ঢাকা, রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মানুষের মন জয় করেছে সিকৃবি’র ট্রাম্পি

প্রকাশনার সময়: ০৭ অক্টোবর ২০২২, ০৭:৪১
ট্রাম্পি

প্রাণ ও নগরের সাথে গড়ে উঠা আধুনিক মানুষের সাথে প্রাণিদের সখ্যতা হরহামেশা চোখে পড়ে না। যান্ত্রিক সময়ের বাস্তবতায় মানুষের মনের মধ্যে ঢুকে গেছে যান্ত্রিকতা, কুটিলতা। তবে এর মাঝেও পশুদের জন্য প্রেমহীন নগরে কখনো কখনো চোখে পড়ে ব্যাতিক্রম কিছু মানুষদের।

আধুনিকতার খটখটে এই যুগে কিছু মানুষ কেবল মানসিক প্রশান্তি পেতে ফিরে আসে পশু-পাখির কাছে। নিজের একাকীত্বে একান্ত সময় কাটায় তাদের সাথে।

সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে (সিকৃবি) সবার পরিচিত একটি প্রাণী ট্রাম্পি। সাদা ধবধবে শান্ত স্বভাবের কুকুর ট্রাম্পি। ক্যাম্পাসের প্রত্যেক প্রান্তে তার আনাগোনা। ক্লাসরুম থেকে শুরু করে আবাসিক হল, সভা, মিছিল, আন্দোলন সবখানে তার সরব উপস্থিতি রয়েছে। সকল নিয়ম ভেঙ্গে সে মানুষের সঙ্গ চায়। এ জন্য অবশ্য অন্যান্য কুকুরদের সাথে তার ঝামেলাও বাধে।

অনেকে-কুকুর বিড়াল ভয় পায়। হয়তো শান্ত ট্রাম্পি কাছে গেলেও ভয়ে তাড়িয়ে দেয় অনেকে। কিন্তু মনের অগোচরে ট্রাম্পির প্রতি ভালোবাসার কমতি নেই সিকৃবি শিক্ষার্থীদের।

২০১৬ সালের ডিসেম্বর মাসে জন্ম ট্রাম্পির। প্রতিবছর ২৮ ডিসেম্বর তার জন্মদিন পালন করা হয়। দীর্ঘদিন ধরে আদরে আর ভালোবাসায় সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫১ একরে বড় হয়েছে ট্রাম্পি। তার সাথে অনেক শিক্ষার্থীকেই মাঝে মাঝে দুষ্টু-মিষ্টি খেলা করতে দেখা যায়। এটি প্রাণির প্রতি ভালোবাসার অনন্য এক দৃশ্য।

ক্যাম্পাসের প্রাণি অধিকার সংরক্ষণের সংগঠন প্রাধিকার প্রায়ই ট্রাম্পির দেখাশোনা করে, অসুস্থতায় দেয় চিকিৎসা সেবা। ট্রাম্পি ক্যানাইন ট্রান্সমিসিবল ভেনেরাল টিউমার (সিটিভিটি)-এ আক্রান্ত হলে তাকে কেমোথেরাপিও দেওয়া হয়েছিল। এতে আস্তে আস্তে সুস্থ হয়ে উঠে ট্রাম্পি।

কুকুরকে কেমোথেরাপি দেওয়ার ঘটনাকে একটি বিরল ঘটনা উল্লেখ করে প্রাধিকার সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক আরিজ আহম্মেদ সাদ বলেন, প্রাধিকারের সাবেক সভাপতি বিনায়ক শর্মা ট্রাম্পির কেমোথেরাপির ব্যবস্থা করেছিলেন। এখন ট্রাম্পি সিটিভিটি থেকে অনেকটা সুস্থও। তিনি আরও বলেন, ট্রাম্পিকে রোগমুক্ত রাখতে আমরা নির্দিষ্ট সময় পর পর কৃমিনাশক খাওয়াই, তাছাড়াও পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার জন্য তাকে গোসল করানোর ব্যবস্থাও করা হয়। পাশাপাশি ভিটামিন-মিনারেল খাওয়ানো তথা সার্বিক যত্ন নেয়ার চেষ্টা করা হয়।

সম্প্রতি ট্রাম্পি আবার রোগাক্রান্ত হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, বর্তমান সময়টি প্যারাসাইটিক ইনফেকশন এর জন্য উত্তম সময়। এই সময়ে প্যারাসাইটের কারণে ডার্মাটাইটিস এর প্রাদুর্ভাব ক্যাম্পাস ও এর আশেপাশের কুকুরগুলোর মাঝে লক্ষণীয়। ট্রাম্পিও প্যারাসাইটিক স্কিন ইনফেকশন এ আক্রান্ত হয়েছে। প্রথমে স্কিনে ছোট একটি ইনফেকশন দিয়ে শুরু, পরবর্তীতে এই ইনফেকশন শিরদাঁড়া বরাবর ছড়িয়ে পড়ে।

আরিজ আহম্মেদ বলেন, এ বিষয়টি আমাদের নজরে এলে ট্রাম্পিকে ক্যাম্পাসের পশু হাসপাতালে তিন দিনের পর্যবেক্ষণে রাখার পর তার চিকিৎসা শুরু করি।

ট্রাম্পির বেড়ে উঠা বিশ্ববিদ্যালয়ের শাহ এ এম এস কিবরিয়া হলে। ধবধবে সাদা ছোট্ট ট্রাম্পি তখন সকলের নজর কাড়ে। তখন থেকেই একটু একটু করে সবার মাঝে নিজের জায়গা তৈরি নেয় ট্রাম্পি। অন্যদের মত প্রাধিকারের সাবেক সভাপতি বিনায়ক শর্মার নজরে আসে ট্রাম্পি। তখন তার বয়স প্রায় ৫-৬ মাস। কোন এক সকালে জালাল মামার টং দোকানে খাবারের জন্য বসেছিলো ট্রাম্পি। সেদিন থেকেই বিনায়ক শর্মার সাথে বন্ধুত্ব শুরু হয় ট্রাম্পির।

ট্রাম্পি ধীরেধীরে সবার সাথে বন্ধুত্ব গড়ে তোলে। প্রতিদিন সকাল বেলা সবার সাথে হেঁটে হেঁটে ক্লাসে যাওয়া শুরু করে সে। সবাই ক্লাস করে আর সে বসে থাকে বারান্দায়, আবার ক্লাস শেষে একসাথে বের হয়। ট্রাম্পির সাথে মেশার পর ক্যম্পাসের অনেকের কুকুরের প্রতি ভীতি অনেকটাই কেটে গেছে। কেউ ট্রাম্পি বলে ডাকলেই তার কাছে ছুটে আসে সে। গায়ে একটু হাত বুলালেই অবুঝ প্রাণিটি কোলে চড়ে বসে। এ যেন মানুষ আর প্রাণীর মাঝে একটি মিলবন্ধন, যেখানে জয় হয়েছে বন্ধুত্বের, ভালবাসার।

প্রাধিকারের সাবেক সভাপতি বিনায়ক শর্মা বলেন, ট্রাম্পির সাথে আমার যখন দেখা হয় তখন তার বয়স ৫ অথবা ৬ মাস। আমার পুরো ক্যাম্পাসের স্মৃতিতে সে রয়েছে। ট্রাম্পি আমার সাথে ক্লাসে যেত, প্রাধিকার, ফটোগ্রাফিক সোসাইটির মিটিংসহ সবকিছুতে সে থাকত। সন্ধ্যায় যখন ক্যাম্পাস থেকে বাসায় ফিরতাম তখন তার প্রচণ্ড মন খারাপের চাহনিগুলো প্রায়ই অনুভব করি। আমি চার তলা ভবনের উপর থেকে ডাকলে সে নিজে রাস্তা বের করে সিড়ি বেয়ে আমার কাছে চলে আসতো। ক্যাম্পাস যখন ঈদ অথবা পূজোর জন্য ছুটি হতো তখন আমি সিলেট থেকে অন্য কোথাও যেতাম না। মনে হতো খাবার না পেয়ে কষ্ট পাবে। লকডাউন এর পুরো সময়টাতেও সিলেটে ছিলাম। ট্রাম্পির প্রতি ভালোবাসা থেকে ক্যাম্পাসের সব কুকুর-বিড়ালের জন্য নিজে বিশাল পাতিলে মুরগী হাড়, পা, কলিজা দিয়ে খিচুড়ি রান্না করে নিয়ে যেতাম।

বর্তমানে দেশের বাইরে পিএইচডি রত প্রাণীপ্রেমি বিনায়ক শর্মা বলেন, আমি শুধু ট্রাম্পির জন্যই দ্রুত দেশে আসবো মনে হচ্ছে।

যান্ত্রিক যুগে এমন প্রাণিপ্রেম কিভাবে দেখছেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমি সারাজীবন বিশ্বাস করব, যাদের প্রাণীর প্রতি মায়া কাজ করে তাদের মধ্যে অনেক সুন্দর একটা মন রয়েছে। আর এই যান্ত্রিক যুগে একদম বিশুদ্ধ ভালোবাসা যে কেউ বোবা-বিশ্বাসী প্রানীগুলো থেকেই পেতে পারে। এছাড়া একঘেয়ে জীবনে প্রিয় কোন প্রাণীর সাথে সময় কাটালে মানসিক প্রশান্তি পাওয়া যায় বলেও উল্লেখ করেন তিনি।

ট্রাম্পির নামে ফেসবুকে একটি পেজ রয়েছে। প্রায়শই ট্রাম্পির মনের কথাগুলো ফেসবুক পেজে পোস্ট করা হয়। ক্যাম্পাসের বিভিন্ন প্রান্তে ট্রাম্পির পদাচারণা ও ট্রাম্পির প্রতি সবার বন্ধুত্বের বিভিন্ন গল্প ও ছবি পোস্ট করা হয় পেজে। তেমনি একটি ঘটনা ট্রাম্পির ফেজবুক পেজে পোস্ট করেছিলেন প্রাধিকারের সাবেক সভাপতি আহমেদ রাফি। করোনাকালিন ক্যাম্পাসে এসে ট্রাম্পির সাথে তার সুন্দর মূহুর্তের কথা লিখেছেন তিনি- “সত্যি বলতে, আমার সাথে ট্রাম্পির সম্পর্কটি দেখা হলে একটা ১০ টাকার বনরুটি, মাঝে মধ্যে দুই একবার মাথায় হাত বুলানো আর কাছে আসলেই ধমক দেওয়ার মাঝেই সীমাবদ্ধ। অথচ পাঁচ মাস পর আজকে সে আমাকে দেখে এমন ভাবে জড়িয়ে ধরল যে, বন্ধ পেলেই ক্যাম্পাস থেকে ১০০ হাত দুরে থাকার শপথ নেওয়া আমার কাছে সন্ধ্যা থেকে বারবার মনে পড়ছে ক্যাম্পাসে সে একা। অন্তত তার জন্য হলেও ক্যাম্পাসে যাওয়া উচিত।”

ট্রাম্পি নিজেকে যেমন ভালোবাসার পাত্র হিসেবে প্রমাণ করেছে, তেমনি সিকৃবি শিক্ষার্থীরাও প্রাণির প্রতি ভালোবাসার অনন্য নজির স্থাপন করেছে। এভাবেই যুগে যুগে নাগরিক যান্ত্রিকতা থেকে মুক্তি নিয়ে প্রকৃতি ও পরিবেশের ভালোবাসায় মানুষ নিজেকে নিয়োজিত করবে এমনটিই প্রত্যাশিত।

নয়াশতাব্দী/এমএস

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ