সবুজে ঘেরা, পাহাড় বেষ্টিত ক্যাম্পাস চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। মুক্তিযুদ্ধের পাঁচ বছর আগে ১৯৬৬ সালের ১৮ নভেম্বর প্রতিষ্ঠিত হয় এ বিশ্ববিদ্যালয়। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধসহ দেশের বিভিন্ন আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। বিশেষ করে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান অনস্বীকার্য। প্রায় ২০০ ছাত্র-শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। স্বাধীনতা যুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক, ১২ শিক্ষার্থীসহ তিন কর্মকর্তা শহীদ হন। মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রকৌশল দফতরের কর্মচারী মোহাম্মদ হোসেনকে বীরপ্রতীক খেতাব দেয়া হয়।
১৯৭১ সালের ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের পরে ৮ মার্চ তৎকালীন উপাচার্য ড. এ. আর মল্লিকের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক সভায় ছাত্র-শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়ে পাকিস্তানিদের সম্ভাব্য আক্রমণের প্রতিরোধ করার লক্ষ্যে গঠিত হয় ‘চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সংগ্রাম পরিষদ’। ইতিহাস বিভাগের শিক্ষক ইনামুল হকের নেতৃত্বে অস্ত্র চালনার প্রশিক্ষণ প্রদান কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। পাশাপাশি পাকিস্তানি সৈন্যরা যেন বিশ্ববিদ্যালয়কে দখলে নিতে না পারে সে জন্য রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত হওয়ার প্রস্তুতি চলতে থাকে।
২৬ মার্চ সকালে পাকিস্তানি সেনারা ক্যাম্পাস দখল করতে এলে পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণ ঠেকাতে সংগ্রাম পরিষদ আলাওল হলকে ঘাঁটি করে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ব্যূহ গড়ে তোলে। টানা ১০ দিন প্রতিরোধ করার পরে ৫ এপ্রিল প্রশিক্ষিত পাকিস্তানি সেনাদের গোলন্দাজদের তুমুল আক্রমণে সংগ্রাম পরিষদ পিছু হটতে বাধ্য হয়। এরপর থেকে দীর্ঘ নয় মাস চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসকে কনসেনট্রেশান ক্যাম্প বানিয়ে দখল করে রাখে হানাদার বাহিনী। পরবর্তীতে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানিরা আত্মসমর্পণ করার ৯ দিন পর ২৫ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় হানাদারমুক্ত হয়।
বিভীষিকাময় এ স্বাধীনতা যুদ্ধে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকসহ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ১৬ জন শহীদ হন। তারা হলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশল দফতরের চেইনম্যান বীরপ্রতীক মোহাম্মদ হোসেন, দর্শন বিভাগের খণ্ডকালীন শিক্ষক অবনী মোহন দত্ত, চাকসুর সাধারণ সম্পাদক ইতিহাস বিভাগের ছাত্র আবদুর রব, উপ-সহকারী প্রকৌশলী প্রভাস কুমার বড়ুয়া, বাংলা বিভাগের ছাত্র মনিরুল ইসলাম খোকা, মোহাম্মদ হোসেন ও মোস্তফা কামাল, অর্থনীতি বিভাগের ছাত্র নাজিম উদ্দিন খান ও আবদুল মান্নান, ইতিহাস বিভাগের ছাত্র ফরহাদ উদ-দৌলা, বাণিজ্য অনুষদের ছাত্র খন্দকার এহসানুল হক আনসারি, ইংরেজি বিভাগের ছাত্র আশুতোষ চক্রবর্তী, সমাজতত্ত্ব বিভাগের ছাত্র ইফতেখার উদ্দিন মাহমুদ, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র আবুল মনসুর, গণিত বিভাগের ছাত্র ভুবন (সূত্র: মুক্তিযুদ্ধের মহানায়করা-নভেম্বর ১৮, ২০১৬-দৈনিক পূর্বকোণ এবং আলাওল হলের প্রহরী ছৈয়দ আহমদ)।
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও শহীদের স্মৃতি রক্ষার লক্ষ্যে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে দুটি স্মৃতিস্তম্ভ ও একটি ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়েছে। তৎকালীন চাকসুর সাধারণ সম্পাদক ইতিহাস বিভাগের ছাত্র শহীদ আবদুর রব স্মরণে একটি ছাত্র হলের নামকরণ করা হয়েছে। পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের স্মরণে ক্যাম্পাসে বিভিন্ন সড়কের নামকরণ করা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস চর্চায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারে চালু করা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি কর্নার।
নয়াশতাব্দী/এমএস
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ