পরিবারতন্ত্র কায়েম হয়েছে খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে। এ প্রতিষ্ঠানের উপাচার্য অধ্যাপক ড. শহীদুর রহমান খান নিয়োগে স্বজনপ্রীতির অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। নিজের পুত্র-কন্যাসহ আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে অন্তত ৯ জনকে নিয়োগ দিয়েছেন তিনি। এমনকি স্ত্রীকেও নিয়োগ দেয়ার চেষ্টা করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) তদন্তে উপাচার্যের এমন অনিয়মের চিত্র উঠে এসেছে। ইউজিসির তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি সম্প্রতি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে তাদের প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। এতে নিয়োগ নিয়ে উপাচার্যের নানা অপকর্মের ফিরিস্তি তুলে ধরা হয়। তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘উপাচার্য শহীদুর রহমান খান নিজের পরিবারের সদস্য ও আত্মীয়দের মধ্যে কমপক্ষে ৯ জনকে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে নিয়োগ দিয়েছেন। উপাচার্য নিজের ছেলে শফিউর রহমান খান ও শ্যালক জসীম উদ্দীনকে নিয়োগ দিয়েছেন শাখা কর্মকর্তা পদে। চারজনকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে, যারা উপাচার্যের ভাতিজা। তারা হলেন— হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা পদে মুরাদ বিল্লাহ, প্রশাসনিক কর্মকর্তা পদে সুলতান মাহমুদ, ল্যাব টেকনিশিয়ান পদে ইমরান হোসেন এবং অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর পদে মিজানুর রহমান। উপাচার্যের শ্যালিকার ছেলে সায়ফুল্লাহ হককে নিয়োগ দেয়া হয়েছে সহকারী প্রকৌশলী (বিদ্যুৎ) হিসেবে। নিকটাত্মীয় নিজামউদ্দিনকে ডাটাএন্ট্রি অপারেটর পদে নিয়োগ দিয়েছেন উপাচার্য। তারা সবাই অস্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োগ পেয়েছেন।
মেয়ে ইসরাত খানকে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে শিক্ষক হিসেবে যে প্রক্রিয়ায় নিয়োগ দেয়া হয়েছে, সেটি ত্রুটিযুক্ত বলে তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। কারণ, তিনি অন্য প্রার্থীর চেয়ে শিক্ষাজীবনের ফলে পিছিয়েছিলেন। তদন্ত কমিটি বলেছে, উপাচার্যের মেয়েকে নিয়োগ প্রক্রিয়াতে স্বজনপ্রীতি ও ত্রুটি পরিলক্ষিত হয়েছে। নিজের স্ত্রীকেও বিশ্ববিদ্যালয়টিতে সরাসরি অধ্যাপক পদে নিয়োগের চেষ্টা করেছিলেন। উপাচার্যের স্ত্রী ফেরদৌসী বেগম ছাতক উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা। তিনি ২০২০ সালের ১৩ এপ্রিল অধ্যাপক পদে আবেদন করেন। তবে এই নিয়োগ স্থগিত করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। তদন্ত কমিটি বলেছে, ‘উপাচার্যের স্ত্রী নিয়োগের শর্তই পূরণ করেননি।’
ইউজিসির সদস্য অধ্যাপক ড. বিশ্বজিৎ চন্দ্র চন্দ ছিলেন ওই কমিটির প্রধান। বাকি দুই সদস্য হলেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব আর্কিটেকচার অনুষদের ডিন আফরোজা পারভীন এবং ইউজিসির সিনিয়র সহকারী পরিচালক গোলাম দস্তগীর। তদন্ত দলের প্রধান অধ্যাপক ড. বিশ্বজিৎ চন্দ্র চন্দ নয়া শতাব্দীকে জানান, ‘তদন্তে যা কিছু উঠে এসেছে তার সবই প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে। এর বাইরে আমার কোনো কথা নেই।’
খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক সূত্র জানায়, উপাচার্যের আত্মীয়-স্বজনের বাইরে অর্থ-বাণিজ্যের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ সব পদে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। আবার অনেক ক্ষেত্রে যোগ্যতা শিথিল করেও নিয়োগ দেয়া হয়েছে উৎকোচের বিনিময়ে। জনবল নিয়োগের ক্ষেত্রে খুলনার স্থানীয় প্রার্থীদের কৌশলে বাদ দিয়ে সিলেট
কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, উপাচার্যের নিজ জেলা নোয়াখালী, ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রারের নিজ জেলা নরসিংদী এবং উপাচার্যের স্ত্রীর নিজ জেলা বরিশালের লোকজনকে একচেটিয়া নিয়োগ দেয়া হয়েছে।
সূত্র জানায়, ২০১৯ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর সাতজন সহকারী অধ্যাপক, একজন সহকারী পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক এবং ১৪ জন প্রভাষকসহ ২৯ ধরনের পদের জন্য ৭৬ জন জনবল নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। সেই থেকেই অর্থের বিনিময়ে বিভিন্ন পদে লোক নিয়োগ ও স্থানীয় প্রার্থীদের কৌশলে বাদ দেয়ার অভিযোগ ওঠে। চাকরিপ্রার্থীর সংখ্যা কমানোর উদ্দেশ্যে কৌশলে একের পর এক বিভিন্ন অপ্রাসঙ্গিক শর্ত জুড়ে দেয়া হয় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে। রেজিস্ট্রার সার্বজনীন পদ হলেও ‘কৃষি সংশ্লিষ্ট বিষয়ে স্নাতক-স্নাতকোত্তর’— এর শর্ত আরোপ করা হয়, যা দেশের অন্য কোনো কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে হয়নি। রেজিস্ট্রার মূলত প্রশাসনিক পদ। খন্দকার মাজহারুল আনোয়ার নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে নিজেই সেই পদের জন্য প্রার্থী হন।
ইউজিসির তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘মাইক্রোবায়োলজি অ্যান্ড পাবলিক হেলথ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক পদে নিয়োগ পাওয়া আশিকুল আলমের শিক্ষাগত যোগ্যতা বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা যোগ্যতার চেয়ে কম। তিনি ডিভিএমে দ্বিতীয় শ্রেণি এবং এমএসসিতে প্রথম শ্রেণি পাওয়া। নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে বলা ছিল, প্রার্থীকে সিজিপিএ ৪-এর মধ্যে ন্যূনতম সাড়ে ৩ পেতে হবে। এই শর্ত শিথিল করা যাবে, যদি প্রার্থীর পিএইচডি ডিগ্রি থাকে। আশিকুল আলমের পিএইচডি ডিগ্রি ছিল না। জানা যায়, তিনি উপাচার্য শহীদুর রহমান খানের অধীনে গবেষণারত ছিলেন। ইউজিসির প্রতিবেদনে আশিকুল আলমের শিক্ষক হিসেবে পাওয়া নিয়োগটি ত্রুটিপূর্ণ হওয়ায় বিধি অনুযায়ী, ব্যবস্থা নেয়া, স্ত্রীকে সরাসরি অধ্যাপক বানানোর নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি বাতিল করা এবং সব নিয়োগে স্বজনপ্রীতি ও অঞ্চলপ্রীতি না করাসহ সাত দফা সুপারিশ করা হয়। নিয়োগে অনিয়ম ও ইউজিসির তদন্ত প্রতিবেদনের বিষয়ে জানতে কয়েকবার ফোন করেও খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. শহীদুর রহমান খানের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। ২০১৫ সালের ৫ জুলাই জাতীয় সংসদে খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় বিল পাস হয়। এরপর ২০১৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর প্রথম উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পান বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মো. শহীদুর রহমান খান। তিনি ২০১৮ সালের ১১ নভেম্বর রেজিস্ট্রার পদের বিপরীতে অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার হিসেবে ছয় মাসের জন্য অ্যাডহকভিত্তিতে নিয়োগ দেন ডা. মো মাজহারুল আনোয়ারকে। ২০১৯ সালের ২৯ জানুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আনুষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়।
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ