খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুয়েট) শিক্ষক ড. মো. সেলিম হোসেনের ‘অস্বাভাবিক’ মৃত্যুর ঘটনায় প্রতিষ্ঠানের ৪৪ জন ছাত্রকে শাস্তির আওতায় আনা হয়েছে। এর মধ্যে কুয়েট ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাদমান নাহিয়ান সেজানসহ ৪জনকে কুয়েট থেকে আজীবন বহিষ্কার করা হয়েছে।

বুধবার ( ৫ জানুয়ারি) দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের জরুরি সিন্ডিকেট সভা শেষে ভারপ্রাপ্ত রেজিষ্ট্রার আনিসুর রহমান ভূঞা এ সিদ্ধান্তের বিষয়টি নিশ্চিত করেন।

শিকক্ষ সেলিম হোসেনকে বাসায় যেতে না দিয়ে অফিসে বসতে বাধ্য করায় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে শৃংখলা ভঙ্গের বা আচরণবিধি ভঙ্গের অভিযোগ আনা হয়েছে বলেও উল্লেখ করা হয়। এছাড়াও কুয়েটে ছাত্র রাজনীতির ওপর কতিপয় বিধি-নিষেধ আরোপ করা হয়েছে। এর আগে সকাল ৯টায় ছাত্র শৃঙ্খলা কমিটির মুলতবি সভায় শাস্তির বিষয়টি চূড়ান্ত হয়।

কুয়েটের ভারপ্রাপ্ত রেজিষ্ট্রার আনিসুর রহমান ভূঞা জানান, ৫টি ধাপে শাস্তি নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে প্রথম ধাপে আজীবন বহিস্কৃতদের মধ্যে কুয়েট ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাদমান নাহিয়ান সেজান, হাসান আব্দুল কাইয়ূম, মো. কামরুজ্জামান ও রিয়াজ খান নিলয়।

দ্বিতীয় ধাপে ৭জন শিক্ষার্থীকে ২ শিক্ষাবর্ষ এবং আবাসিক হল থেকে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করা হয়েছে। এরা হলেন- তাহমিদুল হক রিয়াজ, মাহমুদুল হাসান, সাদমান সাকিব, মাহিম মুনতাসির, এএসএম রাগিব আহসান, মীর জামিউর রহমান ও রুদ্রনীল সিংহ শুভ।

তৃতীয় ধাপে ১জন শিক্ষার্থীকে ১ শিক্ষাবর্ষ এবং আবাসিক হল থেকে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করা হয়েছে। অভিযুক্ত ছাত্রের নাম আনিকুর রহমান।

চতুর্থ ধাপে ২২জনকে ১ শিক্ষাবর্ষ বহিষ্কার করা হয়েছে। তবে, এই শাস্তি এখন কার্যকর হবে না। ভবিষ্যতে কোন ধরনের নৈতিক স্খলনজনিত অভিযোগ প্রমাণিত হলে এই শাস্তি কার্যকর করা হবে এবং পঞ্চম ধাপে আরও ১০জন ছাত্রকে ১০ হাজার টাকা করে জরিমানা করা হয়েছে। এই শাস্তিও এখন কার্যকর হবে না। ভবিষ্যতে তাদের বিরুদ্ধে কোন ধরনের নৈতিক স্খলনজনিত অভিযোগ প্রমাণিত হলে এই শাস্তি কার্যকর করা হবে বলেও উল্লেখ করেন ভারপ্রাপ্ত রেজিষ্ট্রার আনিসুর রহমান ভূঞা।

কুয়েটের রেজিষ্ট্রারের দপ্তরের সূত্র জানান, কুয়েটে শৃংখলা ফেরাতে ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতির ওপর কতিপয় বিধি-নিষেধ আরোপ করা হয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে- ক্যাম্পাস থেকে সকল ধরনের রাজনৈতিক প্যানা-পোষ্টার-ব্যানার-ফেস্টুন অপসারণ, কোন ধরনের রাজনৈতিক মিছিল, সভা বা কর্মসূচি করতে হলে ছাত্র কল্যাণ পরিচালকের দপ্তর থেকে অনুমতি গ্রহণ ইত্যাদি।

উল্লেখ্য, গত বছরের ৩০ নভেম্বর বিকেলে কুয়েটের ইইই বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. সেলিম হোসেন মারা যান। তার মৃত্যুর পর সাধারণ শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের পক্ষ থেকে অভিযোগ ওঠে এই মৃত্যুর জন্য বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাদমান নাহিয়ান সেজানসহ তার অনুগত ছাত্ররা দায়ি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, বিশ্ববিদ্যালয়ের লালনশাহ হলের ডিসেম্বর মাসের খাদ্য ব্যবস্থাপক (ডাইনিং ম্যানেজার) নির্বাচন নিয়ে ড. সেলিমকে চাপ দিয়ে আসছিলেন ফজলুল হক হলের আবাসিক শিক্ষার্থী ও কুয়েট ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাদমান নাহিয়ান সেজান। এরই ধারাবাহিকতায় ঘটনার দিন দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে সাদমান নাহিয়ান সেজানের নেতৃত্বাধীন কয়েকজন শিক্ষার্থী ক্যাম্পাসের রাস্তায় ড. সেলিমকে জেরা শুরু করেন। পরে তারা শিক্ষককে অনুসরণ করে তার ব্যক্তিগত কক্ষে (তড়িৎ প্রকৌশল ভবন) প্রবেশ করেন।

সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, তারা আনুমানিক আধাঘণ্টা শিক্ষকের রুমে ছিলেন। পরে কক্ষ থেকে বেরিয়ে ড. সেলিম দুপুরের খাবার খেতে ক্যাম্পাস থেকে নিজ বাসায় যান। দুপুর আড়াইটার দিকে তার স্ত্রী লক্ষ্য করেন, তিনি বাথরুম থেকে বের হচ্ছেন না। দরজা ভেঙে তাকে উদ্ধার করে খুলনা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।

অভিযোগ ওঠে, দাফতরিক কক্ষে কুয়েট শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাদমান নাহিয়ান সেজানের নেতৃত্বে কতিপয় ছাত্রের জেরা, অপমান, অবরুদ্ধ করে রাখা ও মানসিক নির্যাতনে ড. সেলিমের মৃত্যু হয়েছে। এ ঘটনা তদন্তে দুই দফায় কমিটি গঠন করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।

অপরদিকে, ড. সেলিমের মৃত্যুর ঘটনায় জড়িতদের চিহ্নিত করে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্থায়ীভাবে বহিষ্কারের দাবিসহ পাঁচ দফা দাবিতে গত ২ ডিসেম্বর দুপুরে একাডেমিক কার্যক্রম বর্জন করে শিক্ষক সমিতি। প্রতিবাদ সমাবেশ থেকে কুয়েট ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধসহ দায়ি ছাত্রদের শাস্তির দাবি জানান শিক্ষকরা।

এদিকে, ৪৪ জন ছাত্রের বিষয়ে করণীয় নির্ধারণে মঙ্গলবার (০৪ জানুয়ারি) ছাত্র শৃঙ্খলা কমিটির সভা দীর্ঘ সাড়ে ৭ ঘণ্টা শেষে বিকাল সাড়ে ৫ টায় সভা মুলতবি করা হয়। বুধবার (০৫ জানুয়ারি) সকাল ৯টায় ফের মুলতবি সভা অনুষ্ঠিত হয়।

নয়া শতাব্দী/জেআই