ঢাকা, রোববার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৭ পৌষ ১৪৩১, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

দিন দিন বেপরোয়া হচ্ছেন কুবি কর্মকর্তা জাকির

প্রকাশনার সময়: ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১৩:৩১

কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুবি) নথি জালিয়াতি, একাধিক শিক্ষককে মারতে তেড়ে যাওয়া, সহকর্মী ও কর্মচারীদের সাথে অসদাচরণ, হেনস্তা ও গালমন্দ, জামাত-শিবির ট্যাগ লাগিয়ে হয়রানি, বিভিন্ন নিয়োগ ও টেন্ডার বানিজ্যের সাথে যুক্ত থাকার অভিযোগ রয়েছে ডেপুটি রেজিস্ট্রার জাকির হোসেনের বিরুদ্ধে।

সর্বশেষ উপাচার্যের কক্ষে শিক্ষকদের থাপড়িয়ে দাঁত ফেলে দেওয়ার হুমকি প্রদান করে উপাচার্যপন্থী এই কর্মকর্তা। এতসব অভিযোগ থাকার পরও ধরাছোঁয়ার বাইরে জাকির হোসেনে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা জাকিরের ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ ও বেপরোয়া ব্যবহার নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। জেষ্ঠ্য শিক্ষক ও কর্মকর্তারা মনে করেন, এই কর্মকর্তার বেপরোয়া আচরণে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় দিনদিন অশান্ত হয়ে উঠেছে।

জানা যায়, আগেও কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষককে হেনস্তা ও লাঞ্ছিত করতে ঔদ্ধত্য হয়ে এগিয়ে যান ডেপুটি রেজিস্ট্রার জাকির হোসেন। ২০১৪ সালে নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো. আবদুর রহমানকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করেন তিনি। এ ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন করা হলে পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫১তম সিন্ডিকেটে উঠে। সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ভবিষ্যতে বেপরোয়া আচরণ করলে চাকরিচ্যুতিসহ তার বিরুদ্ধে যেকোনো সিদ্ধান্ত প্রশাসন নিতে পারবে বলে জানা যায়।

২০২২ সালে জাকিরের দ্বারা ইংরেজি বিভাগের আরেক শিক্ষক অপমানিত ও হেনস্তা হয়। একই বছরের জানুয়ারি মাসে তার নেতৃত্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রারের কক্ষে তালা দিয়ে তৎকালীন রেজিস্ট্রার অধ্যাপক ড. আবু তাহেরকে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়। পরবর্তীতে অধ্যাপক তাহের দায়িত্ব পালনে অস্বস্তিবোধ করছেন বলে ঐ পদ থেকে পদত্যাগ করেন।

সর্বশেষ ২০২৪ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি উপাচার্যের কক্ষে শিক্ষক সমিতির নবনির্বাচিত নেতাদের থাপড়িয়ে দাঁত ফেলে দেওয়ার হুমকি দেন। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে শিক্ষক সমিতির নবনির্বাচিত সভাপতি অধ্যাপক ড. আবু তাহের ও সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান জাকির হোসেনের বিরুদ্ধে কুমিল্লা সদর দক্ষিণ থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন।

শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. মো. আবু তাহের বলেন, জাকির হোসেন আগেও একাধিক শিক্ষককে হেনস্তা করেছেন। সিন্ডিকেটে তার বিষয়ে একটা সিদ্ধান্তও রয়েছে। তিনি যদি ভবিষ্যতে অশালীন আচরণ করেন, তাহলে চাকরিচ্যুতিসহ যেকোনো সিদ্ধান্ত বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নিতে পারবে। আমরা আজ শিক্ষকদের গণস্বাক্ষর গ্রহণ করব এবং উপাচার্যের নিকট সুষ্ঠু বিচারের দাবিতে লিখিত দিব। আমরা চাই, উপাচার্যের কক্ষে শিক্ষকদের সাথে যে অসৌজন্যমূলক আচরণ করেছে তার সুষ্ঠু তদন্ত হোক এবং এই ঘটনার দৃষ্টান্তমূলক বিচার হোক।

নৃবিজ্ঞান বিভাগের বিভাগীয় প্রধান সহযোগী অধ্যাপক আইনুল হক বলেন, আগেও বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা জাকির হোসেন এক শিক্ষকের সাথে অশোভন আচরণের জন্য একটি শোকজ চিঠি পেয়েছিলেন। উপাচার্যের কক্ষে তিনি শিক্ষকদের সাথে যে আচরণ করেছেন, তা শুধু কোনো শিক্ষকের সাথেই নয়; এমন আচরণ কোনো শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা বা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে কারোর সাথে হওয়া উচিত না। আমরা চাই, এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত হোক এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হোক।

জানা যায়, জাকির হোসেনে ২০১৩ সালে প্রশাসনিক কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ পান। অভিযোগ রয়েছে, তিনি নিয়োগ পরীক্ষায় ফেল করা প্রার্থী ছিলেন। নিয়োগ পাওয়ার পর থেকেই স্থানীয় ক্ষমতা দেখিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাব বিস্তার করে একে একে সবার সাথেই অসদাচরণ শুরু করেন। তিনি নিজেকে কখনো সাবেক অর্থমন্ত্রীর অনুসারী, কখনো সাবেক রেলমন্ত্রীর অনুসারী, আবার কখনো কুমিল্লা সদর আসনের এমপি হাজী বাহারের অনুসারী বলে পরিচয় দিয়ে প্রভাব বিস্তার করেন। এভাবে সাবেক উপাচার্য আলী আশরাফের সময়ে জাকির তার দুবাই ফেরত ভাই বিল্লালকে উপ-সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে নিয়োগ দেন। গুঞ্জন রয়েছে, তিনি তার বড় বোনকে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার জন্য উঠেপড়ে লেগেছেন।

জাকির হোসেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেপুটি রেজিস্ট্রার হয়েও বিলাসবহুল জীবন-যাপন করেন। হয়েছেন কুমিল্লা ক্লাবের সদস্য। এই ক্লাবের সদস্য হতে গেলে কমপক্ষে ২০ লাখ টাকা খরচ করতে হয়। এছাড়াও নিজের পাজেরো গাড়িতে করে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসা-যাওয়া করেন। কুমিল্লা ও ঢাকা মিলে তিনি বেশ কয়েকটি ফ্ল্যাটের মালিক। কুমিল্লায় নিজের কেনা বিলাসবহুল ফ্ল্যাটে জীবন-যাপন করেন জাকির।

আরও জানা যায়, জাকির পূর্বে সার্টিফিকেট বাণিজ্যের সাথেও জড়িত ছিলেন। তার পার্শ্ববর্তী গ্রামে ‘কাশিপুর টেকনিক্যাল কলেজ’ নামে সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে সার্টিফিকেট বানিজ্য করতো। মূলত সেখানে কোনো কলেজ ছিলো না। কুমিল্লা মহিলা কলেজের সামনে একটি অফিস নিয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করতো। পরবর্তীতে বিষয়টি প্রকাশ পেলে জাকির সার্টিফিকেট বিক্রির বানিজ্য বন্ধ করে দেন।

অভিযোগ রয়েছে, জাকির বিশ্ববিদ্যালয়ের দাপ্তরিক কাজ নিয়মিত করেন না। এ সময়ে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে বিভিন্ন দপ্তরে দপ্তরে ঘুরে বেড়ান টেন্ডার বানিজ্যের উদ্দেশ্যে। টেন্ডার হাতিয়ে নিয়ে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থের বিনিময়ে হাতবদল করেন তিনি।

এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে রয়েছে নথি জালিয়াতিরও অভিযোগ। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের নির্দেশনা অনুযায়ী কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মকর্তারা কোনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বা লাভজনক প্রতিষ্ঠানের সাথে জড়িত থাকতে পারবেন না। কিন্তু জাকির হোসেন নির্দেশনা অমান্য করে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের নথি জালিয়াতি করে ঠিকাদারি কাজ বাগিয়ে নেওয়ার চেষ্টাসহ নানা প্রতিষ্ঠান পরিচালনার অভিযোগ রয়েছে। সরকারি চাকরি করার ফলে জাকির সরাসরি কোনো প্রতিষ্ঠানের মালিকানা গ্রহণ না করলেও তার বউ ও মেয়ের নামে একাধিক ঠিকাধারী প্রতিষ্ঠান রয়েছে।

তার বড় ভাই হুমায়ূন কবির সঙ্গে মিলিত হয়ে বেশ কিছু ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মালিকানার সাথে তিনি যুক্ত রয়েছেন। তার মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান গুলো হলো- ল্যান্ডমার্ক পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট, ল্যান্ডমার্ক প্যারা-মেডিক ইনস্টিটিউট, কুমিল্লা কৃষি প্রযুক্তি ইনস্টিটিউট, লালমাই পলিটেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট, কাশিপুর টেকনিক্যাল অ্যান্ড বিজনেস ম্যানেজমেন্ট কলেজ।

এছাড়াও গত বছরে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় অফিসার্স এসোসিয়েশনের নির্বাচনে জাকির সভাপতি পদে নির্বাচন করেন। অভিযোগ রয়েছে, নির্বাচনের আগে তাকে ভোট দেওয়ার জন্য ভোটারদের নানাভাবে চাপ প্রয়োগ করেন এবং ধর্মগ্রন্থ ছুঁইয়ে শপথ করান। একাধিক ভোটার বিষয়টি প্রতিবেদককে নিশ্চিত করেন।

এসব বিষয়ে জানতে ডেপুটি রেজিস্ট্রার মোহাম্মদ জাকির হোসেনকে ফোন দেওয়া হয়। তিনি সাংবাদিক পরিচয় পেয়ে ব্যস্ততার অজুহাত দেখিয়ে ফোন রেখে দেন। পরবর্তীতে প্রতিবেদক আবার ফোন দিলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি।

সার্বিক বিষয়ে জানতে উপাচার্য ড. এএফএম আব্দুল মঈনকে কয়েকবার ফোন দেওয়া হলেও তাকে ফোনে পাওয়া যায়নি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ সৈয়দুর রহমান বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের উপর যে হামলা হয়েছে, সেখানে কর্মকর্তা জাকির না-কি দেলোয়ার সেটা বড় বিষয় না। বরং উপাচার্যের কার্যালয়ে শিক্ষকদের হুমকি দেওয়ার সাহস তারা কোথায় থেকে পায় সেটা প্রশাসনের ইন্ধনেই হয়েছে। শিক্ষক সমিতি যে পদক্ষেপ নেবে, তার প্রতি আমার পূর্ণ সমর্থন রয়েছে।

নয়াশতাব্দী/টিএ

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ