ জনকে নিয়ে মেয়ের ছবি দেখতে গিয়েছিলেন। সবার সামনে লজ্জা পেলেন। জেদ চেপে যায় মায়ের। সে জেদের ফল আজকের পূজা চেরি। শিশুশিল্পী হিসেবে অভিনয় করেন ‘ভালোবাসার রং’, ‘তবুও ভালোবাসি’, ‘অগ্নি’, ‘ভালোবাসতে মন লাগে’, ‘কৃষ্ণপক্ষ’ ও ‘বাদশা দ্য ডন’ সিনেমায়। নায়িকা হিসেবে অভিষেক হয় ‘নূর জাহান’ দিয়ে। এ ছাড়া পূজা অভিনীত ‘ পোড়ামন ২’, ‘দহন’ ও ‘প্রেম আমার টু’ ছবিগুলো মুক্তি পেয়েছে।
প্রার্থনা ফারদিন দীঘি
চলতি বছর দেলোয়ার জাহান ঝন্টুর পরিচালনায় ‘তুমি আছো তুমি নেই’ ছবি দিয়ে চলচ্চিত্রে নায়িকা হিসেবে অভিষেক হয় দীঘির। কিন্তু নায়িকা দীঘি হবার পূর্বেই দর্শকরা তাকে শিশুশিল্পী দীঘি হিসেবে চিনে নিয়েছেন। একজন শিশুশিল্পী হিসেবে দীঘি ছিলেন তুমুল জনপ্রিয় ও তুখোড় অভিনয় শিল্পী। শিশুশিল্পী হিসেবেই অর্জন করে নিয়েছেন তিনবার রাষ্ট্রীয় সম্মাননা। তাই বলা যায় ছোট বেলায় তারকার তকমা নিয়ে ফেলছে তিনি। যদিও তার নায়িকা হিসেবে অভিষেক মোটেও আশাব্যঞ্জক হয়নি। তবুও বর্তমানে তার হাতে বেশকিছু ভালো ভালো প্রজেক্ট রয়েছে। শিশুশিল্পী হিসেবে দীঘি ২০০৬ সালে কাজী হায়াৎ পরিচালিত ‘কাবুলিওয়ালা’ ছবিতে অভিনয় করেন। প্রথম ছবি দিয়েই বাজিমাত করেন শিশু দীঘি। একের পর এক সিনেমায় অভিনয় করে তুমুল জনপ্রিয়তা অর্জন করে। দর্শকদের বহু জনপ্রিয় সিনেমা উপহার দেন। ‘চাচ্চু’, ‘দাদিমা’, ‘সাজঘর’, ‘অবুঝ শিশু’, ‘কপাল’, ‘১ টাকার বউ’, ‘পিরিতের আগুন জ্বলে দ্বিগুণ’, ‘পাঁচ টাকার প্রেম’, ‘রিকশাওয়ালার ছেলে’, ‘চাচ্চু আমার চাচ্চু’, ‘জীবন মরণের সাথী’, ‘টপ হিরো’, ‘ছোট্ট সংসার’, ‘তোর কারণে বেঁচে আছি’, ‘দ্য স্পিড’, ‘লীলামন্থন’সহ আরও অনেক ছবি।
নয়া শতাব্দী/এসইউ
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ