‘ছাত্র জীবনে আমি যখন ইন্টারমিডিয়েটে পড়ি তখন যৌনকর্মীদের ওপরে একটা গল্পের প্লট মাথায় এসেছিল। এটা ’৮২-৮৩ সালের দিকে। তখন যৌনকর্মীদের জীবন সম্পর্কে বিভিন্ন বিষয়ে প্রতিটি চরিত্রের কথা চিন্তা করে একটা গল্প ভাবছিলাম। নাম দিয়েছিলাম ‘অস্পৃশ্যা’। আমার প্ল্যান ছিল ভবিষ্যতে আমি এটাকে শর্টফিল্ম হোক বা ফিচার ফিল্ম হোক, এই গল্পটা নিয়ে কাজ করব। প্রায় ১০-১২টা চরিত্র নিয়ে আমি গল্পটা সাজাচ্ছিলাম। সে সময়ে লক্ষ্য করলাম যে, আমাদের দেশে মুক্তিযুদ্ধের বিষয়গুলো একদম আড়ালে চলে যাচ্ছে, একাত্তরের সময়গুলো, বঙ্গবন্ধু বা আমাদের বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিষয়গুলো এতটা ধামাচাপা দেয়া হচ্ছিল সেই জিয়াউর রহমানের সময় থেকে শুরু করে এরশাদের আমল পর্যন্ত; তখন আমার কাছে মনে হচ্ছিল যে এখন আর কেউ মুক্তিযুদ্ধের সিনেমা দেখে না। এমনকি সরকারগুলোও এক ধরনের সেন্সরশিপের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের সিনেমা নির্মাণে নিরুৎসাহিত করছিল।
১৯৭৫’র পর দেশটা ইউটার্ন করে। তখন মুক্তিযুদ্ধের ছবি নিমার্ণে এক ধরনের নিরুৎসাহিতকরণও চলে। তখন আমি ভাবলাম মুক্তিযুদ্ধের ভালো গল্পে মেইনস্ট্রিম আর্টিস্টদের নিয়ে কাজ করলে হয়ত দর্শক সিনেমা দেখতে পারেন। ওই সময়ে আমি গোয়ালন্দ, টাঙ্গাইল, নারায়ণগঞ্জ সেইসব এলাকায় যৌনপল্লীগুলোতে বয়স্ক নারী-পুরুষদের কাছে শোনা গল্প থেকে মুক্তিযুদ্ধের সময়কার কী অবস্থা ছিল, সে বিষয় কিছু তথ্য পাই।
একাত্তরে যৌনপল্লীগুলোর পরিস্থিতি, যৌনকর্মীদের ভেতরকার দ্বন্দ্ব, স্বাধীনতার সময়ে কারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বা বিপক্ষে ছিল, এমন বিষয়গুলো আমার গল্পে তখন আমি সংযোজন করি। এরপর গল্পটা আমি এইভাবে রেখে দেই। তারপর ২০০৩-০৪ সালের দিকে যখন ‘মাতৃত্ব’ করলাম, তখন ‘অস্পৃশ্যা’ গল্পটার ব্যাপারে একজন আমাকে উৎসাহিত করলেন যে এই গল্পটা করা যেতে পারে।’
কথাগুলো চিত্রনায়ক মান্না অভিনীত শেষ ছবি ‘জীবন যন্ত্রণা’র নির্মাতা জাহিদ হোসেনের। এ ছবি নির্মাণের পেছনের গল্প দিয়েই শুরু হলো প্রয়াত চিত্রনায়ক মান্না সম্পর্কে আলাপচারিতা। জানা যায়, ‘অস্পৃশ্যা’ গল্পটিই আগামী বছরের ২৬ মার্চ পর্দায় আসছে ‘জীবন যন্ত্রণা’ হয়ে। এ সিনেমায় মান্না ছাড়াও অভিনয় করেছেন মৌসুমী, পপি, শাহনূর, মুক্তি, দীঘি, বাপ্পারাজ, আলীরাজ, আনোয়ারা, শহিদুল আলম সাচ্চু, মিশা সওদাগর প্রমুখ।
পরিচালক জানান, মান্নার সঙ্গে যখন কথা হলো তখন তিনি চিত্রনাট্য না পড়েই রাজি হয়ে যান। এমনকি এই চিত্রনায়ক পরিচালককে সময় বেঁধে দেন যে আগামী ১০ দিনের মধ্যেই সিনেমাটি শুরু করতে হবে। জাহিদ হোসেন বলেন, ‘আমার হাতে সময় ছিল মাত্র ৯ দিন। তখন এই অল্প দিনের মধ্যেই ফোনে ফোনে কথা বলে সব শিল্পীদের রাজি করিয়ে ফেলি। সব কিছু ম্যানেজ করি। আর এটা সম্ভব হয়েছে আমার ‘মাতৃত্ব’ ছবির কারণে। যার সঙ্গেই কথা বলেছি, সবাই কাজ করতে রাজি হয়ে যায়।’
পরিচালক বলেন, ‘মান্না তখনো চিত্রনাট্য বা গল্প সম্পর্কে জানেনই না। তাকে শুধু বললাম আপনার চুল যেমন আছে তেমনই থাকুক, এখন থেকে শুট শুরু হওয়া পর্যন্ত চুল কাটবেন না। আর ড্রেস বা গেটআপ কেমন হবে, সেটার দায়িত্ব আমার।’
চিত্রনাট্য সম্পর্কে মান্নাকে কখন জানালেন, এমন প্রশ্নে জাহিদ হোসেন বলেন, ‘সেটে যখন তিনি (মান্না) এলেন, তখন গল্প সম্পর্কে তাকে জানাই। বলি যে, একাত্তরের সময়ে যৌনকর্মীদের একটা গল্প নিয়ে এই ছবি। নাম ‘লীলামন্থন’। এতেই তিনি রাজি। এমনকি চরিত্র সম্পর্কেও তখন ব্রিফ দেয়া হয়নি। কিন্তু শুটিং করতে করতে চরিত্রটির সঙ্গে মিশে গিয়েছিলেন তিনি।’
চিত্রনায়ক মান্নার সঙ্গে ‘জীবন যন্ত্রণা’ ছবির শুটিংয়ের প্রথম দিনের স্মৃতিচারণা করে জাহিদ হোসেন বলেন, ‘প্রথম দিন নির্ধারিত সময়েই চলে আসেন মান্না। বললেন, ছবিতে আমার চরিত্রটা কী, জাহিদ ভাই? বললাম, একটা-দুইটা সিক্যুয়েন্স হোক, আপনি এমনিতেই বুঝে যাবেন আপনার চরিত্র। মূলত মান্না যেহেতু সব সময় কমার্শিয়াল সিনেমায় কাজ করে অভ্যস্ত, সেই চিন্তা থেকেই আগে আমি তার চরিত্র সম্পর্কে ব্রিফ দেইনি। আমার একটা চিন্তা ছিল, আগে যদি বলে দেই তাহলে তার মাথায় সেইটা গেঁথে যাবে। এছাড়া প্রথম দিন তিনি ডায়লগ দিচ্ছিলেন পুরো কমার্শিয়াল সিনেমার মতো। কিন্তু আমি বললাম যে, না, ডায়লগ থ্রোটা এইভাবে না ওইভাবে হবে।
তখন তিনি বললেন, আমি কেন এইভাবে ডায়লগ দিব! আমি জানালাম, চরিত্রের প্রয়োজনেই আপনাকে এভাবে বলতে হবে। এছাড়া মৌসুমীরা ছিলেন তারা বললেন যে, মান্না ভাই জাহিদ ভাই যেভাবে বললেন, সেভাবেই করেন, ভালো হচ্ছে। এরপর একসময় মান্না নিজেই বোঝতে পারেন চরিত্রটি সম্পর্কে।’
জানা যায়, ২০০৬ সালে শেখ মুজিবুর রহমান ইকবালের প্রযোজনায় শুরু হয়েছিল সিনেমার শুটিং। টানা ১০ দিন কাজ করেন মান্না। এরপর বিদেশ গিয়েছিলেন। ফেরার পর আর শিডিউল মেলানো যাচ্ছিল না। এরই মধ্যে চলে এল ওয়ান-ইলেভেন তত্ত্বাবধায়ক সরকার। প্রযোজক আড়ালে চলে যান। কিন্তু শিল্পীরা সবসময় পরিচালকের কাছে সিনেমাটি সম্পর্কে খোঁজ-খবর নিতেন যে, কবে আবার কাজ শুরু হবে। অবশেষে খোরশেদ আলম খসরুর প্রযোজনায় আবারো সিনেমাটির কাজ শুরু হয়। তখন আর বেঁচে নেই কিংবদন্তি চিত্রনায়ক মান্না। ২০০৮ সালে প্রয়াত হন তিনি। তার বদলে আবার নতুন দু’জনকে নিয়ে শুরু হয় সিনেমার কাজ।
জানা যায়, মান্নার অংশের বেশির ভাগ কাজই সম্পন্ন ছিল। যুদ্ধে শুধু তিনি মারা যাবেন এমন একটি দৃশ্য বাকি ছিল। পরবর্তীতে দৃশ্যটি ডামি আর্টিস্টের মাধ্যমে দৃশ্যায়ন হয়। এবং মান্না না থাকা এ ছবিতে নতুন শিল্পী হিসেবে যুক্ত হন বাপ্পারাজ ও দীঘি। অবশেষে তাদের নিয়েই শেষ ছবির কাজ।
পরিচালক জানান, ছবিটি সম্পর্কে বেশ কৌতূহলী ছিলেন মান্না। প্রায়ই তিনি ছবিটির ফুটেজ দেখতে চাইতেন পরিচালকের কাছে। কিন্তু ব্যস্ততার কারণে তা আর সম্ভব হয়নি। জাহিদ হোসেন বলেন, “জীবন যন্ত্রণা’ হলো মান্নার ক্যারিয়ারের শ্রেষ্ঠ একটি কাজ।’
নয়া শতাব্দী/এমআর
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ