ঋতুর রাণী হেমন্তের আগমনে বাঙালি মেতে ওঠে নবান্ন উৎসবে। গ্রীষ্মের হাঁসফাঁস করতে থাকা বাংলায় শরতের পরে শূন্য, রিক্ত ও বিষন্ন প্রকৃতিতে আবির্ভূত হয় হেমন্ত ঋতু। শরৎ প্রকৃতির বহু বর্ণিল ঐশ্বর্য ও সৌন্দর্যের স্নিগ্ধতার আবেশ মানবমনে শিহরণ তুলে না, শিহরণ তুলে হিমসমীরণে অদূরবর্তী তুষারের আগাম বার্তা।
তবে, কাঠখোট্টা প্রকৌশলীদের চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (চুয়েট) হেমন্ত আসে নীরবে, নিভৃতে। অথচ প্রকৃতি কিন্তু দু-হাত বাড়িয়ে দিতে কার্পণ্য করে না। সবুজ স্বর্গ খ্যাত ক্যাম্পাসে প্রকৃতি ফুটিয়ে তুলে অপরূপ সৌন্দর্য্য। বাতাসে ভেসে বেড়ায় শিউলি, কামীনি ফুলের গন্ধ। চিরচেনা হতাশার চত্বর থেকে আবাসিক এলাকা, যতদূর চোখ যায় আকাশচুম্বী গাছ ভেদ করে কুয়াশার আলো স্পর্শ করে ভূ-ত্বক।
দিনের বেলা ল্যাবশিট প্রিন্টিং আর ফটোকপির মারপ্যাচে হয়ত লুকিয়ে থাকে মূহুর্তগুলো। কিন্তু রাতের বেলা ডিফারেন্সিয়াল ক্যালকুলাসের মাঝে আটকে থাকা স্বপ্নগুলো নিয়ে হাঁটতে থাকা বিষন্ন পথিকের কাছে প্রকৃতি এগিয়ে আসে তার নিজস্ব সৌন্দর্য প্রকাশের তাড়নায়।
পথিকের মত হেমন্তের রুপে মুগ্ধ কবি জীবনান্দের ভাষায়-
‘আমি এই অঘ্রাণেরে ভালোবাসি,
বিকেলের এই রঙ-রঙের শূন্যতা
রোদের নরম রোম-ঢালু মাঠ-বিবর্ণ
বাদামি পাখি-হলুদ বিচালি পাতা কুড়াবার দিন
ঘাসে ঘাসে কুড়ানির মুখে তাই নাই কোনো কথা,
ধানের সোনার কাজ ফুরায়েছে জীবনেরে জেনেছে সে’হেমন্তকালে রাতের চুয়েট বড্ড সুন্দর! বড্ড মায়াবী। ল্যাম্পপোস্টের আলোয় ভেসে থাকা কুয়াশার মধ্যে যেন পথিক নিজেকে খুঁজে। দূর থেকে কাটাপাহাড় দেয় রহস্যের হাতছানি। নিস্তব্ধ ক্যাম্পাসে ঝোপঝাড়ে ঝিঁঝিঁ পোকা ডাকে। প্রকৃতির সঙ্গে মিশে এর শব্দ তরঙ্গ তৈরি করে মায়াজাল। সেই জালে আবদ্ধ হয়ে পথিক যেন খুঁজে পায় নিজেকে। একটু করে পায় স্বস্তির নিশ্বাস।
বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার বিজ্ঞান ও কৌশল বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী সুরাইয়া পারভীন প্রান্তিকা বলেন, চুয়েটে হেমন্তকাল শীতের আগমনী বার্তা নিয়ে আসে। এ সময়টাতে ক্যাম্পাসে ধোঁয়ার মতো কুয়াশার দাপট যে কাউকে বিভ্রান্তিতে ফেলে দেয়। ভোরবেলা চারদিকের জমাট বাঁধা কুয়াশা ভেদ করে শহরগামী বাসের যাত্রা শুরু হয়, আর প্রতিদিনকার মতো ব্যস্ত জীবনচক্র এগিয়ে চলে। কুয়াশায় জড়ানো প্রকৃতি, গাছের পাতায় জমে থাকা শিশিরবিন্দু রোদের আলো পেলে মুক্তোর রূপ নেয়। চুয়েটের হেমন্তকাল তাই শুধু প্রকৃতির রূপ বদল নয়, এটি শিক্ষার্থীদের ব্যস্ত জীবনে এক নতুন মাত্রা যোগ করে, যেখানে শীতলতার ছোঁয়া আর কুয়াশায় মোড়ানো ক্যাম্পাস মনের গভীরে স্মৃতি হয়ে থেকে যায়।
একই বর্ষের স্থাপত্য বিভাগের আরেক শিক্ষার্থী অর্ঘ্য দাস অংকুরের মতে, হেমন্ত শীতের আগমনের বার্তা বাহক। প্রকৃতি নিজেকে পরিবর্তন করে নতুন রূপে নিজেকে সাজিয়ে তোলে, নিজের পুরোনো ভূষন ছেড়ে নিজেকে শান্ত নদীর মতো স্থির করে। চুয়েটেও এর রেষ চমৎকার বোঝা যায়, সবুজ স্বর্গ খ্যাত চুয়েটের গাছের পাতাগুলো আস্তে আস্তে ঝরে পড়ে, মনে করিয়ে দেয় এক সময় হয়তো চুয়েটও আমাদের ছেড়ে যেতে হবে, আর বরণ হবে নতুন মুখ। সকালের হালকা কুয়াশা, নরম রোদ আর ঘুম চোখে ক্লাস এ যেন নিজের সাথে নিজের যুদ্ধ। গভীর রাতে মৃদু কুয়াশা ঠেলে বড় ভাই বন্ধু মিলে কাটা পাহাড় আরোহনে যাওয়া যেন মনে হয় নেপোলিয়ন বাহিনী সকল ভয় কাটিয়ে নতুন আরেক রাজ্য জয়ের এক কাহিনী রচিত করছে। চুয়েট প্রতি হেমন্তে ছেড়ে যায় নতুন কথা, নতুন স্মৃতি।
তবে এ ক্যাম্পাসে একটা অভাব কখনো মেটে না। তা হলো মায়ের হাতের পিঠা। শাহী ভাপা, ভাপা কুলি, দুধ কুলি, পাকান কুলি, তেল কুলি আর নারকেল কুলিসহ রকমারি পিঠা-পুলিতে গ্রাম বাংলা উৎসবে মেতে থাকলেও চুয়েটে মায়ের হাতের পিঠার বড্ড অভাব। সেজন্য মায়ের সেলাই করা কাঁথা জড়িয়ে মাকে মনে করা আর কঠিন কঠিন ডিফারেন্সিয়াল অপারেটর সমাধান করা ছাড়া উপায় থাকে না। বড্ড মনে পড়ে মায়ের কথা।
নয়া শতাব্দী/এসআর
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ