ঢাকা, রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

বিতর্কের মধ্যে দিয়ে মৃত আত্মা হাজির করলো ঢাবির শিক্ষার্থীরা!

প্রকাশনার সময়: ০৮ মার্চ ২০২৪, ২৩:৩০ | আপডেট: ০৯ মার্চ ২০২৪, ০৯:৫১
ছবি- জাওয়াদ মাহমুদ

দরজা-জানালা বন্ধ, রুমের ভেতর থেকে ভেসে আসছে ভুতুড়ে শব্দ। দরজা দিয়ে উঁকি দিতেই দেখা গেলো ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন পুরো রুমে বসে আছে কিছু সংখ্যক শিক্ষার্থী। কিছুক্ষণ পর হাতে অগ্নি কুন্ডলি, কপালে তিলক, কালো পোশাকে দরজা খুলে হঠাৎ এক তান্ত্রিকের প্রবেশ। তন্ত্র সাধনা করে মৃতের আত্মা জাগিয়ে তোলাই এই তান্ত্রিকের কাজ। ভয়ংকর হাসি, চিৎকার আর মন্ত্র যপে একে একে হাজির করলেন ৬ টি মৃত আত্মাকে। তান্ত্রিকের ডাকা এই ৬ টি আত্মা হলো নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন, ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের নেত্রী প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, শহীদ জননী জাহানারা ইমাম, বীর প্রতীক তারামন বিবি, ভাস্কর নভেরা আহমেদ ও কবি সুফিয়া কামাল।

এই দৃশ্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইআর) ০০১ নম্বর রুমের। আজ বিকেলে আন্তর্জাতিক নারী দিবসকে ঘিরেই এই মহিয়সী নারীদের মৃত আত্মা ডাকার এই আয়োজন।

হলিউডের 'অরিজিন অফ ইভিল' সিনেমাটি যারা দেখেছেন তারা নিশ্চয়ই জানেন মৃত আত্মাকে ডেকে আনার কৌশল। মৃত আত্মাকে ডেকে আনার এই কৌশলকে বলা হয় প্ল্যানচ্যাট। প্ল্যানচ্যাটকে অনেকেই প্রেতসাধনার সাথে গুলিয়ে ফেললেও দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়। একটি মৃত আত্মাকে ডেকে আনার কৌশল, আরেকটি হচ্ছে শয়তানের উপাসনার মাধ্যমে প্রেত সাধনা। প্ল্যানচ্যাটে মৃতদের আত্মাকে ডাকার মাধ্যমে তাদের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করার হয়। আঠারো শতকের মাঝামাঝির দিকে প্ল্যানচ্যাট চর্চা শুরু হয়। বিভিন্ন সময়ে আত্মার সঙ্গে জীবিত মানুষের যোগাযোগ ঘটানোর চেষ্টাও করেছেন অনেকে। প্ল্যানচ্যাট নিয়ে বিশদ গবেষণা করায় ফরাসি পরলোকগত তত্ত্ব বিশেষজ্ঞ এফ এস প্ল্যাঁশেতের নামের সাথে মিল রেখেই মৃত আত্মা ডাকার এই পদ্ধতির নাম রাখা হয় প্ল্যানচ্যাট।

মৃত বীর প্রতীক তারামন বিবি তান্ত্রিকের ডাকে সারা দিয়ে হাজির হন মঞ্চে। শোনান মুক্তিযুদ্ধে তাঁর বীরত্ব গাঁথা। ক্যাম্পে রাঁধুনি হয়ে রান্না করা থেকে গোয়েন্দাবৃত্তি এবং রণাঙ্গনে অস্ত্র চালানোর সেই রোমাঞ্চকর এবং জীবন বাজি রাখার ঘটনা।

প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার শোনান তার বিপ্লবী হয়ে ওঠার গল্প। চট্টগ্রামের তরুণী কিভাবে বৃটিশদের ভিত নাড়িয়ে দিয়েছিলেন। ১৯৩২ সালে পাহাড়তলী ইউরোপিয়ান ক্লাবে সশস্ত্র আক্রমনের পর গ্রেফতার এড়াতে কিভাবে নিজের প্রাণ বিসর্জন দিয়ে দেশের জন্য জীবন দিয়েছিলেন সেই দিনকার কথা স্মরণ করিয়ে দেন। তাঁর এই বিদ্রোহী সত্তাকে সবার মধ্যে বাঁচিয়ে রাখার আহ্বান জানিয়ে হাওয়ায় মিলিয়ে যায় বাংলার প্রথম এই নারী শহীদ।

একুশে পদক প্রাপ্ত বাংলাদেশের ভাষ্কর্য শিল্পের অগ্রপথিক নভেরা আহমেদ এক আক্ষেপ নিয়ে তান্ত্রিকের ডাকে সাড়া দেন। আক্ষেপ নিয়ে তিনি বলেন নারী বলেই অবহেলিত হয়েছেন দেশে, হয়েছেন দেশান্তরী। নারীদের অবহেলার অবসান কবে ঘটবে বলে উপস্থিতিদের কাছে প্রশ্ন রেখে যান।

শহীদ জননী জাহানারা ইমাম তান্ত্রিকের ডাকে সাড়া দিয়েই একরাশ বিষ্ময় নিয়ে বলেন তাকে নারী দিবস উপলক্ষে এই সময়ে কেন ডেকে আনা হলো! এখনকার নারীরা কি সত্যিকার অর্থে নারী হয়ে উঠতে চায়? আধুনিক নারীবাদের যুগে নারীরা নারী হয়ে উঠতে গিয়ে পুরুষ বিদ্বেষী হয়ে উঠে। পোষাকের স্বাধীনতা ও সিগারেটের মধ্যেই এক শ্রেণির নারী তাদের স্বাধীনতাকে আবদ্ধ করে রেখেছে। নারীর প্রকৃত স্বার্থকতা আত্মত্যাগে। নারীকে প্রকৃত নারী হয়ে ওঠতে প্রকৃত নারীবাদ নিয়ে সোচ্চার হবার আহ্বান জানান তিনি।

কবিতা পাঠ করতে করতে বেগম সুফিয়া কামাল উপস্থিত হন মঞ্চে। তিনি বলেন, শিল্প ও সাহিত্য চর্চার মধ্যে দিয়ে পিছিয়ে পড়া নারীদের তিনি পথ দেখিয়েছিন। সুন্দর ও বৈষম্যহীন পৃথিবী গড়ার স্বপ্ন দেখেছেন। কবি জানতে চান পৃথিবীর মানুষ তাঁর স্বপ্নে দেখা সুন্দর পৃথিবীর দেখা আদৌ পেয়েছে কিনা?

তান্ত্রিকের ডাকে সবশেষে সাড়া দেন নারী জাগরনের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন। নারী জাগরণের প্রকৃত উদ্দেশ্য সফল হয়েছে কিনা তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন মহীয়সী এই নারী। একইসাথে কর্মক্ষেত্রে নারীদের নিরাপত্তা, সম্মান নিয়েও সংশয় প্রকাশ করেন তিনি। তবে তিনি জানান পূর্বের চেয়ে নারীদের শিক্ষায় অনেক অগ্রগতি হয়েছে। নারীরা ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে তার গন্তব্যে। তিনি এখনো বিশ্বাস করেন নারী-পুরুষের পারস্পরিক সহযোগিতায় তৈরি হবে প্রকৃত সমতা।

যেভাবে এলো ব্যাতিক্রমধর্মী এই আইডিয়া:

যুগে যুগে সমাজে নারীদের অগ্রগতিতে যেসকল মহীয়সী নারীদের ভূমিকা আছে সেকল নারীরা বর্তমান সময়ে বেঁচে থাকলে নারীদের অগ্রগতিকে কিভাবে মূল্যায়ন করতেন সেটি দেখার জন্যই মূলত তান্ত্রিক দিয়ে আত্মা হাজির করে 'প্ল্যানচ্যাট ডিবেট' আয়োজন করার পরিকল্পনা আসে ক্লাব সভাপতি নাঈমা জান্নাত তাকি'র মাথায়। প্ল্যানচ্যাট ডিবেটের এই অদ্ভুত আইডিয়া নিয়ে তিনি ক্লাবের অন্যান্য সদস্যদের সাথে আলোচনা করেন। এরপর সদস্যরা ক্লাবের ইসি মেম্বার ও এডভাইজরি বোর্ডের সাথে আলোচনা করলে বোর্ড ভিন্নধর্মী এই উদ্যোগের ভূয়সী প্রশংসা করেন। পরবর্তীতে ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ও ক্লাব মডারেটর তাহমিনা হক প্ল্যানচ্যাট ডিবেটের অনুমোদন দিলে সদস্যরা ব্যাতিক্রমধর্মী এই ডিবেটের আয়োজন করেন।

ব্যতিক্রমী এই বিতর্ক দেখতে এসে নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. জোবায়দা নাসরিন বলেন, নারী দিবস কেন্দ্রিক যে অনুষ্ঠানগুলো দেখতে পাওয়া যায় সেকল অনুষ্ঠানগুলো নারীদের অগ্রগতিতে কতটুকু ভূমিকা রাখে তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ আছে। নারীদের অগ্রগতির ভূমিকায় যেসকল নারীরা যুগে যুগে ভূমিকা রেখে গিয়েছেন তাদের প্ল্যানচ্যাটের মাধ্যমে ডেকে আনার উদ্যোগকে ঐতিহাসিক ঘটনা বলে উল্লেখ করেন। এই প্ল্যানচ্যাট বিতর্ক নারীবাদের প্রকৃত ইতিহাস স্মরণ করিয়ে দিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে বলে তিনি জানান।

শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট এর সহযোগী অধ্যাপক ও আইইআর ডিবেটিং ক্লাবের মডারেটর তাহমিনা হকের কাছে ভিন্নধর্মী এই বিতর্কের বিষয়ে জানতে চাইলে সময়োপযোগী ও ব্যতিক্রমী এই উদ্যোগের জন্য শিক্ষার্থীদের ধন্যবাদ জানান তিনি।

তিনি আরও জানান, শিক্ষার্থীরা একে-অপরকে সহযোগিতা করলেই সমতা তৈরি হবে। সমাজে নারী-পুরুষের পারস্পরিক সহযোগিতার মনোভাব ও শ্রদ্ধাবোধ তৈরি হলেই বৈষম্য ঘুচে যাবে, সমতার পৃথিবী তৈরি হবে।

নয়া শতাব্দী/এসআর

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ