রাজধানীর সরকারি বাঙলা কলেজ বধ্যভূমির ওপর দাঁড়িয়ে আছে বলে জানিয়েছেন কলেজটির অধ্যক্ষ প্রফেসর ড. ফেরদৌসী খান।
সম্প্রতি নয়া শতাব্দীকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি এ তথ্য জানান।
কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর ড. ফেরদৌসী খান বলেন, ‘যুদ্ধের পর সেনাবাহিনী কলেজের ভেতর থেকে ৪ থেকে ৫ ট্রাক নারীদের ব্যবহারিত শাড়ি, জামা-কাপড়, মাথার খুলি, হাড়গোড় তুলে নিয়ে মিরপুর বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে কবর দিয়েছে।’
মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় চিহ্নিত গণকবরের তালিকায় ও বাঙলা কলেজের বধ্যভূমির নাম আছে।
কলেজ সূত্রে জানা যায়, ২০০৭ সালে তৌহিদুর রহমান ডিয়ারের নেতৃত্বে সাধারণ শিক্ষার্থীরা গণকবর চিহ্নিত করে তা সংরক্ষণের দাবিতে আন্দোলন করে। তৎকালীন অধ্যক্ষ সুরাইয়া সুলতানার দপ্তরে গিয়ে স্মৃতিফলক নির্মাণের দাবিতে স্মারকলিপি দিলে অধ্যক্ষ ‘মুক্তিযুদ্ধ একটি ফালতু চাপ্টার’ বল্লে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হয়।
২০০৭ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের আন্দোলন চলে।
এরপর ২০১৮ সালে অধ্যক্ষ হিসেবে প্রফেসর ড. ফেরদৌসী খান দায়িত্ব নিলে গণকবর সংরক্ষণের উদ্যোগ নেন। গঠন করেন গণকবর চিহ্নিতকরণ কমিটি। কমিটির তদন্তে ৯টি স্থানে গণকবরের অস্তিত্ব পাওয়া যায় এবং সেগুলো চিহ্নিত করা হয়।
এই বিষয়ে অধ্যক্ষ বলেন, ৯টি স্পটে গণকবর চিহ্নিত করে ৩টি স্থানে স্মৃতিফলক নির্মাণ করা হয়েছে। বাকি ৬টি স্পট চিহ্নিত করা আছে। এটা নিয়া মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আমাদের কথা হচ্ছে। তাদের কাছে সহায়তা চাওয়া হয়েছে। তারা সহায়তা করলেই বাকিগুলোতে বেদি নির্মাণ করা হবে।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাক বাহিনী ও এদেশীয় রাজাকারদের নৃশংসতার সাক্ষী রাজধানীর সরকারি বাঙলা কলেজ। ১৯৭১ সালে কলেজটি থেকে বাঙলা কলেজের সাইনবোর্ড নামিয়ে উর্দু কলেজ সাইনবোর্ড লাগিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
যুদ্ধের সময়জুড়ে কলেজটিতে বাঙালিদের ধরে এনে চালানো হতো নির্যাতন। খুন, ধর্ষণ, হত্যাসহ জীবন্ত মানুষকে গলাকেটে হত্যা করা হতো এই কলেজের আঙিনায়।
যুদ্ধকালে থাকা কলেজের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী আনোয়ারা বেগমের বক্তব্য থেকে নৃশংসতার চিত্র ফুটে ওঠে।
২০১৪ সালে তিনি মারা যাওয়ায় সরাসরি তার বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে কলেজের পুরনো কর্মাচারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আনোয়ারা বেগম জানিয়েছেন, প্রশাসনিক ভবনের নিচের রুমগুলোকে টর্চারসেল হিসেবে ব্যবহার করা হতো। এখানে আটকে রেখে মেয়েদের ধর্ষণ করা হতো, ধর্ষণের পরে হত্যা করে সামনে থাকা জলাশয়ে (প্রশাসন ভবনের পেছনের জলাশয়) ফেলে দেওয়া হতো।
অধ্যক্ষের বাসভবনের আশপাশে থাকা আমগাছের শিকড়ের ওপর মানুষ জবাই করা হতো। জবাইয়ের পর একপাশে দেহ অন্যপাশে মাথা পড়ে থাকত।
তিনি জানান, প্রশাসন ভবনের সামনে একটি ঝোপঝাড় ছিল ওই ঝোপের মধ্যে নিয়েও পাকবাহিনী মেয়েদের ধর্ষণ করত। এছাড়াও কলেজের সামনে থাকা বিশালাকৃতির মাঠজুড়েই ছিল ঝোপঝাড়, যা ছিল পাক বাহিনীর ধর্ষণের কুঁড়েঘর।
তিনি আরও বলেন, কলেজের গেটের ডান পাশে (বর্তমানে ১০ তলা ভবন নির্মাণাধীন জায়গা) ছোট একটা পুকুর ছিল, হলের নিচু জায়গায়, বিজ্ঞান ভবনের কর্ণারে এবং জলাশয়ে মানুষকে হত্যা করে গণকবর দেওয়া হতো।
আনোয়ারা বেগমের তথ্যমতে, তাকে দিয়ে মানুষ হত্যা ও নির্যাতনের পরে রুমের রক্ত পরিষ্কার করাত। প্রথম দিকে মানুষের দুর্গন্ধে খাওয়া-দাওয়া বন্ধ হয়ে গেলেও পরবর্তীতে সেটা অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল তার।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর কলেজের ভেতরে পাওয়া মানুষের পচা-গলা লাশ দেখে নৃশংসতার প্রমাণ পাওয়া যায়।
নয়া শতাব্দী/আরআর
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ