ঢাকা, মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

কেমন চলছে ছাত্রলীগবিহীন বেরোবির আবাসিক হল

প্রকাশনার সময়: ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২০:২৫

রাষ্ট্রক্ষমতায় যে সরকার থাকে তাদের ছাত্র সংগঠনের নেতারাই নিয়ন্ত্রণ করেন দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আবাসিক হলগুলো। হলে সিট পেতে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের ছাত্রনেতাদের দ্বারস্ত হতে হতো। এর ব্যতিক্রম ছিল না বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) হলগুলো। বেরোবির হলগুলোতে গত ১৩ বছর নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করে রেখেছিল। কে হলে থাকবে কে থাকবে না এ সবকিছুই নির্ধারণ করতো ছাত্রলীগের নেতারা। এসব নেতাদের কাছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন পর্যন্ত ছিল প্রায় জিম্মি।

হলগুলো সিট ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা অবৈধভাবে দখল করে রাখতেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো ব্লক আকারে ভাগাভাগি করে নিতেন ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক গ্রুপ। সাধারণ শিক্ষার্থীরা কেউ হলে সিট লিগ্যাল করলেও তারা হলে থাকতে পারতেন না। আবাসিক হলে শিক্ষার্থীদের থাকতে হলে একটি সিটের জন্য ছাত্রলীগের নেতাদের দিতে হতো দুই থেকে তিন হাজার টাকা। এক রুমের গাদাগাদি করে থাকতে হতো শিক্ষার্থীদের। চারজনের সিটে থাকতেন ছয় জন শিক্ষার্থী। অন্যদিকে ছাত্রলীগের নেতারা ইলিগ্যালভাবে একা একটি করে রুম দখল করে থাকতেন। তাদের দখলের রুমগুলো নিজের বেডরুম বানিয়ে থাকতেন। হলের ডাইনিংগুলো তাদের জন্য বিনা টাকার হোটেল হয়ে গেছিলো। হলে বিভিন্ন দিবসে শিক্ষার্থীদের খাবারের জন্য হল প্রশাসন ছাত্রলীগের হাতে বাজেট তুলে দিতেন। তারা বাজেটের অর্ধেকের কম টাকা দিয়ে অস্বাস্থ্যকর খাবার শিক্ষার্থীদের খাওয়াতেন আর বাকি টাকা তারা নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নিতেন।

ছাত্রলীগের ছত্রচ্ছায়ায় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা শিক্ষার্থীরাও অবৈধভাবে হলে অবস্থান করত। এতে নতুনদের জায়গা হতো না হলগুলোতে। আর্থিকভাবে দারিদ্রতার কারণে অনেকেই বাধ্য হয়ে প্রথম বর্ষে হলে উঠে পোহাতে হতো অসহনীয় যন্ত্রণা। এসব শিক্ষার্থীদের স্থান হতো গণরুমে। ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা নবীন শিক্ষার্থীদের পরিচিতির নামে গেস্টরুমে নিয়ে নির্যাতন, মিছিল মিটিংয়ে নিয়মিত অংশগ্রহণ, নেতাদের প্রটোকল ও নির্বাচনি প্রচারণাসহ নানা কাজে অংশগ্রহণ করা ছিল বাধ্যতামূলক। ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের বিভিন্ন প্রোগ্রামে না গেলে শিক্ষার্থীদের হল থেকে বের করে দেয়াসহ নানা রকম ভয়ভীতি দেখানো হতো।

যেসব শিক্ষার্থী ছাত্রলীগের মিছিল মিটিংয়ে যেতেন না তাদের ছাত্রশিবির ট্যাগ দিয়ে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করতো। হলে অন্য রাজনৈতিক মতাদর্শের কোন শিক্ষার্থী আছে জানতে পারলে তাদের মারধর ও ছাদ থেকে ফেলে দেওয়ার হুমকি দিতো।

এসব নানাবিধ কারণে ক্লাস-পরীক্ষাসহ শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা চরমভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হতো। অনেকেই হতাশ হয়ে আবাসিক হল ছেড়ে মেসে চলে যেতে বাধ্য হতেন। তবে গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা সরকার পদত্যাগ করে পলায়নের পর দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ন্যায় বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরেছে নতুন রূপ। এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে ছাত্রলীগের কোন চিহ্ন নেই। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন দীর্ঘদিন পর নতুন করে মেধা ও দারিদ্রতার উপর ভিত্তি করে হলের সিটবণ্টন করার কার্যক্রম চালাচ্ছে। ফলে শিক্ষার্থীসহ সর্বমহলে প্রশংসা কুড়িয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।

শিক্ষার্থীদের মতে, আগের কোন কালচার বর্তমানে হলগুলোতে আর নেই। হলে এখন আর 'আদুভাই' খ্যাত কেউ থাকে না। তাদের দাবি বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো যেন কোনো গোষ্ঠীর অধীনে চলে না যায়। সাধারণ শিক্ষার্থীরা যেন কারো কাছে জিম্মি না হয়ে পড়ে।

বঙ্গবন্ধু হলের আবাসিক শিক্ষার্থী শাহরিয়ার বলেন, ‘হলগুলোতে এখন পুরাতন কালচারে চলে না। কেউ আর নেতার তোষামোদী করে সময় পার করছে না। শিক্ষার্থীরা স্বাধীনভাবে পড়ালেখা করছে। ছাত্রলীগের দখলে হল থাকলে আমি কোনদিন হলে উঠতাম না। গণরুম, গেস্টরুম কালচার বিশ্ববিদ্যালয়ে আর নেই। এখন আর চার জনের সিটে ছয়জন থাকতে হয় না।

শহীদ মুখতার ইলাহী হলের শিক্ষার্থী মো. সাকিব ইসলাম বলেন, হলের আবাসিক শিক্ষার্থী আগে হলে ছাত্রলীগের রাজত্ব ছিল। তারা হলের প্রতিটি রুম দখল করে থাকতো। সিট বাণিজ্য করত, প্রতিটি সিটের জন্য দুই থেকে তিন হাজার টাকা করে সবার কাছ থেকে জোরপূর্বক নিতো। টাকা না দিলে হল থেকে বের করে দেয়ার ভয় দেখাতো। হলের অসচ্ছল মেধাবী শিক্ষার্থীদের জিম্মি করে তারা রাজনীতি করতো। ২০২৪ সালে কোটা সংস্কার আন্দোলনে সময় হল থেকে আমরা যারা আন্দোলনে গিয়েছিলাম তাদেরকে রুমে নিয়ে গিয়ে আন্দোলনে যাইতে নিষেধ করছিল এবং পরবর্তীতে আন্দোলনে গেলে হল থেকে জোরপূর্বক বের করে দেবে বলে হুমকি দিয়েছিল। এরপরেও যারা আন্দোলনে গিয়েছিলাম। তাদেরকে শিবিরের ট্যাগ দিয়ে হল থেকে বের করে দিয়েছিল। সরকার পতন যদি না হইত তাহলে আমাদের প্রাণনাশের হুমকি ছিল।

তিনি বলেন, স্বৈরাচার সরকার পতনের পর হলের অবস্থা স্বাভাবিক হয়েছে। সাধারণ শিক্ষার্থীরা এখন হলে শান্তিতে পড়াশুনা ও থাকতে পারছি। হলে এখন পড়াশোনার স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরে এসেছে। আমাদের চাওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল আবাসিক হলে সব-সময় এরকম পড়াশোনা পরিবেশ থাকুক এবং মেধাবী শিক্ষার্থীরা ভালোভাবে পড়াশোনা করে দেশ ও জাতির উন্নতিতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করুক।

নতুন ভর্তি শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার আগে যেই বিষয়টা নিয়ে সবচেয়ে বেশি আতঙ্কিত ছিলাম তা হলো র‍্যাগিং। তবে এখন পর্যন্ত এরকম কোন র‍্যাগিংয়ের স্বীকার হয়নি। এটাই বোধহয় বিপ্লব পরবর্তী সময়ের পরিবর্তিত রূপের একটি চিত্র। শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা, বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলো বর্তমান সময়ের মতোই সবসময় প্রশাসনের অধীনে থাকবে। হল কর্তৃপক্ষ শিক্ষার্থীদের মতামতের ভিত্তিতে সকল ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে। তৃতীয় কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর কাছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন জিম্মি হবে না। এখন ছেলেদের দুটি আবাসিক হলের ডাইনিংয়ের দায়িত্ব শিক্ষার্থীরা নিয়ে মান সম্মত খাবার পরিবেশন করেছে।

নয়া শতাব্দী/এসআর

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ