ঢাকা, শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১, ১৭ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

জগন্নাথ হল গণহত্যা : ইতিহাসের কালো অধ্যায়

প্রকাশনার সময়: ১৪ ডিসেম্বর ২০২২, ২১:০৮

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তান হানাদার বাহিনী এবং তাদের এ দেশীয় দোসররা বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধা, বিশিষ্টজন, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিকদের নৃশংসভাবে হত্যা করেছিল। নৃশংস হত্যাকাণ্ডের অন্যতম সাক্ষী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল।

জগন্নাথ হলেই সমাহিত আছেন ১৯৭১ সালে জগন্নাথ হলের প্রাধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী ড. জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা। তাকে ২৫ মার্চ ‘অপারেশন সার্চলাই’ বাস্তবায়নের প্রথম টার্গেটদের মধ্যে রাখা হয়েছিল। পাকিস্তান আর্মি ওই অভিশপ্ত রাতে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থেকে বের হয়ে এসে কয়েকটি ভাগে ভাগ হয়। একটি দল যায় ধানমণ্ডি ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করার জন্য। আরেকটি দল ট্যাংক ও সাঁজোয়া বহর নিয়ে যায় পিলখানায় ইপিআর (অধুনা বিজিবি) সদর দপ্তরে। অপর একটি দলের গন্তব্য ছিল রাজারবাগ পুলিশ লাইন। বড় একটি দল রওনা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, যা অভিহিত ছিল স্বাধীনতা আন্দোলনের পীঠস্থান হিসেবে।

হানাদার বাহিনী জগন্নাথ হলের প্রাধ্যক্ষ ড. গুহঠাকুরতাকে তার বাসভবনে গুলি করে। তাৎক্ষণিক মৃত্যু হয়নি তার। আশপাশের লোকজন প্রচণ্ড গোলাগুলির মধ্যেই বাড়ির বিপরীতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তাকে নিয়ে যান। তার পাশের বেডে ছিলেন জগন্নাথ হলের ছাত্র সুরেশ দাস। গুলি লেগেছিল তার গলায়। জগন্নাথ হলের উত্তর বাড়ির ছাদে উঠেছিলেন প্রাণ বাঁচাতে। সঙ্গে ছিলেন আরও ৯ জন। ২৬ মার্চ সকালে পাকিস্তান আর্মি ছাদে উঠে তাদের দেখতে পায়। সে সময় একজন প্রাণভয়ে নিচে লাফ দেয়। এ অবস্থাতেই তাকে ওপর থেকে গুলি করে হত্যা করা হয়। সুরেশ দাসসহ বাকি ৯ জনকে তিনজন করে লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলি করা হয়। সৌভাগ্যক্রমে তিনি ছিলেন পেছনে এবং সামনের দুজনের তুলনায় একটু বেঁটে। ফলে তাদের যে বুলেটটি বুকে বিদ্ধ করে সেটি লাগে তার গলায়। এই বর্বরতার পর পাকসেনা কিছু সময়ের জন্য নিচে চলে গেলে সুরেশ দাস অতিকষ্টে নেমে আসেন এবং তাকে ২৭ মার্চ সকালে কারফিউ প্রত্যাহারের পর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান পরিমল গুহ। গুলিতে বেঁচে যাওয়া দুজন জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা এবং সুরেশ দাসের স্থান হয় পাশাপাশি বেডে।

পরিমল গুহ ছিলেন হল ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক। ২৫ মার্চ আর্মি অভিযান শুরু হলে তিনি হলের একটি ম্যানহোলে আশ্রয় নিয়ে জীবন বাঁচান। চোখের সামনে দেখেন বীভৎসতা। স্মৃতিচারণে তিনি বলেন, ২৮ মার্চ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা ও সুরেশ দাসকে আমি দেখতে যাই। ২৯ ও ৩০ মার্চও যাই। ২৯ মার্চ সুরেশ দাসের হাতে সে সময়ে ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি (বর্তমান শিক্ষামন্ত্রী) নুরুল ইসলাম নাহিদের দেওয়া ১০০ টাকা তুলে দিই। ২৫ মার্চ যখন ক্যান্টনমেন্ট ছেড়ে আর্মি শহরে বের হয়ে এসেছে তখন নুরুল ইসলাম নাহিদ ও সাবেক ছাত্রনেতা শেখর দত্ত রাতে আশ্রয় নেবেন বলে রওনা হয়েছিলেন ড. জিসি দেবের বাসার উদ্দেশে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা আর্মির নিয়ন্ত্রণে চলে যাওয়ায় তারা চলে যান হোসেনী দালান এলাকায়। ৩০ মার্চ সকালে হাসপাতালে গেলে সুরেশ দাস জানান, জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতার মৃত্যু হয়েছে। পাকিস্তানি সেনারা এসে তার মরদেহ নিয়ে গেছে; কোথায় রেখেছে কেউ বলতে পারে না। চিকিৎসকরা তাকেও হাসপাতাল ছাড়তে বলেন। এ কাজে কয়েকজন চিকিৎসক তাকে সহায়তা দেন। সুনামগঞ্জে আইন পেশায় নিযুক্ত সুরেশ দাস গুলিবিদ্ধ হওয়ার ৪৪ বছরেরও বেশি সময় পর্যন্ত বেঁচে আছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দর্শন বিভাগের চেয়ারম্যান দার্শনিক ড. জিসি দেব জগন্নাথ হলের এই বধ্যভূমিতে চিরনিদ্রায় শায়িত রয়েছেন। এখানেই মাটিচাপা দেওয়া হয়েছে জগন্নাথ হলের আবাসিক শিক্ষক অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্যকে।এখানেই রয়েছেন মধুর ক্যান্টিন খ্যাত সবার প্রিয় মধুসূধন দে বা মধুদা। কেবল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ও শিক্ষকদের তিনি মধুদা ছিলেন না; বাংলাদেশ যারা চেয়েছেন উন্নত ও সুন্দর জীবনের যারা স্বপ্ন দেখেছেন, তাদের সবার তিনি ছিলেন মধুদা।

জগন্নাথ হলের এই গণকবরেই স্থান হওয়ার কথা ছিল কালীরঞ্জন শীলের। তিনি মৃত্যুঞ্জয়ী। ২৫ মার্চ রাতে তিনি জগন্নাথ হলের দক্ষিণ বাড়ির কার্নিশে শোয়ে প্রাণ বাঁচান। ২৬ মার্চ সকালে ধরা পড়েন পাকিস্তানি সৈন্যদের হাতে। তার মতো আরও কয়েকজন ছাত্রকে দিয়ে জগন্নাথ হলে অবস্থানরতদের মরদেহ বহন করানো হয় হলের শহিদ মিনারের পাশে। ড. জিসি দেব নিহত হয়েছিলেন শিববাড়ি এলাকায়। সেখানেই হত্যা করা হয় মধুর ক্যান্টিনের কর্ণধার মধুসূধন দে, তার স্ত্রী, পুত্র ও পুত্রবধূকে। হলের আশপাশে নিহত আরও অনেকের মরদেহ এভাবে একত্রিত করা হয়। তারপর এই মরদেহ বাহকদের গুলি করে হত্যা করা হয়। কালীরঞ্জন শীল মৃতদেহ টানতে টানতে এত ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন যে, অসাড় হয়ে শুয়ে পড়েন ড. জিসি দেবের মরদেহের পাশে। আর্মি এ বিষয়টি লক্ষ্য করেনি। দ্বিতীয়বার হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে তারা কিছু সময়ের জন্য হলের বাইরে গেলে কালীরঞ্জন শীল হলের বাইরে চলে গিয়ে প্রাণ বাঁচান।

জগন্নাথ হলের এই গণকবরে আরও রয়েছেন তৎকালীন ছাত্রলীগের জনপ্রিয় নেতা মৃণাল বোস। হলে অতিথি হয়ে আসা তিনজন মুসলিম ছাত্রও ওই রাতে প্রাণ হারান। পাকিস্তানি সৈন্যরা হলে হত্যা অভিযান শুরু করেছিল পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে। তারা কামানের গোলা দাগে। মেশিনগান দিয়ে নির্বিচারে গুলি চালায়। রুমে রুমে আগুন দেয়। সার্জেন্ট জহুরুল হক হলেও একই ধরনের হামলা চলে। জগন্নাথ হলের প্রতি তাদের বেশি আক্রোশ ছিল সাম্প্রদায়িক কারণে।

১ মার্চ স্বাধীনতার আন্দোলন নতুন পর্যায়ে শুরু হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। ফলে হলে অল্প সংখ্যক ছাত্র উপস্থিত ছিল। এভাবে সেই রাতে বেঁচে যাওয়া হলের ছাত্রদের অনেককে প্রাণ দিতে হয়।

নয়া শতাব্দী/আরআর

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ