প্রবাদে আছে, ‘স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে স্বাধীনতা রক্ষা করা কঠিন’। সৃষ্টিশীল কাজের জন্য স্বাধীনতা প্রয়োজন, কিন্তু যখন এর অপব্যবহার হয় তখনই বিপত্তি বাঁধে। সাম্প্রতিক সময়ে ওটিটি প্ল্যাটফর্মে নির্মাতাদের স্বাধীনতা থাকায় এক শ্রেণির নির্মাতা যেন সেই স্বাধীনতা আর ধরে রাখতে পারছেন না। সামাজিক বাস্তবতা তুলে ধরার চেয়ে দর্শক কাটতির দিকেই তাদের আগ্রহ বেশি। এমনকি অবাধে বানিয়ে যাচ্ছেন ১৮ প্লাস কনটেন্ট। যেগুলো নিয়ে প্রায়ই অতিমাত্রায় অশ্লীল সংলাপ বা যৌন সুড়সুড়ি দেয়ার মতো অভিযোগ তুলেন বিভিন্ন মহল। বিগত চার-পাঁচ বছরে নাটক আর ওয়েব সিরিজ নিয়ে এই অভিযোগ বেশি। সম্প্রতি নাট্যনির্মাতা মেহেদী হাসান হৃদয়ের ‘টোটাল কাপজাপ’ নাটক নিয়ে তেমনই অভিযোগ উঠেছে আবার। এর আগেও বেশকিছু নাটক এবং ওয়েব সিরিজ নিয়ে এই ধরনের অভিযোগ উঠেছে।
অনেকে বলেন, নাটকে অশ্লীলতা শুরু ‘আবাসিক হোটেল’ শিরোনামের একটি নাটকের মধ্য দিয়ে। ২০১৭ সালে ইউটিউবে প্রকাশ পায় এটি। এরপর থেকে নাটকে অশ্লীলতা বাড়তে থাকে। সাম্প্রতিক সময়ে ‘ব্যাচেলর ট্রিপ’, ‘শোবার ঘর’, ‘টম অ্যান্ড জেরি ২’, ‘দুদুমিয়া’সহ বেশকিছু নাটকে অশ্লীল সংলাপ নিয়ে অভিযোগ উঠেছে। আর ওয়েব সিরিজের ক্ষেত্রে ‘১৪ অগাস্ট’, ‘বুমেরাং’ ও ‘সদরঘাটের টাইগার’ নিয়ে এমন অভিযোগ উঠেছিল। তখন দেখা যায় ১৮ প্লাস কনটেন্ট নিয়ে বেশ সোচ্চার হয়ে ওঠেন গণমাধ্যম থেকে শুরু করে নাট্যাঙ্গনের মানুষেরা।
দেশের সিনিয়র অভিনয়শিল্পীদের ৭৯ জন তখন একটি বিবৃতিতে কঠোর ভাষায় ওয়েব সিরিজগুলোর সমালোচনা করেন। তারা বলেন, ‘অনেকদিন ধরে কিছু ইউটিউব এবং ওয়েব প্ল্যাটফর্মে অত্যন্ত দায়িত্বহীনতার সঙ্গে কিছু নির্মাতা প্রযোজক, নাট্যকার ও অভিনয়শিল্পী কুরুচিপূর্ণ নাটক পরিবেশন করে আসছে। এই নাটকগুলোর মধ্যে কাহিনির প্রয়োজনে নয়, একেবারেই বিকৃত রুচিসম্পন্ন নাটক নির্মাণ করে বিবেকবান ও সচেতন দর্শকদের মধ্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে। আমরা এহেন কাজকে তীব্রভাবে নিন্দা জানাই।’
তবে এ ধরনের বিতর্কজনিত বিষয়ে অনেক নির্মাতা আবার দ্বিমতও পোষণ করেন। তাদের প্রশ্ন এসব নিয়ে বিতর্কের কারণ কী নতুন কিছু গ্রহণ করতে না পারার মানসিকতা? নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক নির্মাতার ভাষ্য, ‘যখনি নতুন কিছু আসে বা দেখতে অভ্যস্ত না এমন কিছু আসলে সেটা বিতর্ক তৈরি করে। হুমায়ূন আহমেদ যখন সহজ ভাষায় লেখা শুরু করেন তখন বলা হলো এটা ঠিক উপন্যাসের ভাষা নয়। আবার টেলিভিশনে যখন ঘরোয়া স্টাইলে সংলাপ বলা শুরু হলো তখনো সমালোচনা হলো। তবে এবারের বিতর্ক আরো দুঃখজনক। কারণ ওয়েব সিরিজ কোনো ওপেন প্ল্যাটফর্মে নেই। এটা কিনে দেখতে হয়। অর্থাৎ যে দেখবে এটি তার সিদ্ধান্ত। কেউ দেখলে দেখবে, না দেখলে নেই। কিন্তু এটি থাকা যাবে না এমনটি বলা অন্যায়।’
তবে ২০২০ সালে দেশের ১১৮ জন নির্মাতা এক বিবৃতিতে বলেন, ‘আমাদের দেশে ওয়েব প্ল্যাটফর্মের পথচলাটা যেহেতু খুব নতুন সেখানে প্রথমেই কোনো বিচ্যুতি বা ভুলভাবে ব্যাখ্যা হবার কারণে যদি শুরুতেই এর চলার পথটা থমকে যায়, অথবা এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কলাকুশলীরা সাইবার বুলিংয়ের শিকার হয় বা বৈচিত্র্যময় কনটেন্ট নির্মাণের পথ বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে তা বাংলাদেশের বিনোদন শিল্পের জন্য একটি বিরাট অন্তরায় হিসেবে দেখা দিবে।’
একই বিবৃতিতে তারা অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলোর জন্য আধুনিক নীতিমালা প্রণয়নে সরকারের কাছে দাবি জানান। বিবৃতিতে তারা বলেন, ‘টিভি বা ওয়েব সিরিজ যাই হোক না কেন তার জন্য একটি স্বাধীন মতামত প্রকাশের সুযোগ বাস্তবায়ন ও সেই সঙ্গে পাইরেসি প্রতিরোধ করে নির্দিষ্ট প্ল্যাটফর্মের কনটেন্ট নির্দিষ্ট প্ল্যাটফর্মে পরিবেশনার ব্যাপারে একটি আধুনিক নীতিমালা করতে সরকার আইনানুযায়ী ব্যবস্থা নিবেন এবং এই বৈশ্বিক ডিজিটাল অর্থনৈতিক বিপ্লবে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ সুনিশ্চিত করার সুযোগ তৈরি করবেন বলেই আমরা বিশ্বাস করি।’
এদিকে আবার অভিনয়সংশ্লিষ্ট অনেকে মনে করেন কঠোর আইন প্রণয়নে নাটক, সিনেমা কিংবা ওয়েব সিরিজ নির্মাণের পথ আরো রুদ্ধ হয়ে যাবে। কয়েকজন নির্মাতার সঙ্গে শতাব্দীর শোবিজের কথা হলে এমনটা জানান তারা। তাদের ভাষ্য, ‘যখন কোনো নির্মাতা একটা নাটক, ওয়েব সিরিজ বা সিনেমা নির্মাণ করেন, তখন তারই সেটা নির্ধারণ করা উচিত যে কী ধরনের বিষয় তিনি পর্দায় তুলে ধরতে চান। এমনকি তার মধ্যে সেই জ্ঞানটুকুও থাকা প্রয়োজন। টেকনিক্যালি কিন্তু এমন সুড়সুড়ি অথবা খোলামেলা দৃশ্যও এড়ানো যায়।’
নয়া শতাব্দী/এমআর
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ