রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে (রাবি) হলের গেস্টরুমে বসাকে কেন্দ্র করে রাতভর সংঘর্ষে জড়িয়েছে শাখা ছাত্রলীগের দুই পক্ষ। এ ধরনের তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে বাগ-বিতণ্ডা কিংবা হাতাহাতির মত ঘটনা ঘটলেও এবারের ঘটনা ভিন্নমাত্রা পেয়েছে। নেতাদের মধ্যে বিভাজন, আধিপত্য বিস্তার এবং হলে সভাপতি-সম্পাদক থাকা সত্ত্বেও ‘দায়িত্বপ্রাপ্ত’ নেতা সৃষ্টিকে কেন্দ্র করে ক্ষোভ থেকেই এই সংঘর্ষের উৎপত্তি হয়েছে। শাখা ছাত্রলীগের একাধিক নেতাদের সঙ্গে কথা বলে বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে।
গত শনিবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী হলের গেস্টরুমে বসাকে কেন্দ্র করে বাগ-বিতণ্ডায় জড়ায় বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি নিয়াজ মোর্শেদ এবং হল ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি আতিকুর রহমান আতিক। আতিক বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান বাবুর অনুসারী হওয়ায় সভাপতির নেতাকর্মীরা আতিকের পক্ষে অবস্থান নেয়। একপর্যায়ে তাদের সঙ্গে যোগ দেয় সাধারণ সম্পাদক আসাদুল্লা-হিল-গালিবের অনুসারীরাও।
অন্যদিকে এসময় বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি ও পদ বঞ্চিত নেতা শাহিনুল ইসলাম সরকার ডনকে নিয়াজ মোর্শেদের পক্ষে অবস্থান নিতে দেখা যায়।
এদিন রাত ১১টায় শুরু হওয়া এই সংঘর্ষ স্তিমিত হয় রাত ৩টার দিকে। এসময় উভয় পক্ষকে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করতে দেখা যায়। এছাড়াও নেতা-কর্মীদের হাতে রামদা, রডসহ দেশিয় অস্ত্রশস্ত্র দেখা গেছে। সংঘর্ষ চলাকালে ৬টি ককটেল বিস্ফোরণের শব্দও শোনা গেছে। তবে ককটেল বিস্ফোরণের দায় নিতে চায়নি কোনো পক্ষই।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত বছরের ২১ অক্টোবর রাবি শাখা ছাত্রলীগের নতুন কমিটি গঠন করা হলে পদ বঞ্চিত নেতারা নতুন কমিটিকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করে। কাজী আমিনুল হক লিংকন, শাহিনুল ইসলাম সরকার ডন, সাকিবুল হাসান বাকিসহ অবাঞ্ছিত ঘোষণাকারী নেতাদের সঙ্গে ছিলেন নিয়াজ মোর্শেদও। অন্যরা বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনীতিতে জড়িত না থাকলেও নিয়াজ রাজনীতির মাঠে সক্রিয় আছেন। তবে কমিটি ঘোষণার পর কিছুদিন সাধারণ সম্পাদকের সঙ্গে তাকে রাজনীতিতে দেখা যায়। এরপর জাতীয় কোনো কর্মসূচি ছাড়া নিয়াজ মোর্শেদকে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের সঙ্গে রাজনীতি করতে দেখা যায়নি। ওই সময় থেকে ছাত্রলীগের একাংশের সঙ্গে বিভাজন সৃষ্টি হয় নতুন কমিটির।
এই বিষয়ে শাখা ছাত্রলীগের একাধিক ছাত্রলীগ নেতা অভিযোগ করে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় শাখার নতুন কমিটি হওয়ার পরে তারা হলে আধিপত্য বিস্তারে নতুন কায়দা অবলম্বন করেন। হল ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক থাকা সত্ত্বেও নতুন করে দুজনকে ‘দায়িত্বপ্রাপ্ত’ নেতা নির্বাচন করেন শাখা ছাত্রলীগের নতুন সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক। ফলে হল সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে ডিঙিয়ে হলে আধিপত্য বিস্তার করতে থাকেন নতুন দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা। এসময় জাতীয় কোনো কর্মসূচি বা হলেও প্রাপ্ত সম্মান হারান তারা। এর মধ্যে এক হলের সভাপতির কক্ষে তালা মেরে তাকে হত্যার হুমকিরও অভিযোগ ওঠে হলের এক দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতার বিরুদ্ধে। ফলে ধীরে ধীরে শাখা ছাত্রলীগের নেতাদের প্রতি ক্ষোভের সৃষ্টি হয় তাদের। এই ক্ষোভেরই চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ হিসেবে সংঘর্ষের সৃষ্টি হয়েছে বলে দাবি অনেকের।
আবাসিক হল ও ছাত্রলীগ সূত্রে জানা গেছে, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী হলে মোস্তাফিজুর রহমান বাবুর পক্ষের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা ফজলে রাব্বি জুনিয়র হওয়ায় হলে প্রভাব বিস্তার করার চেষ্টা করেন বাবুর ঘনিষ্ঠ আতিকুর রহমান আতিক। হলের বিভিন্ন ইস্যুতে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেওয়ার চেষ্টা করেন তিনি। বিষয়টি ভালোভাবে নেননি হল ছাত্রলীগের সভাপতি নিয়াজ মোর্শেদ। এছাড়া হলের আসন ভাগাভাগি নিয়েও তাদের মধ্যে ঝামেলা চলছিল।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক ছাত্রলীগ নেতা বলেন, ‘ছাত্রলীগের নতুন কমিটির সঙ্গে শুরু থেকেই নিয়াজসহ একটি অংশের ঝামেলা চলছিল। এরপর হলগুলোতে দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা দিয়ে হলের নেতাদের নিষ্ক্রিয় করার চেষ্টা করা হয়। সেখান থেকে সেই বিরোধ আরও প্রকট আকার ধারণ করে।’
হল শাখা ছাত্রলীগের আরেক নেতা বলেন, ‘নিয়াজের ব্লকের একটি সিট নিয়ে আতিকের সঙ্গে তার ঝামেলা হয়। পরবর্তীতে হল সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আতিকের সঙ্গে কথা কাটাকাটি হয়। আর হলের সহ-সভাপতি হয়ে হলে আধিপত্য বিস্তারের বিষয়টি নিয়াজ ভালোভাবে নেয়নি। যার ফলশ্রুতিতে এই তুচ্ছ বিষয়টি প্রকাণ্ড আকার ধারণ করেছে।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক হলের সাধারণ সম্পাদক বলেন, ‘হলের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক বর্তমান থাকা সত্ত্বেও পদ-পদবিহীন অনেক জুনিয়র কর্মীকে হলের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। যা আমাদের জন্য অত্যন্ত অপমানজনক ও মানহানিকর। আমাদেরকে রাজনীতি থেকে নিষ্ক্রিয় করার জন্যই তারা এই অপচেষ্টা করছেন। যা হলের সভাপতি-সম্পাদকদের মনে ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে। যার চূড়ান্ত পরিণতি এই সংঘর্ষ।’
এ বিষয়ে শাখা ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সোহরাওয়ার্দী হলের সভাপতি নিয়াজ মোর্শেদ বলেন, কয়েকটি হলে বর্তমান সভাপতি-সম্পাদক থাকা অবস্থায়ও হলে দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা দেওয়া হয়েছে। আমাদের রাজনীতি থেকে নিষ্ক্রিয় করার জন্যই মূলত এই দায়িত্বপ্রাপ্ত সভাপতি-সম্পাদক সৃষ্টি করা হয়েছে। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের পদবী অনুযায়ী আমাদের যে সম্মান তাও দিচ্ছে না বর্তমান সভাপতি-সম্পাদক। আমাদের অনেক ছেলেপেলেকে মানসিক নির্যাতনও করেছে তারা। তাদের বাইরে আর কেউ রাজনীতি করুক এটা তারা মেনে নিতে পারছে না। ফলে এই ধরনের ঘটনার সৃষ্টি হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কোথাও দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতার বিষয়ে বলা নেই। সভাপতি- সম্পাদক চাইলে হল কমিটি বিলুপ্ত করে দিক। সেইসাথে তারা হলে ভারপ্রাপ্ত নেতা দিতে পারে। কারণ, ক্যাম্পাসে অবস্থান করেও হল কমিটির সভাপতি বা সাধারণ সম্পাদক হয়েও যদি আমরা দায়িত্ব পালন করতে না পারি, তবে এটি আমাদের জন্য সম্মান হানিকর।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান বাবু বলেন, ‘আবাসিক হলের অনেক নেতা ক্যাম্পাস ত্যাগ করায় সাংগঠনিক গতিশীলতা বৃদ্ধির জন্য আমরা হলে দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা সৃষ্টি করেছি। আর যারা ক্যাম্পাসে অবস্থান করছেন তারা সক্রিয় রাজনীতি করছেন না। ফলে তাদের হলেও দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা দেওয়া হয়েছে। আর আমরা তাদেরকে সর্বোচ্চ সুবিধা দিয়ে রাজনীতি করার সুযোগ করে দিয়েছি। কিন্তু তারা আমাদের সঙ্গে রাজনীতি না করে বিরোধ সৃষ্টি করেছে।’
সার্বিক বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আসাদুল্লা-হিল-গালিব বলেন, ‘আমাদের বর্তমান কমিটিকে সমালোচিত করে বিলুপ্ত করার পায়তারা থেকে একটি কুচক্রী মহল শিবির-ছাত্রদলের কায়দায় এই হামলা চালিয়েছে। আমরা বিষয়টি কেন্দ্রীয় নেতাদের অবগত করেছি। তারা এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন।’
নয়াশতাব্দী/এসএ
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ